ইরানে 'সিআইএ'র সন্দেহভাজন ১৭ জন গুপ্তচর গ্রেফতার, বেশ কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ড'

ইরানের ইন্টেলিজেন্স মিনিস্টার মাহমুদ আলাভি
ইরান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা -সিআইএ'র হয়ে কাজ করা ১৭ জন গুপ্তচরকে গ্রেফতার করেছে তারা। এদের মধ্যে কয়েক জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
দেশটির তদন্তকারী সংস্থা জানায়, সন্দেহভাজনরা ইরানের পরমাণু, সামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছিলো।
ইরানের এই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, এই অভিযোগ 'সম্পূর্ণ মিথ্যা'।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচী নিয়ে একে অপরের সাথে বিবাদে জড়িয়েছে ওয়াশিংটন ও তেহরান; এবং এ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে।
গত বছর ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি বাতিল করেন মিস্টার ট্রাম্প এবং দেশটির উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে মার্কিন প্রশাসন।
সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে উপসাগরীয় এলাকায় দুই দেশ সামরিক দ্বন্দ্বে জড়ানোর উপক্রম হয়েছিল।
গ্রেফতার বিষয়ে ইরানের ঘোষণার পর পরই মিস্টার ট্রাম্প বলেন, "ইরানের সাথে কোন ধরণের চুক্তিতে যাওয়া ক্রমাগত কষ্টকর হয়ে পড়ছে তার জন্য।"

'গুপ্তচরবৃত্তি' সম্পর্কে কী জানা যায়?

চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বিগত ১২ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করা ওইসব সন্দেহভাজন গুপ্তচরদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
ইরানের এক উচ্চ পদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারকৃত ১৭ জনই ইরানের নাগরিক। তার সামরিক, পরমাণু ক্ষেত্র এবং বেসরকারি সেক্টরের 'স্পর্শকাতর কেন্দ্রগুলোতে' কাজ করতো। তবে এরা সবাই স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতো।
তবে তিনি জানাননি যে কতজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে এবং সেগুলো কখন হস্তান্তর করা হবে।
"এই গুপ্তচরদের দণ্ড ঘোষণা করা হয়েছে, এদের মধ্যে কয়েক জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে 'পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টিকারী' হিসেবে (ইরানে এই অপরাধের সাজা মৃত্যুদণ্ড)," তদন্তকারী সংস্থার গুপ্তচরবৃত্তি বিভাগের প্রধানের উদ্ধৃতি দিয়ে এমনটা জানিয়েছে দেশটির সংবাদ মাধ্যম ইরানিয়ান স্টুডেন্টস নিউজ এজেন্সি (আইএসএনএ)।
রবিবার দেশটির ইন্টেলিজেন্স মিনিস্টার মাহমুদ আলাভি 'যুক্তরাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট গুপ্তচর' বিষয়ে একটি তথ্যচিত্র তৈরির ঘোষণা দেন, যা ইরানের টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হবে।
ইরানের ইন্টেলিজেন্স মিনিস্ট্রি, ওই তথ্যচিত্রের ট্রেইলার নিয়ে একটি সিডি প্রকাশ করেছে; যা গুপ্তচরবৃত্তি বিষয়ক বৈঠক এবং মিস্টার আলাভিসহ বেশ কয়েক জন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার রয়েছে।
কয়েক জন গুপ্তচর সিআইএ'র আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র সফরের জন্য 'ভিসার ফাঁদে' পড়েছেন বলে জানান মিস্টার আলাভি। তিনি বলেন, "অনেকে ভিসার জন্য আবেদন করতে এসে গ্রেফতার হন, এদের মধ্যে অনেকের আগে থেকেই ভিসা ছিল কিন্তু সিআইএ তাদেরকে আবারো ভিসা নবায়ন করতে বলেছিল।"
অন্যদেরকে অর্থ, আকর্ষণীয় চাকরি ও চিকিৎসা সেবার লোভ দেখানো হয়েছিল, বলেন তিনি।
ইরানের প্রেস টিভিতে "সিআইএ'র নেটওয়ার্ক" ভেঙে দেয়া নিয়ে একটি তথ্যচিত্র সম্প্রচারিত হয়েছে।
গত মাসে ইরান বলেছিল, সিআইএ'র সাথে সংশ্লিষ্ট একটি নেটওয়ার্ককে ভেঙে দিয়েছে তারা। তবে এটা স্পষ্ট নয় যে, সোমবারের ঘোষণা ওই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট কি-না।

ইরানের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব?

