‘নৈতিক স্খলন’ কোনটাকে বলে? by উদিসা ইসলাম

আহমেদ কবীর
চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী থেকে জনপ্রতিনিধি— সবার ক্ষেত্রেই ‘নৈতিক স্খলন’ না ঘটার বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়। তবে এই নৈতিক স্খলনের ব্যাখ্যা একেক জায়গায় একেক রকম। পেশাগত অসদাচরণ দিয়েও এটিকে বোঝানো হয়ে থাকে।

সম্প্রতি নিজ দফতরের খাস কামরার ‘আপত্তিকর’ ভিডিও প্রকাশের ঘটনায় সদ্য ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হওয়া জামালপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আহমেদ কবীরের নৈতিক স্খলন বা পেশাগত অসদাচরণের বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমাজের চোখে যা কিছু নৈতিক তার ব্যত্যয় ঘটলে স্খলন বা চ্যুতি ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে তারা বলছেন, নৈতিক স্খলন কোথাও সংজ্ঞায়িত নেই। ন্যায়বিচার, সততা, নৈতিক সদগুণের যা কিছু বিপরীত, তা-ই নৈতিক স্খলন। যার যার ক্ষেত্র বিবেচনা করে সেটিকে ব্যাখ্যা করা হয়।

কখন নৈতিক স্খলন ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া হবে? বিশ্লেষকরা দুটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন দিয়ে এর ফয়সালার কথা বলছেন। <১>. যা ঘটেছে তা সাধারণভাবে বিবেক বা সমাজকে আঘাত দিয়েছে কিনা এবং <২>. ঘটনাটি অপরাধের উদ্দেশে ঘটানো হয়েছিল কিনা? এ দুটি প্রশ্নের উত্তরের ভিত্তিতে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আইনে কী আছে এবং কোনটি তার জন্য প্রযোজ্য সেদিকে এগোনো যেতে পারে।

‘সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮’ অনুযায়ী, ‘অসদাচরণ’ অর্থ অসঙ্গত আচরণ বা চাকরি শৃঙ্খলার জন্য হানিকর আচরণ, অথবা সরকারি কর্মচারীদের আচরণসংক্রান্ত বিদ্যমান বিধানের পরিপন্থী কোনও কাজ, অথবা কোনও সরকারি কর্মচারীর পক্ষে শিষ্টাচারবহির্ভূত কোনও আচরণ।

এক্ষেত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আইনসংগত আদেশ অমান্য করা, কর্তব্যে অবহেলা দেখানো; আইনসংগত কারণ ছাড়া সরকারের কোনও আদেশ, পরিপত্র ও নির্দেশ অবজ্ঞা করা; কোনও কর্তৃপক্ষের কাছে কোনও সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে অসঙ্গত, ভিত্তিহীন, হয়রানিমূলক, মিথ্যা অথবা তুচ্ছ অভিযোগসংবলিত দরখাস্ত দাখিল অথবা অন্য কোনও আইন বা বিধি-বিধানে যেসব কাজ অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে।

সংবিধান বিশেষজ্ঞ মাহমুদুল ইসলামের বইয়ে নৈতিক স্খলনের ব্যাখ্যায় বলেছেন, সব ধরনের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সঙ্গেই নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ জড়িত। তবে তিনি মনে করেন, নৈতিক স্খলন নিশ্চিত করতে হলে দুরাচার বা ডিপ্রাবেটির উপাদান দেখাতে হবে।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নৈতিক স্খলন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। দুর্নীতি, সামাজিক জীবন, পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিগত স্বভাব-চরিত্রের ব্যাপার হতে পারে। সমাজের নৈতিকতার যে মানদণ্ড সেটার নিচে নামলে সেটিকে স্খলন বলবেন।’

তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বিধিমালা আছে—কী করা যাবে আর কী করা যাবে না। সরকারি কর্মচারীদের আচরণবিধি যারা মানবেন না, যারা বিপরীতে কাজ করবেন তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।’ কী ধরনের নৈতিক স্খলনজনিত কাজের জন্য কী ধরনের শাস্তি হবে, সেটা নির্ধারিত বলেও জানান তিনি।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নৈতিক স্খলন বলতে আইনের বাইরে কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংঘটিত কর্মকাণ্ডকে বোঝায়। যেমন বিচারপতিদের বিষয়ে যদি বলি, তারা (বিচারপতিরা) শপথের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারা সংবিধানের রক্ষক ও নাগরিকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করেন। কিন্তু তারা যদি তাদের দায়িত্ব পালন না করেন বা কোনোকিছু অবৈধভাবে ডিমান্ড করেন বা তারা নিজেদের বিবেকবহির্ভূতভাবে কোনও আদেশ দেন, তাহলে সেসবই হবে নৈতিক স্খলন।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন নৈতিক স্খলনকে সমাজের দৃষ্টিকোণ দিয়েই বিচার করতে হয়। তবে এক সমাজে যেটি নৈতিক স্খলন সেটি আরেক সমাজে নাও হতে পারে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি পেশাগত জায়গা নিয়ে কথা বলি তাহলে বলতে হয়, সরকারি কর্মচারীরা কী করবেন, করবেন না তা নির্ধারিত আছে।’ এর বাইরে তাদের যাওয়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.