ওমা গো, সান ডিয়াগো! by রিম সাবরিনা জাহান সরকার

নোঙর ফেলে ভাসছে পালতোলা শৌখিন কতগুলো নৌকা
বছরখানেক আগের কথা। মুখ ভচকিয়ে ল্যাবে ঘুরে বেড়াই। কাজে জুত করতে পারছি না। দেড় বছরের কাজ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আবার নতুন প্রজেক্ট শুরু করেছি। পিএইচডি নামের এই সুড়ঙ্গের শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। কাজটা ফুসফুসের ক্রনিক রোগ নিয়ে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ বিড়ি-সিগারেট ধরিয়ে ইঁদুরের বাক্সের সামনে বসে থাকি। বেচারাদের ফুসফুসের বারোটা বেজে গেলে তাদের কেটেকুটে চলে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এই করে করে জীবন চিরতার মতো তিতা হয়ে যাচ্ছে।
তেমনি একদিন সকাল। খিটখিটে মেজাজে ল্যাবে ঢুকেছি। দুনিয়াদারি চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কে জানত এমন একটা খবর অপেক্ষা করছে আজকে। ‘ও মাগো’ বলে গালে হাত দিয়ে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লাম। কিছুটা নাটুকে হয়ে গেল বোধ হয়। কিন্তু হাজার চেষ্টাতেও অকৃত্রিম প্রতিক্রিয়াটা লুকানো গেল না। তুর্কি সুপারভাইজার ডক্টর ইলদ্রিম কিছু একটা উত্তর শোনার অপেক্ষায় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। বাংলা ওমা গো তিনি বুঝতে পারেননি। ভেবেছেন খুশিতে খাবি খেয়ে হেঁচকি তুলেছি।
কাহিনি হচ্ছে গিয়ে, আমার হেঁজিপেঁজি রদ্দি মার্কা কাজটা কীভাবে কীভাবে যেন আমেরিকান থোরাসিক সোসাইটির কনফারেন্সের ‘বেস্ট অ্যাবস্ট্রাক্ট’ বিভাগে প্রথম হয়েছে। বিশাল বড় পরিসরের কনফারেন্সটা এ বছর পড়েছে ক্যালিফোর্নিয়ার সান ডিয়াগোতে। সব শুনে আনন্দে ফড়িং নাচ দেওয়ার বদলে কেমন দুঃখ দুঃখ লাগছে। কারণ, এমন দারুণ সুযোগ পেয়েও হারাব। প্রথম কথা, মাত্র চার সপ্তাহের ভেতর জার্মানি থেকে আমেরিকার ভিসা পাব কি না, কঠিন সন্দেহ আছে। দুই নম্বর হলো, খরচে কুলাবে না। ট্যাঁকের পয়সা ফেলে পাগলেও কনফারেন্সে যায় না। বাকি থাকে তুর্কি বদান্যতা। কিন্তু সেও বলে দিয়েছে হাতে টাকা নেই। রিসার্চ গ্রান্টের খরা চলছে। এদিকে প্রাইজ মানিতেও চিড়া ভিজবে না। প্লেনের টিকিট হবে টেনেটুনে। কিন্তু হোটেল আর হবে না। হোটেলের অভাবে রাতে ফুটপাতে চিৎ–কাত হয়ে কাটিয়ে দিতে হলে মসিবত।
কথাগুলো আহমেদ সাহেবকে রাতে খাবার টেবিলে পিনপিনিয়ে বলে সান্ত্বনা আদায়ের চেষ্টা চালালাম। বছরখানেক হলো এই ভদ্রলোকের ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূত হয়ে চেপে বসেছি। বিনিময়ে তাঁর পদবিটা নিজের নামের সঙ্গে জুড়ে নেবার সৌজন্যতাটুকুও করিনি। বরং বারো হাত চওড়া সরকারি নামটাই বহাল রেখেছি। তো সিন্দাবাদের ভূত দিন কয়েকের জন্য বিদায় হওয়ার সূক্ষ্ম সম্ভাবনা দেখে সান্ত্বনার বদলে বিরাট উৎসাহ দিয়ে বুদ্ধি বাতলে দেওয়া হলো যেন রিসার্চ সেন্টারের লুকানো চুরানো কোনো ফান্ড আছে কি না, তার খোঁজ নিই। আহমেদ সাহেবের ভূত তাড়ানোর দোয়া কবুল হলো কিনা জানি না, কিন্তু জোড়াতালি দিয়ে ব্যবস্থা একটা হয়েই গেল। ভিসাও বাকি থাকল না। এক ভোরে আলো ফোটার আগেই চাম বাদুড়ের মতো ডানা ঝটপটিয়ে উড়াল দিলাম আটলান্টিক নামের বড় পুকুরটার ওপারে।
একা বোকা যাচ্ছি। সঙ্গী সাথি শূন্য। যাওয়া একেবারে শেষ মুহূর্তে ঠিক হওয়ায় এই দশা। ল্যাবের অন্য কলিগদের বন্দোবস্ত মাসখানেক আগেই করা ছিল। তাদের ফ্লাইট, হোটেল সব আলাদা ব্যবস্থা। একদিন আগেই তারা হল্লা করে দল বেঁধে রওনা দিয়েছে। গিয়ে একটু ধাতস্থ হতে পারবে। আর আমি পৌঁছানোর পরদিনই পড়িমরি করে ছুটব কনফারেন্সে যোগ দিতে। জেটল্যাগ হলেও কিছু করার নেই।
নোঙর ফেলে ভাসছে পালতোলা শৌখিন কতগুলো নৌকা