বিবিসি'র প্রতিবেদক কাসরা নাজি বলেন, ইরানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গুপ্তচরবৃত্তি দমনে দেশটির এই দাবিকে অনেক পর্যবেক্ষকই বেশ সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছেন।
সোমবার ইরানের ইন্টেলিজেন্স মিনিস্ট্রি জানায়, সিআইএ'র সাথে সংশ্লিষ্ট একটি চক্রকে গত মাসে ভেঙে দিয়েছেন তারা।
কিন্তু পরে তারা কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্যও দিয়েছে যেখানে বলা হয়, যে ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদেরকে গত বছরেই আটক করা হয়।
অনেকে আবার বলছেন, যে ১৭ জনের কথা বলা হচ্ছে তাদেরকে আসলে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা সবাই ইরানের নাগরিক।
ইরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে অনেক বন্দী রয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ রয়েছে।
তবে এ সময় কেন ইন্টেলিজেন্স মিনিস্ট্রি এ ধরণের ঘটনাকে সামনে নিয়ে আসছে - ধারণা করা হচ্ছে, গ্রেফতারের ঘটনা নয় বরং ইন্টেলিজেন্স মিনিস্ট্রি এবং এর প্রতিপক্ষ ইরানের সামরিক বাহিনী রেভ্যুলিউশনারি গার্ডের গোয়েন্দা ইউনিটের মধ্যে রেষারেষিই এর প্রধান কারণ।
মাত্র দুই সপ্তাহ আগে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সম্প্রচারিত একটি ডকু-ড্রামার শেষ পর্বে গোয়েন্দা ইউনিটকে কৃতিত্ব দিয়ে পশ্চিমা গুপ্তচরবৃত্তি মোকাবেলায় প্রেসিডেন্ট হাসান রূহানীর সরকারকে দুর্বল ও অকার্যকর হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
আর এখন এর জবাবে ইন্টেলিজেন্স মিনিস্ট্রি তাদের নিজেদের বানানো তথ্যচিত্রে দাবি করছে যে, গুপ্তচরবৃত্তিতে তাদের উল্লেখযোগ্য সাফল্য রয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে যে, ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিজেদের মধ্যে এক ধরণের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে যা প্রচার করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে।

চলমান সংকটের প্রেক্ষাপট কী?

জাহাজ চলাচলের জন্য বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ হরমুজ প্রণালীতে সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ঘটনার পর ইরান, যুক্তরাষ্ট্র আর যুক্তরাজ্যের মধ্যে সংকট চরমে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:
  • • গত ১৯ জুলাই শুক্রবার নিজেদের কৌশলগত জলসীমায় যুক্তরাজ্যের পতাকাবাহী একটি তেলের ট্যাংকার আটক করে ইরান। চলতি মাসের শুরুতে জিব্রাল্টার প্রণালীতে যুক্তরাজ্যের কাছে ইরানের একটি ট্যাংকার আটকের পর এর প্রতিশোধ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো তেহরান।
  • • গত সপ্তাহে মিস্টার ট্রাম্প বলেছেন, ফিরে যাওয়ার নির্দেশ না মানায় ইরানের একটি ড্রোন ধ্বংস করেছে মার্কিন সামরিক বাহিনী, যা অস্বীকার করেছে ইরান।
  • • গত মাসে নিজেদের আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ মার্কিন একটি নজরদারি ড্রোন ভূ-পাতিত করে ইরান। কিন্তু মার্কিন সামরিক বাহিনী দাবি করে যে, ঘটনার সময় আন্তর্জাতিক জলসীমায় ছিল ড্রোনটি। একে 'উস্কানিবিহীন হামলা' উল্লেখ করে এর নিন্দাও জানায় তারা।
  • • গত মে এবং জুন মাসে ওমান উপসাগরে দুটি তেলের ট্যাংকারে হামলার ঘটনায় ইরানকে দায়ী করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যা অস্বীকার করেছে ইরান।
  • ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তি বাতিলের পর ইরানের তেল খাতের উপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কঠোর করার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে।
জিব্রাল্টারের কাছে এই ইরানি তেলবাহী জাহাজটি আটক করেছিল ব্রিটেন, তার পর থেকেই ইরান পাল্টা ব্যবস্থার হুমকি দিচ্ছিল।

No comments

Powered by Blogger.