ভারতীয় শক্তির বাস্তবতা by ইনাম উল হক

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
কাশ্মীর সংযুক্ত করে নেয়া পুরোপুরি অহংকার ও অনুমিত ক্ষমতার দম্ভ। এই অঞ্চল, পাকিস্তান ও কাশ্মীরী জনগণের ব্যাপারে মোদির নেতৃত্বাধিন ভারত যে কাজটি করেছে তা দেখিয়ে দিয়েছে যে ‘জোর যার মুলুক তার’, এবং যা খুশি করা যায়। বিজেপি’র ইশতেহারে যে হিন্দুত্ব, অসহিষ্ণুতা ও সাম্প্রদায়িক আদর্শ রয়েছে তা নিয়ে অনেক কিছু বলা ও লেখা হয়েছে। তবে ভারতের সম্প্রতিক নির্বাচনে দলটির নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর এই আদর্শ বলবৎ করা হয়েছে এবং ভারতীয় সেক্যুলারিজমের বিদায় ঘটেছে। এই খুনে আদর্শ এবং ভারতের ক্ষমতায় থাকা কিছু ব্যক্তির বিষয়টি খুঁটিয়ে দেখা এ জন্য প্রয়োজন যে, ভারত আসলেই ছয় ফুট উঁচু দেহধারী কিনা বা অন্যরা কেন তাদের মুখোমুখি হতে ভয় পায়।

সামাজিকভাবে ভারত একটি ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র, যা শুধু বিলবোর্ডে শোভা পায়। জাত-পাতে ব্যাপকভাবে বিভক্ত হিন্দু সমাজ। উত্তর ও দক্ষিণ ভারত এবং শহর ও গ্রামের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য ব্যাপক। ঐতিহাসিকভাবে কখনোই দেশটি রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ছিলো না। ফলে বিদেশী শক্তিগুলোর পক্ষে দেশটি দখল সহজ হয়েছে। ৭২ বছর আগে পাকিস্তানের বিভক্তি এবং কাশ্মীরে অব্যাহত বিচ্ছিন্নতাবোধ সেই একীভূতকরণ ব্যর্থতার দুটি উদাহরণ, যদিও শত শত বছর ধরে এসব অঞ্চল সহাবস্থান করেছে। দেশ ভাগ নিয়ে রচিত সাহিত্যগুলোতে হিন্দুত্ব এবং এর প্রবক্তা শিবসেনা ও আরএসএস কিভাবে হিন্দুদের মনোভাব গড়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।

আজকের দিনে মুসলিমদের পিটিয়ে মারা ও চার্চে হামলার মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কুৎসিৎ দানবটি ভারতজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। দলিত ও অন্যান্য নিম্নবর্ণের হিন্দু, জৈন, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে কুসংস্কার একবিংশ শতকের ভারত – বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের জীবনধারা। কিভাবে মানুষকে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে, পিটিয়ে মারা হচ্ছে, হিন্দু শ্লোক উচ্চারণে বাধ্য করা হচ্ছে তার ভিডিওগুলো সামাজিক গণমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। ভারতীয় সমাজ কতটা বড় সমস্যার মুখোমুখি তার পরিচয় পাওয়া যায় এগুলো থেকে। অসহিষ্ণুতা, গোঁড়ামি ও ভারত শুধু হিন্দুদের জন্য – এসব বিষাক্ত মন্ত্র একদিন তাদের চেহারা দেখাবে। বিশ্ব একদিন দেখবে কিভাবে কেন্দ্রমুখি বল নিজে ভারে ধসে পড়ছে। এটা শুধু সময়ের ব্যাপার।

অর্থনৈতিকভাবে দেশটির পরিস্থিতি সুস্থির হতে অনেক বাকি। দারিদ্র, অবাধ দুর্নীতি, অসাম্য, বেকারত্ব, অপরাধী-রাজনীতিক চক্র, ব্যবসা করায় অসুবিধা, কর ফাঁকি ও চোরাকারবার, বিদ্যুৎ ঘাটতি, জনসংখ্যার ভার, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব এবং সামাজিক সূচকগুলোর করুণ দশার কারণে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে ভারতের আশা পুরণ নিকট ভবিষ্যতে হচ্ছে না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসন পাওয়ার সম্ভাবনা সদূর পরাহত।

সামরিক দিক দিয়েও যতটা জগন্নাথ বলা হয় ততটা নয়। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের হাতে বিমানযুদ্ধে মার খাওয়ার স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে। ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর বেশিরভাগ অস্ত্র-সরঞ্জাম সেকেলে। এগুলোর পরিবর্তন করাও সহজ সাধ্য নয়। আছে বাজেট সমস্যা, লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও ঘুষের লেনদেন। অধিকৃত কাশ্মীরে মোতায়েন বিপুল সংখ্যক সেনা সদস্য পিটিএসডি সমস্যায় ভুগছে, আত্মহত্যার উচ্চ হার এবং অবাধ্যতা মারাত্মক। মুসলিম ও শিখদের পুরোপুরি বিশ্বাস করা হয় না। স্বল্প বেতন, স্বল্প সামাজিক মর্যাদা ও দুর্বল মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার ফলে তাদের মনোবল দুর্বল। ফলে অনেক তরুণ অফিসার সশস্ত্র বাহিনীর চাকরি ছেড়ে লোভনীয় কেরিয়ার ও কর্পোরেট সেক্টরের দিকে ঝুঁকছে।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর পাইলট ও ককপিট রেশিও কম, ফ্লাইট সেফটির রেকর্ড খারাপ, রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপক সমস্যা। আর সে কারণে মিগ-২১ জঙ্গিবিমানগুলোকে বলা হয় উড়ন্ত কফিন। কাশ্মিরে পাকিস্তানের পাইলট তার চেয়ে অনেক সিনিয়র ভারতীয় পাইলটের বিমান গুলি করে ফেলে দেয়।

আর নৌবহরের দেখভাল করতেই বাজেট শেষ হয়ে যায় ভারতীয় নৌবাহিনীর। দুর্ঘটনা লেগেই আছে। সাবমেরিনে সমস্যা, এয়ারক্রাফট কেরিয়ারে সমস্যা। সম্ভবত ভারতই একমাত্র দেশ যার সশস্ত্র বাহিনীর অফিসাররা পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা আদায়ের জন্য নিয়মিত আদালতের দ্বারস্থ হন।

পরিশেষে একটি পশতু প্রবাদ তুলে ধরছি:

কপোতের চোখ খুবই সুন্দর হে বৎস

কিন্তু আকাশ তৈরি হয়েছে বাজপাখির জন্য

তাই তোমার কপোত-চক্ষু লুকিয়ে রেখে

নখরগুলো বড় করো।

No comments

Powered by Blogger.