আটলান্টায় ট্রানজিট। এয়ারপোর্টে দোজখের গরম। তার ওপর ইমিগ্রেশনের বিশাল লাইন দেখে অজানা আশঙ্কা কাজ করছে। পরের ফ্লাইট ছুটে যাবে না তো? ভাবতে ভাবতে ঘেমে কুলুকুলু হয়ে ইমিগ্রেশন অফিসারের সামনে দাঁড়ালাম। এদের সন্দেহপ্রবণ সিস্টেম আবার কাঁধে পোস্টারের খাপকে রকেট লঞ্চার ভাবে কি না, তাই আলপটকা নামিয়ে ফেলতে গেলাম। তড়িঘড়িতে শক্ত প্লাস্টিকের খাপটা মেঝেতে দড়াম করে আছড়ে পুরোনো নকিয়া ফোনের মতো তিন টুকরো হয়ে তিন দিকে ছড়িয়ে পড়ল। ঘাবড়ে গিয়ে আমি পুরো হাঁ। বোয়াল মাছ লেভেলের হাঁ দেখে অফিসারের মনে দয়ামায়া হলো বোধ হয়। হাত বাড়িয়ে ধরা কাগজগুলো নিয়ে বললেন, ‘তোলো তোমার জিনিস আস্তেধীরে, আমি কাগজ দেখি ততক্ষণে’।
উবু হয়ে পোস্টার গুছিয়ে নিয়েছি, ভদ্রলোক সহাস্যে বললেন, ‘আরে তুমি দেখছি ইঁদুরের ডাক্তার।’ মৃদু প্রতিবাদ করতে গেলাম, ‘কোন দুঃখে ইঁদুরের ডাক্তার হতে যাব? আমি বায়োলজির ছাত্র। ইঁদুর আমার গবেষণার মডেল মাত্র।’ লাভ হলো না, তবে পার পেয়ে গেলাম এই দফায়। ইঁদুরের ডাক্তারের তকমা গলায় ঝুলিয়ে দৌড় দিলাম পরের প্লেনটা ধরতে। পোস্টার খাপের গলাটা এবার দুই হাতে ক্যাঁক করে চেপে ধরেছি। বেচারার দম বলে কিছু থাকলে যেকোনো সময়ে ঠুস করে বেরিয়ে যেতে পারে।
-----------দুই----------
দুই কদম হাঁটতেই দেখি মোটাসোটা এক ভদ্রলোক চেহারায় রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে একটা থাম্বা থাবড়ে ক্রমাগত আওড়ে যাচ্ছেন, ‘ট্রানজিটের যাত্রী বাঁয়ে যাবে, ট্রানজিট বাঁয়ে...’। ধরনধারণ পুরোপুরি গাবতলীর বাস কন্ডাক্টরের মতো। ট্রানজিট বাঁয়ে না বলে ‘আয়া পড়েন, সিট খালি, ডাইরেক্ট গুলিস্তান...আয়া পড়েন...’ বললেই বেশি মানাত। যা হোক, বাস, থুক্কু প্লেন কন্ডাক্টরের কথা মেনে শখানেক লোকের সঙ্গে পা মিলিয়ে বাঁয়েই ছুটলাম।
ঝামেলা ঝামেলা লাগছে। প্রথম ফ্লাইট থেকে নামিয়ে দেওয়া স্যুটকেস খুঁজে নিয়ে পরের বিমানে চেক ইন করতে হবে। ল্যাও ঠেলা। এত দৌড়াদৌড়ি কচ্ছপগতির আমার সঙ্গে যায় না। অন্য সময়ে যাত্রাপথে কেউ না কেউ সঙ্গে থাকে। আমি শুধু নিশ্চিন্তে ঝিমাতে ঝিমাতে পিছু পিছু যাই। সেখানে আজকে নিজের বুঝ বুঝে নিয়ে হুঁশিয়ার হয়ে চলতে হচ্ছে। আবার এত প্যারার ভেতরেও চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। বেশি টেনশনে কাজ করলে খালি ঘুম পায়। জীবনের যাবতীয় পরীক্ষার ভোরে বন্ধুরা যখন আখেরি চোখ বোলানো বুলাত, আমি তখন প্রচুর টেনশনের কারণে নাক ডেকে বালিশ আঁকড়ে সিন্ধুঘোটকের মতো ঘুমাতাম। আজকেও তেমনি একটা ঘুম দিয়ে টেনশন-ফেনশন বাইপাস করে দিতে ইচ্ছা করছে।
ঘুমটা আমি দিয়েই ফেললাম। তবে পরের প্লেনটা ধরার পর। বরফ কুঁচি দেওয়া এক গ্লাস টমেটোর জুস আর এক মুঠ বাদাম চিবিয়ে ইকোনমির সিটে যত দূর সম্ভব হাত-পা ছড়িয়ে, গা এলিয়ে টপ করে ঘুমিয়ে গেলাম।
এক ঘুমে একঘেয়ে উড়ালপথ পাড়ি দিয়ে সান ডিয়াগো বিমানবন্দরে পৌঁছে গেলাম। বিকেলের নরম রোদ মুখে এসে পড়েছে। অপেক্ষাটা তাই খারাপ লাগছে না। দাঁড়িয়ে আছি ইউনিভার্সিটির বন্ধু মাহদির জন্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন চালু হওয়া জিন প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগে আমাদের ব্যাচে মাত্র তেরোজন ছিলাম। সেই থেকে সবাই হরিহর আত্মা। মাহদি বিভাগের তুখোড় ছাত্র। পিএইচডি করে ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত স্ক্রিপ্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। পেপারের সংখ্যা তখনই কয়েক ডজন। সব হাই ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর। আমার ধারণা বছরখানেকের ভেতর সে ‘বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর অভাবনীয় আবিষ্কার’ ধরনের শিরোনাম হবে পত্রিকার পাতায়। সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত এক তরুণের ছবি। তখন পরিচিত মহলে আমি সেই খবর ভাঙিয়ে ভাব নেব, ‘আরে আমার ক্লাসমেট তো। কার্জন হলের কত চা-শিঙাড়া খেয়েছি একসঙ্গে...’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
