আসাম ‘হেইট স্পিচ’ প্রতিবেদন প্রকাশ করতে যাচ্ছে আভাজ

আসাম রাজ্যের জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি)’র চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের দিন ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে সেখানে যে ধরনের ‘বিপজ্জনক বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ প্রচার করা হচ্ছে তার উপর মঙ্গলবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ক্যাম্পেইন গ্রুপ – আভাজ।

গ্রুপের সিনিয়র ক্যাম্পেইনার এন্ড্রু লেগন বলেন, উত্তপ্ত হয়ে ওঠা আন্ত-জাতিগত পরিবেশে ফেসবুকের মাধ্যমে ভীতিকর বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানোর বিষয়টি উদ্ঘাটন করেছে আভাজ।

তিনি বলেন, এ নিয়ে আমরা ফেসবুকের সঙ্গে কথা বলেছি এবং আগামীকাল [মঙ্গলবার] আমরা আমাদের অনুসন্ধানে বের হওয়া তথ্য ও ফেসবুকের গ্রহণ করা ব্যবস্থার উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করবো, যা প্রকাশে বারণ করা হয়েছে।

তার মতে এই প্রতিবেদনে যেসব বিষয় প্রকাশ করা হবে:
  • *ফেববুকের মাধ্যমে যে ধরনের বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ছড়ানো হচ্ছে তার সঙ্গে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ছড়ানো বক্তব্যের মিল রয়েছে;
  • *কিভাবে ফেসবুকের নিয়ম ও নীতি ভঙ্গ করা হচ্ছে;
  • *এবং, সম্ভাব্য মানবিক সংকট যাতে দেখা না দেয় সেজন্য অনলাইনের মাধ্যমে বিদ্বেষে ইন্ধন বন্ধের জন্য যা করা প্রয়োজন।
ফেসবুকে বিপজ্জনক বিষয়বস্তু খুঁজে বের করার অতীত রেকর্ড রয়েছে আভাজের।

অতীতে আভাজের উদঘাটনের ভিত্তিতে স্পেনে নির্বাচনের কয়েক দিন আগে ফেসবুক এমন একটি বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো নেটওয়ার্ক বন্ধ করে সক্ষম হয় যা ১.৭ মিলিয়ন মানুষের কাছে পৌছে গিয়েছিলো।

ফ্রান্সে ইয়েলো ভেস্ট সঙ্কটের সময় ভূয়া খবর (যার পাঠক ছিলো ১০৫ মিলিয়ন) ছড়ানোর উপর উপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে আভাজ। ব্রাজিলের নির্বাচনের সময় এই গ্রুপটি একটি বড় ডিজইনফরমেশন নেটওয়ার্কের তথ্য উৎঘাটন করে, যেখানে ১২.৬ মিলিয়ন ইন্টারএ্যাকশন হয়।

তবে লেগন বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা আসামে যা দেখেছি তা ভিন্ন ধরনের আতঙ্কজনক অভিজ্ঞতা। এ ব্যাপারে নজর দেয়া খুবই জরুরি।

ভারত ও হিন্দুবাদের বিরুদ্ধে চরম কটুক্তিকর একটি ফেসবুক পোস্টের কারণে লোয়ার আসামের বড়পেটা জেলার শারভোগে বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ নিয়ে ২০১৮ সালের জুনে দিল্লিভিত্তিক ওয়েবসাইট দি সিটিজেন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ওই পোস্ট দেয়ার জন্য সন্দেহভাজন পোলট্রি ব্যবসায়ী আহেদুল আলির উপর চড়াও হয় উত্তেজিত জনতা। কিন্তু আলির ফেসবুক একাউন্টটি হ্যাক করে তারই এক সাবেক হিন্দু বন্ধু তার বিরুদ্ধে মানুষকে খেপিয়ে তুলতে এ কাজটি যে করেছে সে খবর খুব কম মানুষই জানতে পারে।

আতঙ্কিত আলি থানায় গিয়ে আশ্রয় নেন, উশৃঙ্খল লোকজন আলির দোকান ভাংচুর ও তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাকে শাস্তি দানের দাবিতে সামাজিক গণমাধ্যম সয়লাব হয়ে যায়। তাকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেয়ার দাবি পর্যন্ত ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই এরপর মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্যে সামাজিক গণমাধ্যম ভরে ওঠে।

সৌভাগ্যের বিষয় হলো পুলিশ আহেদুল আলিকে জিম্মায় রেখে তদন্ত শুরু করে। পরদিন দেখা যায় জয়তিশ নাথ নামে একজন এই পোস্টটি দিয়েছিলো।