মোটেলের পাশে রাস্তার ওপাশ ঘেঁষেই বন্দর
আমার আসার খবর মাহদি আগে থেকেই জানে। প্লেন থেকে নামার আগেই পার্কিং লটে গাড়ি নিয়ে বসে আছে। ফোন পেয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘নড়বে না একদম, আসছি।’ পৃথিবীজুড়ে বন্ধুবান্ধব ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকার সুবিধা অনেক। পাঁচ মিনিটের মাথায় চিকন ধুলার পরতে ঢাকা আপাত ধূসর একটা টয়োটা এসে দাঁড়াল। বলেই তো নিয়েছি গাড়ির মালিক তার ছেঁড়া বিজ্ঞানী টাইপ লোক। ধুলা মোছার ফালতু সময় তার নেই। গাড়িতে উঠে শুরু হলো বেদম হাঁচি। হাঁচির তোড়ে ছোটখাটো একটা বালুর ঝড় বয়ে গেল। রাগী চোখে তাকালাম। উত্তরে ধুলার সওদাগর চাটগাঁয়ের ছেলেটা ফিচেল হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে এস্কেলেটর চাপল।
প্যাঁচার মতো ঘাড় ঘুরিয়ে নতুন দেশের নতুন শহরটাকে দেখছি। প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ের সৈকত শহর সান ডিয়াগো। ঝকঝকে চওড়া রাস্তার দুই ধারে সারি সারি পামগাছ মাপা দূরত্বে দাঁড়িয়ে। আকাশে নীলের মাঝে সাদা মেঘ কাশফুল হয়ে ভাসছে। একেবারে তুলির আঁচড়ে আঁকা ছবি। দেখেশুনে পলক আর পড়ে না আমার। বিস্ময় ভেঙে মাহদি জানাল, পুরো শহরটা নিখুঁত নকশার ফসল। গাছপালাও বাইরে থেকে এনে লাগিয়ে বড় করা। কিছু আনা হয়েছে সীমান্তের মেক্সিকো থেকে। সঙ্গে এ–ও বলল, হলিউডের আস্তানা লস অ্যাঞ্জেলস শহর নাকি মাত্র দুই শ কিলোমিটারেরও কম দূরে এখান থেকে। চাইলে ঘুরে আসতে পারি এক ফাঁকে। মনে মনে ভাবলাম, আগে তো কনফারেন্সের পাট চুকাই। গলার কাঁটা নেমে গেলে ঘোরাঘুরি পরে দেখা যাবে নে।
হোটেলের নাম ভারিক্কি গোছের। ডেজ ইন হারাবার ভিউ। তবে চেহারা দেখে দমে গেলাম। টান বারান্দা দেওয়া সাদামাটা তিনটা তলা। হোটেলের বদলে মোটেল ভাব প্রকট। মাহদি সযত্নে স্যুটকেস তুলে দিয়ে বাসায় নাকি ল্যাবে ফেরত গেল। আর বলে গেল ঘণ্টাখানেক বাদে আবার এসে ডিনারে নিয়ে যাবে। চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে বহুদিন পর।
মোটেলবেশী হোটেলের ঘর যথেষ্ট সাজানো গোছানো। বাইরের রূপের উল্টোটা। আর পুরো হোটেল ভর্তি কনফারেন্সের লোকজন। বেশির ভাগই জার্মানি থেকে এসেছেন। কী কাকতাল! কিন্তু মিউনিখের কাউকে চোখে পড়ল না। তাতে কিছু যায় আসে না। ল্যাবের কলিগ আর সুপারভাইজারকে জানিয়ে দিলাম, বহাল তবিয়তে পৌঁছে গেছি; কালকে দেখা হচ্ছে।
রাতে লেবানিজ এক রেস্তোরাঁয় রাতের খানাপিনা সেই মাপের হলো। মোরগ-পোলাওজাতীয় খাবারটার দেড় প্লেট নামিয়ে দিয়েছি। গল্প-আড্ডার চেয়ে আধা লিটারের কোকের বোতলে সুড়ুৎ সুড়ুৎ টানই বেশি পড়েছে। চুর চুর লাগছে এখন। হোটেলে নামিয়ে দিয়ে মাহদি সেদিনের মতো বিদায় নিল। আর বলে গেল, যেকোনো সমস্যায় ফোন দিতে যেন দুবার না ভাবি।
হাতে কয়েকটা ইনস্ট্যান্ট নুডলসের প্যাকেট আর টুকিটাকি নিয়ে ওপরে উঠলাম। মাঝপথে ওয়ালমার্টে থামা হয়েছিল। হোটেল রুমের ইলেকট্রিক কেটলিটা দেখে মনে হয়েছিল, কালকে সারা দিন জ্ঞান কপচানো শেষে ঘরে ফিরে খিদে পেলে চটজলদি নুডলস করে নেওয়া যাবে। প্রবাসে এসে একটা বড় অংশ কেটেছে এই ইনস্ট্যান্ট নুডলসের ওপর ভরসা করে। আর এখন তো প্রবাসের ভেতর প্রবাস। জার্মানি থেকে আমেরিকা। সফদার ডাক্তার তো আর নই যে ‘খিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে’ হয়ে বসে থাকব। তার চেয়ে চিবোলাম না হয় আরও খানকতক ইনস্ট্যান্ট নুডলস।
প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ের সৈকত শহর সান ডিয়াগো
রাতের ঘড়ি এগারো ছুঁয়েছে। এক মগ হট কোকো নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছি। মে মাসের হালকা মিষ্টি হাওয়া বইছে। হঠাৎ দেখি অন্ধকার ফুঁড়ে নাকের ডগায় বিশাল মাস্তুল! ভড়কে গিয়ে মগ ছলকে পড়ার দশা হলো। তারপর চোখ সয়ে নিয়ে কাহিনি বুঝলাম। হোটেলের নামে হারবার ভিউ কথাটা আছে কেন স্পষ্ট হলো। রাস্তার ওপাশ ঘেঁষেই বন্দর। তাতে নোঙর ফেলে ভাসছে পালতোলা শৌখিন কতগুলো নৌকা। সঙ্গে স্পিডবোট আর ছোট-মাঝারি ইয়টও আছে। এই নিশুতি রাতের আবছায়ায় কাঠের শরীরগুলোর হালকা দোলাচল মুগ্ধ হয়ে দেখছি। এই সৌন্দর্যের কোনো ভাষা হয় না। এই রূপ কলমের আঁচড়ে বন্দী করা যায় না। এমন একটা নৌকার মাস্তুলে পাল উড়িয়ে যদি পালিয়ে যাওয়া যেত ভাঙার গৎবাঁধা জীবনটা থেকে, কেমন হতো তাহলে? পাগলাটে রোমাঞ্চের জলজ ঘ্রাণ সপাটে ঝাপটা মেরে গেল নাকে।
বেশি আগড়ুম বাগড়ুম ভাবার সময় পেলাম না। সকালে সান ডিয়াগো কনভেনশন সেন্টার খুঁজে বের করে হাজির হতে হবে। সমান্তরালে চলতে থাকা অনেকগুলো সেশনের কোন কোনটা শুনলে আখেরে কাজে দেবে তার একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলা দরকার। তাহলে হয়তো পরের দিন নিজের কাজের ওপর বকবক করতে সুবিধা হবে। কইয়ের তেলে কই ভাজার বুদ্ধি আর কী। খালি মগটায় মনের ভুলে আরেকবার চুমুক দিয়ে ঘরে ঢুকলাম।
ল্যাপটপ বের করতে গিয়ে দেখি স্যুটকেসের তালা দারুণ মুনশিয়ানার সঙ্গে ভাঙা। ভেতরে এক টুকরো নোট পাওয়া গেল। তাতে লেখা, ‘নিরাপত্তার খাতিরে তালা ভাঙতে হয়েছে বলে দুঃখিত। তবে মূল্যবান কিছু খোয়া গেলে আমরা কিন্তু দায়ী নই।’ বাহ! খোঁড়া যুক্তির বাহার দেখে রাগ লাগার বদলে হাসি পাচ্ছে। আবার দুঃখও লাগছে। ল্যাপটপটা নিরাপত্তার অজুহাতে রেখে দিলে বেশ হতো। পাঁচ কেজি ওজনের শিল-পাটার পাটা আকৃতির এই যন্ত্রটা কাজের খাতিরে সবখানে বয়ে বেড়াতে হয়। হারিয়ে গেলে পলকা দেখে একটা কিনব ভেবে রেখেছি। কিন্তু বদখত জিনিসটা তো হারাচ্ছে না! হতাশ হয়ে দ্রুত লিস্টিফিস্টি বানিয়ে বাতি নিভিয়ে দিলাম সে রাতের মতো।
------------তিন----------
মাথার ভেতর একজন ইবনে বতুতা বগলে জুতা নিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে। সুযোগ পেলেই সে জুতা ফটফটিয়ে বেরিয়ে আসে। আজকেও তাই হয়েছে। হাতের মুঠোয় গুগল ম্যাপ নামের মানচিত্রের বাপ থাকতেও লোকজনকে ঠিকানা জিজ্ঞেস করে করে হেলেদুলে হাঁটছি। অচেনা দেশে নিজেকে বোহেমিয়ান ভাবতে ভালো লাগে। সকালের মিষ্টি রোদ, ভেসে থাকা নৌকার ভিড়, নতুন শহরের পথঘাট, দালানকোঠার নকশা, মানুষজন-সব দেখতে দেখতে বিশ মিনিটের হাঁটা পথ আধা ঘণ্টা লাগিয়ে পৌঁছালাম জায়গামতো।
লেখিকা: ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার
অতিকায় সান ডিয়াগো কনভেনশন সেন্টার কিছুতেই চোখ এড়াতে পারে না। আমেরিকান থোরাসিক সোসাইটির বিশাল ব্যানারে ছাওয়া পুরো কাঠামোটা। খুঁজে পেতে পরিচিত সবার দেখা মিলল অবশেষে। আমাদের রিসার্চ গ্রুপের হেড, আমার পিএইচডি সুপারভাইজার ইলদ্রিম চোখ নাচিয়ে খুব সাগ্রহে জানতে চাইলেন, ‘কী, কেমন ধরাটা খেলে এয়ারপোর্টে? আটলান্টায় ধরেনি তোমাকে?’ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘কিসের ধরা খাওয়া, আমাকে তো আরও ইঁদুরের ডাক্তার ভেবে ঝামেলা ছাড়াই আস্তে করে ছেড়ে দিল। কিন্তু তুমি কোথাও আটকেছ মনে হচ্ছে?’ উত্তরে তার চোয়াল ঝুলে গেল। জানাল, বেচারার তুর্কি চেহারা আর জার্মান পাসপোর্ট ইত্যাদি দেখে তাকে দলছুট করিয়ে আলাদা করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গিয়েছিল। হাজার প্রশ্নের জবাব নিয়ে তারপর নাকি ছেড়েছে। ফ্লাইট মিস একদম কানের পাশ দিয়ে গিয়েছে।
টম আর গেরিট হাতের ইশারায় কিছু একটা বলার চেষ্টা করছেন। সুপারভাইজারকে পাশ কাটিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের ল্যাবের দুই পোস্টডক। গেরিট চোস্ত জার্মান, ধারালো চেহারা। জার্মান স্বভাব মোতাবেক সারাক্ষণ খঁচে থাকে। টম আইরিশম্যান, গোলগাল ভালোমানুষ। তবে ব্রিটিশ বললে খেপে যান। তাই তাকে আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রিটিশ ব্রিটিশ বলে খ্যাপাই। কাছে এগোতেই খবর দিলেন, সেভেন সিটার একটা পাওয়া গেছে। অমুক দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়া যাবে। সময়মতো যেন পার্কিংয়ে অপেক্ষা করি।