আতংকিত আলি বলেন, আমার সঙ্গে এমন আচরণ করা হতে পারে তা আমি কল্পনাও করিনি। আমার জানা কেউ এমন জঘন্য কাজ করবে তা আমি কখনো ভাবিনি। আমি ভয় পেয়ে যাই। এই আঘাত কাটিয়ে উঠতে আমার বেশ সময় লাগে। এমন পরিস্থিতিতে যেন কেউ না পরে সেই প্রার্থণা করি।

সাইবার ক্রাইমের দিক দিয়ে আসামের অবস্থান ভারতীয় রাজ্যগুলোর মধ্যে পঞ্চম।

গৌহাটির সাংবাদিক ত্রিদিব নিলিম দত্ত বলেন যে মুসলমানদেরকে খারাপ হিসেবে চিত্রায়িত করা পুরনো রীতি।

দত্ত বলেন, শারভোগ বা যেকোন স্থানেই হোক না কেন, মুসলমানদেরকে অপরাধী বা সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রায়িত করার একটি প্রবণতা রয়েছে।

বিদ্বেষকে গ্রহণ করেছে আসামের শিল্পীরা

সামাজিক গণমাধ্যমে বাড়াবাড়ি করার জন্য অনেক সময় চিন্তাভাবনা ছাড়াই ক্ষিপ্রতাকে অযুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হয়। কিন্তু যা ক্ষমার সবচেয়ে অযোগ্য তাহলো আসামের একদল শিল্পী, গীতিকার ও গায়ক মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচার ও সেগুলোকে বৈধতা প্রদানের কাজে নেমে পড়েছেন।

গত ৯ মে দি ওয়্যার পত্রিকায় সুরজ গগৌ ও অভিনব পি. বারবোরা ‘বাংলাদেশী’ শীর্ষক আসামিয় র‌্যাপ সঙ্গীতের উদাহরণ তুলে ধরেন। এর মানে এমন: “বিদেশীদের আনা হয়েছিলো আসামের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য। কিন্তু আমরা যদি আমাদের হেংদাং (তরবারি) তুলি, তাহলে বাংলাদেশীরা তাদের লুঙ্গি তুলে পালাবে।”

ওই গানে প্রত্যেক আসামিয়কে একটি করে ধারালো তরবারি সংগ্রহের আহ্বান জানানো হয়, যা দিয়ে ‘বাংলাদেশীদের’ কচুকাটা করা যাবে। এই গানে আসামিয়দের মাঝে শক্তি, দেশাত্মবোধ ও বীরত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে সপ্তদশ শতকে মোঘলদের বিরুদ্ধে লড়াই করা অহোম জেনারেল লাছিত বর্ফুখানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। আসামকে বাংলাদেশী মুক্ত করতে তরুণ আসামিয়দের প্রতি রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

রাহুল রাজখাওয়ার লেখা আরেকটি র‌্যাপ সঙ্গীত খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এক জায়গায় লেখক দাবি করেছেন যে আসামের বেকারত্ব, নদীভাঙ্গন ও মানুষ-হাতি সংঘাতের কারণও এ এই বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী।

গগৌ ও বারবোরা বলেন, রাজখোয়ার কলিগুলো এমন এক নাজুক বয়ানের উপর ভিত্তি করে রচিত যেখানে অর্থনীতি থেকে পরিবেশ পর্যন্ত – আসামের সব সমস্যার জন্য অবৈধ অভিবাসীদের দায়ি করা হয়েছে।

তারা বলেন, এ ধরনের অনেক সঙ্গীত হিপ হপ রাইমের মতো রূপ দেয়া হয়েছে।

কয়েক বছর আগে আসামে দূর্গা পূজার সময় একটি মণ্ডপে দূর্গার পায়ের নিচে পিষ্ট অসুরকে প্রচলিত রূপে তুলে না ধরে তাকে  একজন বাংলাদেশী মুসলমানের মতো রূপে দেখানো হয়েছে – তার মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি ও পড়নে লুঙ্গি।

আসামের পূজামণ্ডপেও মুসলিম বিরোধী, বাংলাদেশী বিরোধী মনোভাবের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।

গগৌ ও বারবোরা বলেন, আসলে আসাম ১৯৬০’র চেয়ে অনেক বদলে গেছে, তখন ‘ভাষা নিয়ে দাঙ্গা’র মুখে শান্তির আহ্বান জানিয়ে গান গাইতেন গায়করা।

এই দুই নিবন্ধকার বলেন, ১৯৭৭ সালে বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য জয়ন্ত হাজারিকার নেতৃত্বে সুর বাহিনী রাস্তায় আন্দোলন করে। এই প্রচেষ্টাকে আসামের মানবতাবাদী ও সাংস্কৃতিক প্রতিমূর্তি জ্যোতি প্রসাদ আগরওয়ালা মনে করতেন সঙ্গীতের সার্বিক মর্মবাণী হিসেবে, যা মানুষ ও সমাজকে সৌন্দর্য্যমণ্ডিত ও আলোকিত করে।

No comments

Powered by Blogger.