এই বুদ্ধি আগেই আঁটা। শেষের একটা দিন কনফারেন্সে ক্লিনিক্যাল আলোচনাই বেশি চলবে। আমাদের মতো মৌলিক গবেষণার লোকের জন্য তেমন একটা জরুরি না। সেদিন আমরা ফাঁকি দেব। সারা দিনের জন্য গাড়িভাড়া নেওয়া হয়েছে। আরেক ল্যাবের দু-একজনকে জুটিয়ে সদলবলে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ব। সুপারভাইজার যাবেন না জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি যাবেন মেক্সিকোর সীমান্তের দিকে, যেখানে ব্র্যান্ডের জিনিস পানির দামে পাওয়া যায়। শুনে খুশিই হলাম। নেতা গোছের কেউ থাকলে স্বাধীনতা খর্ব হয়। ভেড়ার পাল বানিয়ে হ্যাঁট হ্যাঁট করে যে দাবড়ানিটা সে সারাক্ষণ দেয় আমাদের, সেটার হাত থেকেও বাঁচা যাবে।
সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য
এলোমেলো ঘুর-ঘুরান্তির দিনটা আর আসে না। এদিকে সকাল-সন্ধ্যা জ্ঞানের ঘ্যানঘ্যান আর কাঁহাতক সহ্য হয়! নিজের পোস্টার প্রেজেন্টেশন না হয় এ রকম উতরে গেল। বাকিরাও ভালো করল। তবু সুপারভাইজার লোকটা গাঁয়ের পাঠশালার পণ্ডিতের মতো পিছে লেগে থাকে। অমুক নামকরা বিজ্ঞানীর আলোচনায় আমরা যেন বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করে তাক লাগিয়ে দিই। নইলে ‘কিন্তু কপ করে খেয়ে ফেলব’ জাতীয় হুমকি চলে। তাই কিছুটা প্রাণভয়ে কোনো সেশনে বোকাটে বোকাটে সব প্রশ্ন ছুড়ি। আবার কোনোটায় সত্যিকারের আগ্রহ নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করি। কাউকে কাউকে তো স্টেজ থেকে কফির টেবিল পর্যন্ত ধাওয়া করলাম। তবে বেশির ভাগ সময়ে সামনের সারিতে বসে হাঁ করে আধ খোলা মুখে ঘুমিয়ে কাটালাম।
সারা বেলা কনফারেন্সের পর রাতে আশপাশের রেস্তোরাঁয় হানা দিয়ে পেটচুক্তি খেয়ে সময় কেটে যাচ্ছিল একরকম। এক–আধ দিন মাহদি এসে আবার সেই লেবানিজ রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়েছিল। নাম যার সুলতান। একদিন সেখানে চোখে পড়ল, এক ধারের দেয়ালে প্রায় সব দেশের খুচরা টাকার নোট ফ্রেম বন্দী হয়ে ঝুলছে। বাংলাদেশের দুই টাকার নোটও আছে দেখলাম। দোয়েল পাখিটা পরিচিত ভঙ্গিতে উঁকি দিচ্ছে। তার একটু বাদেই একদল দেশি ভাই জাতীয় পোশাক চেক লুঙ্গি বিপজ্জনক উচ্চতায় তুলে গটগট করে ঢুকল। নোয়াখালীর ভাষায় চলা আড্ডা দেখে বোঝা গেল তারা নিয়মিত কাস্টমার। ‘এটাই আমেরিকার মজা, বুঝলা?’ চওড়া হাসিতে মাহদি দুই মহাদেশের উদারতার ফারাক ইঙ্গিত করল। দেশি ভাই আর তাদের লুঙ্গির বদৌলতে সম্পূর্ণ ঘরোয়া আমেজে সারলাম সেদিনের ডিনার। মনে হলো, লেবাননি রেস্তোরাঁ সুলতানে না, বসে আছি ‘ইয়ান তুন খাই যান’ জাতীয় দেশি কোনো ভাতের হোটেলে।
------------চার----------
এরই মধ্যে একদিন কনফারেন্সের ইচিং–বিচিংয়ের ফাঁকে কয়েকজন মিলে লাঞ্চে বেরিয়েছি। কাছেই রালফস নামের বড়সড় একটা সুপারমার্কেট আছে। স্যান্ডউইচ কিনে চিবোতে চিবোতে ফেরত যাচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল, ফুটপাতে এক উষ্কখুষ্ক লোক কম্বল–টম্বল বিছিয়ে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। তার কোলে হেলান দেওয়া কাগজের সাইনবোর্ডটায় লেখা, ‘আমাকে রালফস থেকে চিকেন উইংস কিনে দিয়ে যাও’। গেরিটকে ইশারা করে বললাম, ‘বস তো দেখছি সেই রকম’। খঁচে থাকা গেরিট গাঁক গাঁক করতে করতে বললেন, ‘কেন, অসুবিধা কী? যা খেতে চায়, পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে।’ একটু দম নিয়ে যোগ করল, ‘আর ওর জায়গায় তুমি হলে তো ঠিকই লিখে রাখতে, আমাকে বাসমতী চালের একথালা ভাত দিয়ে যাও। নইলে চিকেন উইংসগুলো দিয়ে তাড়া করব’। বলেই মুখ টিপে মশকরার হাসি হাসলেন ল্যাবের বাজখাঁই মেজাজের পোস্টডক গেরিট। গালে বিশাল এক কামড় স্যান্ডউইচ থাকায় ঠা ঠা করে হাসতে পারছে না। হায়, আলুখেকো জার্মান এই বাঙালকে ভাতের খোঁটা দেয়!
সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য
সেদিন বিকেলেও আমরা চরম খোশমেজাজে ছিলাম। চার কি পাঁচতারা এক হোটেলে আফটার পার্টি হবে। ডিজেসহ। আগ্রহ নিয়ে এসেছি। এসে দেখি ডিজে–ফিজে ঘোড়ার ডিম। লবিতে এক ছোকরা গিটার বাজিয়ে অনুরোধের গান গাইছে। ওদিকে যাদের জন্য পার্টি সেই বিজ্ঞানীদের দঙ্গল ওয়াইন হাতে নিয়ে আমশি মুখে নিঃশব্দে ঘুরপাক খাচ্ছেন। যেন মুখ খুললেই জ্ঞান উবে গিয়ে কলসি খালি হয়ে যাবে। গিটারওয়ালা ছেলেটা খুব আড়ষ্ট ভঙ্গিতে নিচু স্বরে বলে যাচ্ছে, পরের গানে শ্রোতারা কী শুনতে চান। ভেবে দেখলাম, আরে মওকা তো দারুণ! উড়াধুরা ঢিশটিং–ঢিশটিং গান হাতড়াচ্ছি মনে মনে। কিন্তু দেরি হয়ে গেল। গেরিট ততক্ষণে পিংক ফ্লয়েডের একটা ক্ল্যাসিকের নাম চেঁচিয়ে ছুড়ে দিয়েছে। উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে ছোকরাও বাজাল জানপ্রাণ দিয়ে। এদিকে আমি তক্কে তক্কে আছি। গান পেয়েছি। গানস ‘ন রোজেস। সুইট চাইল্ড ও’মাইন। ছেলেটা প্রশস্ত হাসিতে জানিয়ে দিল, অনুরোধ তার মনে ধরেছে। এক মুহূর্ত কী ভেবে সে হাওয়াই গিটার নামিয়ে পাশে রাখা ইলেকট্রিক গিটারটা প্লাগ-ইন করে নিল। বয়সে বছর সাত-আষ্টেকের বড় গেরিট অবাক হয়ে বললেন, এ্যাই, তুমি আমাদের সময়ের গান–টান শোনা শিখলে কোত্থেকে? তোমার তো পুরোনো গান বলতে বড়জোর ব্যাক স্ট্রিট বয়েজ আর ব্রিটনি স্পিয়ার্স শোনার কথা। বাঁকা হেসে বললাম, তোমার সমান আমার একটা ভাই আছে। সেই সুবাদে টিনেজ পপ না শুনে ক্ল্যাসিক রক শুনে বড় হয়েছি। শুনে গেরিটের কিছুটা হলেও তাক লেগে গেল। বেশ আমোদ পাচ্ছি। সায়েন্টিফিক আফটার পার্টি ব্যাপারটা একেবারে খারাপ লাগছে না। চলে। পরের ঘণ্টা দুয়েক কলিগদের ওয়াইন গ্লাসের সঙ্গে আমার কোল্ড কফির চিয়ারস চিয়ারস ঠোকাঠুকি আর গানবাজনা—দুটোই চলল সমানতালে।
তারপর এক সকালে বহু অপেক্ষার সেই দিন চলে এল। ঠিক হলো উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরেফিরে তারপর সোজা চলে যাব সাগরপাড়ে। বেশ খানিকটা দূরে নাকি দারুণ একটা সৈকত আছে। ভাড়া করা বিশাল গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সবাই। গাড়ির কাচে নাক ঠেকিয়ে দেখি বাইরেটা। দক্ষিণ এশীয় আন্টিরা বেজায় রঙিন সালোয়ার–কামিজের সঙ্গে ধবধবে সাদা কিংবা কটকটে গোলাপি কেডস পরে অলিগলি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। শহরঘেঁষা সাগরপাড়ে অলস সিল মাছ বড় পাথরের গায়ে পেট ভাসিয়ে রোদ পোহাচ্ছে। কী অদ্ভুতই না দেখাচ্ছে দৃশ্যগুলো।
সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য
বড় সৈকতটা খুঁজে পেয়ে আমরা হইহই করে নেমে পড়েছি। কী ভেবে চপ্পল জোড়া আঙুলে ঝুলিয়ে নিলাম আমি। বালি ওম ওম গরম। কুসুম কুসুম উষ্ণতায় ছেয়ে গেল মনটা। দলের আর মেয়ে দুজন খুব দ্রুত হেঁটে বহুদূর এগিয়ে গিয়েছে এর ভেতর। টম আর গেরিটও যে যার মতো হেলেদুলে ঘুরছে। একা পড়ে যাওয়াতে আমি এক রকম খুশি। বার কয়েক পানিতে পা ভিজিয়ে ক্ষান্ত দিয়ে বালুর ওপর কায়দা করে ডান হাতে ভর রেখে বাম দিকে এমনভাবে কেৎরে বসেছি যেন সৈকত, সাগর আর ঢেউয়ের একটা অনুভূমিক ছবি পাওয়া যায়।
ছবিটা প্রায় তুলে ফেলেছি, আর দুম করে গেরিট ফ্রেমে ঢুকে পড়ল। তা–ও আবার আদুল আদুল খালি গায়ে। শর্টস বাদে বাকি সব তিনি ঢেউয়ের ডগায় রেখে এসেছেন আল্লাহর ওয়াস্তে। যেকোনো মুহূর্তে সেগুলো জলের পেটে চলে যেতে পারে। সেদিকে থোড়াই কেয়ার করে বললেন, সাগরপাড় থেকে তিনি স্লো মোশনে দৌড়ে আসবেন আর আমি যেন পটাপট কটা ফটো খিঁচে দিই। অনিচ্ছাভরে আড়মোড়া ভেঙে আলসেমির বিশাল কুমির হাই তুলে বললাম, ‘এটা তো টমকে বললেই পারতে। আমাকে জ্বালানো কেন?’ কিন্তু টমের দিকে তাকাতেই দেখা গেল তার প্রাগৈতিহাসিক দুই বাই তিন ইঞ্চি ফিচার ফোনটা হাতে নিয়ে তিনি অপরাধী হাসি হাসছেন। এই দিয়ে আর যাই হোক ছবি খেঁচা যাবে না। অগত্যা, আরামের কেৎরে বসা বাদ দিয়ে হাতের ফোনটায় টোকার পর টোকা মেরে গেলাম। পার্টনারকে পাঠানোর জন্য তোলা ছবিগুলো কেমন হয়েছে দেখার আর ফুরসত মিলল না গেরিট মিয়ার। উল্টো দিকে রামদৌড় লাগিয়েছেন ততক্ষণে। পাগলাটে একটা ঢেউ বেসামাল ধেয়ে আসছে। সমুদ্দুরে জামাকাপড় হাতিয়ে নিলে তাকে আদুল গায়েই হোটেলে ফিরতে হবে। কারও কাছে জ্যাকেট নেই। সান ডিয়াগোর আবহাওয়া আজকে খারাপ রকমের ভালো।
--------------পাঁচ------------
সৈকত থেকে শুরু হওয়া কাঠের ছোট্ট সেতুটা একটুখানি এগিয়েই শেষ হয়ে গেছে। সেতুর মাঝপথে দাঁড়ালে মনে হয় নীল সাগরের একেবারে গহিনে দাঁড়িয়ে আছি। দুপুর হয়ে গেছে দেখে টুকটাক হাবিজাবি খেয়ে নিচ্ছি কেউ কেউ। কারও হাতে এই ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, নয় তো আইসক্রিম। দূরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খেয়ে উড়তে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিসের ধোঁয়া?’ টমের কাছ থেকে উত্তর এল, ‘খবর–টবর পড়া ছেড়ে দিয়েছ মনে হয়? এটা হলো ক্যালিফোর্নিয়ার কুখ্যাত দাবানল। এ বছরেরটা শুরু হলো মাত্র’। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, দু-একটা হেলিকপ্টারের আনাগোনা। আগুন নেভানোর চেষ্টা আর কী। আগুন দেখে বেখাপ্পাভাবে বলে ফেললাম, ‘আচ্ছা, আজকে ওদিকে বনবাদাড় পুড়ছে আর আমরা কপকপিয়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছি। কেমন যেন রোম পোড়ে, নিরো বাঁশি বাজায় টাইপ হয়ে যাচ্ছে না ব্যাপারটা?’ অনেকগুলো আলু ভাজা একবারে মুখে পুরে দলের বাকিরা রে রে করে উঠলেন, ‘দেখো, ফটকা লোক নিরোর প্যাঁ পোঁর সঙ্গে আমাদের কপকপ মেলাবে না খবরদার। আর আগুন আমরা লাগাইনি। সুতরাং তোমার মন কেমনের গুষ্টি কিলাই’। গুষ্টি কিলানোর হুমকিতে চুপ মেরে গেলাম।
সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য
তবে চুপ মেরেছিল আরও কয়েকজন। সেতুর এক পাশে তিন চারটি পেলিক্যান। তাদের চেহারায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের গাম্ভীর্য। তাদের পাশে কমলারঙা সাইনবোর্ড পতপত করে উড়ছে। তাতে ছোট করে কী যেন লেখা। কৌতূহলী হয়ে পড়তে গেলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে খটাস ঠোকর! আর্কিওপ্টেরিক্স সাইজের ধুমসো একটা পেলিক্যান মাথা ঠুকে দিয়েছে। দিয়ে আবার জায়গায় মতো ফিরে গিয়ে আধবোজা চোখে ঝিমাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি। এদিকে চোখে সর্ষে ফুল দেখার মাঝেও পেলিক্যানের গুষ্টি কিলাতে কিলাতে লেখাটা পড়ে ফেললাম। ‘প্লিজ, সরে দাঁড়াও। বুনো বাদামি পেলিক্যান। আমরা বেকুব কিসিমের লোকজনকে কামড় দিই...উই বাইট স্টুপিড পিপল’। গা টা অপমানে টং করে জ্বলে গেল। কারণ, কথা অতীব সত্য। কিন্তু ঘটে ঘিলু মিলু যে কিছু নেই, সেটা পাখিগুলো জানল কী করে? যা হোক, মাথা ডলতে ডলতেই দেখলাম, লেখাটা টমের চোখে পড়েছে। খুলে আসা ভারী চশমাটা নাকে এঁটে সেও এদিকে আসছে। আজকে তারও ঠোকর কপাল। ভং ধরে থাকা পেলিক্যানটা আধবোজা চোখ খুলে নড়েচড়ে বসেছে। পরের দৃশ্য দেখার জন্য অপমান ভুলে বাকিদের সঙ্গে ঠোঁট টিপে হাসি আটকিয়ে নিষ্পাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম।
ফেরার পথে সাগরের তাজা হাওয়ায় লাগা খিদের গতি করার জন্য গাড়ি থামাতে হলো। শুধু বেচারা টম কিছুই না খেয়ে হাত গুটিয়ে উদাস বসে থাকলেন। ছোটবেলায় বাদাম দেওয়া কী যেন খেয়ে অ্যানাফাইলাক্টিক শকে পড়ে অ্যাম্বুলেন্স-হাসপাতাল করতে হয়েছিল। সেই থেকে খাবার নিয়ে তার নখড়ার শেষ নেই। একবার চটপটি বানিয়ে ল্যাবে নিয়ে গিয়েছিলাম। অবশ্যই ঝালশূন্য। বিচিত্র নতুন খাবারটা সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে খেলেন। আর টম এসে প্রবল বেগে টেবিলের চারপাশে ঘুরপাক খেতে খেতে বললেন, ‘বাহ্ বাহ্‌, স্যাভরি স্ন্যাকস! ওয়াও, ওয়াও, লুকিং স্ক্রামশাস’। কিন্তু তাকে বাটি-চামচ ছুঁতে দেখা গেল না। এই হলো আমাদের আইরিশম্যান টম। এখানে আসা অবধি সাবওয়ে নামের রেস্তোরাঁ ছাড়া কোথাও তাকে খেতে দেখা যায়নি। তাদের খাবারে নাকি বাদামের ব্যাপার নেই।
দেখতে দেখতে সান ডিয়াগোর সূর্যের দিনগুলো ফুরিয়ে এল। আজকে ফেরার দিন। ফ্লাইট ভোররাত চারটায়। মাহদি দায়িত্ববান বন্ধুর মতো দিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু পারল না। তার বদলে ট্যাক্সির ব্যবস্থা করে দিল সন্ধ্যায় এসে দেখা করতে এসে। সেই রাতেই তাকে অতি জরুরি একটা এক্সপেরিমেন্ট চালাতে হবে তার ল্যাবে। ক্ষ্যাপা বিজ্ঞানী বলে কথা।
সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য
ট্রানজিট আটলান্টায় এসে এবার আর ভয় পেলাম না। বরং একটু ঘুরেটুরেও বেড়ালাম। ঠিক সময়ে মিউনিখের প্লেন খুঁজে নিলাম। পাশের সিট খালি দেখে হাত–পা ছেড়ে দেব দেব করছি। কিন্তু না। কোত্থেকে সাড়ে ছয় ফুট দশাসই এক তরুণ প্রায় দেড়টা আসন দখলে নিয়ে ফেলল। ওদিকে আমি যে চিপায় পড়ে আছি, সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। বিমান ছেড়ে দেওয়ার প্রায় আধঘণ্টা পর তার মুখ ফোটা শুরু হলো। ‘ভাগ্যিস, তুমি শুটকো পটকা আছ। তাই জায়গা নিয়ে বসতে পারছি। হাই, আমি রবার্ট।’ চিপা থেকে চিঁ চিঁ করে নিজের নাম বললাম। এরপরের পাঁচ-দশ মিনিটের আলাপে রবার্ট সম্পর্কে চমক লাগানো তথ্য বেরিয়ে এল। সে এক আফগানিস্তানফেরত আমেরিকান সৈনিক। আমেরিকান ঘাঁটিতে কিছু বছর সৈনিক জীবন কাটিয়ে দেশে চলে গিয়েছিল। তারপর টিভি সাংবাদিকের কাজ নিয়ে আবার ফিরে গেছে সেই আফগান দেশেই। এখন জার্মানি যাচ্ছে ফুটবল খেলতে। জার্মান একদল সাংবাদিকের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ। কিছুটা যেচে পড়ে জানতে চাইলাম, ‘আফগানিস্তান কেমন দেখেছ? যুদ্ধ আসলে কেমন?’ সপ্রতিভ রবার্ট এক মুহূর্ত আনমনা থেকে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘সাধারণ আফগান মানুষ খুব সহজ–সরল। আর ওদের কাবাব খুব মজার।’ বলেই তিনি আচমকা ফুল স্টপ হয়ে গেলেন। বোঝা গেল, এই প্রসঙ্গের আলাপে তার খুব একটা উৎসাহ নেই। আমিও আর প্রশ্ন বাড়ালাম না। তা ছাড়া, যোদ্ধাকে ‘যুদ্ধ কেমন’ জিজ্ঞেস করা বাতুলতা। যুদ্ধের প্রয়োজনীয়তা আর নিষ্প্রয়োজনীয়তা তাদের থেকে ভালো আর কেউ জানে না।
সান ডিয়াগোর নৈসর্গিক দৃশ্য
ঘুমিয়েই গিয়েছিলাম বোধ হয়। নিজের নাম শুনে সোজা হয়ে বসলাম। কাগজ মিলিয়ে এয়ার হোস্ট ভদ্রলোক বলছেন, ‘হ্লালব্রিনি ফর মিস সারকার’। ‘হ্লালব্রিনি’ বস্তুটি যে কী, বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। পাশ থেকে রবার্ট ধাঁধাটা ভেঙে দিলেন, ‘হালাল খাবার প্রি-অর্ডার করেছিলে মনে হয়। চলে এসেছে তোমার হালাল বিরিয়ানি।’ বাড়িয়ে দেওয়া ট্রে নিলাম। আগুন গরম অ্যালুমিনিয়ামের ভাণ্ড থেকে ভুরভুরে সুঘ্রাণ আসছে। আফগান কাবাবের পাঁড় ভক্ত রবার্ট জুলজুল করে চেয়ে আছে এদিকে। তাকে দেওয়া হয়েছে শুকনো রুটি, মাখন ইত্যাদি অখাদ্য। ভদ্রতা করে হ্লালব্রিনি সাধতে গিয়ে ভুল করলাম। পলকেই বিরিয়ানির অর্ধেকটা তার প্লেটে লাফিয়ে পড়ল। বাকিটা পথ বিরিয়ানির জোরেই কি না জানি না, রবার্টের মুখ চলল তুফান মেলের গতিতে। খাজুরে আলাপের ফাঁপরে পড়ে একবার ঘুমের ভান করলে খুঁচিয়ে উঠিয়ে কফি কাপ ধরিয়ে দিল। নিস্তারবিহীন বিমানযাত্রার পুরোটা রবার্ট নামের মূর্তিমান যন্ত্রণায় অস্থির। মিউনিখে নেমে হাসিমুখে তাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে আসছি, আর কানে ভেসে এল আমেরিকান সৈনিক তার দলের বাকিদের পেয়ে বলছে, ‘উফ্, কী একটা মেয়ের পাশে যে বসেছি, কথা বলে বলে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। কথার মেশিন। খালি পটরপটর আর পটরপটর…’।
মাথা নেড়ে আপন মনে হেসে বাড়ির পথ ধরলাম।
ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার
>>>ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।

No comments

Powered by Blogger.