কিলাত ক্লাব থেকে বিশ্ব মঞ্চে by সামন হোসেন

১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া বাংলাদেশ আজ ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বন্ধুর পথ পরিক্রমায় কখনো পা ফসকে গেছে আবার নতুন করে উঠে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। ক্রিকেটের বনেদি দলগুলোর সঙ্গে সমানতালে লড়াই করছে ক্রিকেটাররা। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের পিচ্ছিল পথে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অভিযাত্রা রবার্ট ব্রুস কিংবা সিন্দবাদের ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ অভিযানের মতোই রোমাঞ্চকর। এক একটা বাঁক বদলে কত যে গল্প, কত যে রোমাঞ্চ তার শেষ নেই। ইতিহাসের বাঁক বদলে সমষ্টির স্বপ্নের সঙ্গে যারা একাত্ম হয়ে উঠতে পারেন প্রকৃত নায়ক তারাই। যার শুরু হয়েছিল ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ের মধ্যদিয়ে।
১৯৯৭ সালের ১৩ই এপ্রিল আইসিসি ট্রফি জয়ের সেই মুহূর্তের পরই আসলে বদলে যেতে থাকে বাংলাদেশের ক্রিকেট। এখন তো আশা ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছে এই খেলাটি। এখন কেনিয়া, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আফগানিস্তান আর নেদারল্যান্ডস যে জায়গায় দাঁড়িয়ে- তখনকার বাংলাদেশও ঠিক ওই কাতারেই ছিল। ১৯৯৭ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠে মরিস ওদুম্বে, স্টিভ টিকোলো, টনি সুজি আর কেনেডি ওটিয়ানোর কেনিয়াকে হারিয়ে ঠিক সেখান থেকে এক ধাপ উঁচুতে জায়গা করে নিয়েছিলেন আকরাম খান, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, খালেদ মাহমুদ সুজন, খালেদ মাসুদ পাইলট, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, মোহাম্মদ রফিক, সাইফুল ইসলাম খান আর হাসিবুল হোসেন শান্তরা। কেনিয়াকে রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ে ২ উইকেটে হারানোর মধ্য দিয়ে আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। লাল-সবুজ পতাকা উড়েছিল পতপত করে। বিশ্ব দেখেছিল, জেনেছিল ক্রিকেটের নতুন শক্তি বাংলাদেশের অভ্যুদয়। মনে হয় যেন এই সেদিন। কিন্তু দেখতে দেখতে কেটে গেছে ২২টি বছর। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো দলের ভিত কাঁপিয়ে দেয় টাইগাররা। বাঘের গর্জনে তটস্থ ক্রিকেট বিশ্ব। ২২ বছর আগে কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠে যে বাঘের জন্ম, তা এখন ২২ বছরের যুবা। এই ২২ বছরে কত ঘটনারই জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
আকরাম খানঃ ৬৮* প্রতিপক্ষ: নেদারল্যান্ডস (১৯৯৭): বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণ
এর আগ পর্যন্ত বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে আইসিসি ট্রফিতে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু বারবারই স্বপ্নভঙ্গের বেদনা হয়েছে সঙ্গী। ছুঁই ছুঁই দূরত্ব থেকে বিসর্জন দিতে হয়েছে বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন। তারিখটা ১৯৯৭ সালের ৪ঠা এপ্রিল। আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনালের রেসে থাকা তথা বিশ্বকাপ খেলার সম্ভাবনা ধরে রাখার জন্য নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ‘জিততেই হবে’ এমন বাস্তবতার মুখে পড়লো বাংলাদেশ। সোজা কথায়, জিতলে শেষ চার, হারলে বিদায়। এমন বাঁচা-মরার ম্যাচে আগে ব্যাট করতে নেমে ১৭১ রান জমা করলো ডাচরা। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে টাইগারদের সামনে পরিবর্তিত টার্গেট দাঁড়ালো ৩৩ ওভারে ১৪১ রান। ব্যাটিংয়ে নেমেই মহাবিপর্যয়। মাত্র ১৫ রানে ৪ উইকেট হারালো বাংলাদেশ। টপ অর্ডার পুরোপুরি টপলেস। যেন সেই পুরনো চিত্রনাট্যেরই দৃশ্যায়ন! তবে চিত্রনাট্য বদলে দিলেন অধিনায়ক আকরাম খান। দল তথা দেশের সব ভার কাঁধে তুলে নিলেন একাই। তাকে সঙ্গ দিলেন মিনহাজুল আবেদিন নান্নু (২২)। পঞ্চম উইকেট জুটিতে ৬২ রান তুলে নিয়ে প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠলেন বাংলাদেশের এই ক্রিকেটার। এনামুল হক মনি (৩) চটজলদি ফিরে গেলেও সপ্তম উইকেটে আকরামকে সুযোগ্য সমর্থন দিলেন সাইফুল ইসলাম। এই জুটিতে যোগ হলো ৫০ রান। সাইফুল সাজঘর মুখো হলে বাকি পথটুকু একাই পাড়ি দেন আকরাম। ৩ উইকেটের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়লো বাংলাদেশ। আকরাম খান অপরাজিত থাকলেন ৬৮ রানে। এই জয়ের সুবাদে সেমিফাইনালে পৌঁছে গেল বাংলাদেশ। ঘুরে দাঁড়ানো টাইগারদের আটকানোর সাধ্য ছিল না কারও। এরপর সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ড ও ফাইনালে কেনিয়াকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কৃতিত্ব দেখালেন আকরাম খান ও তার সহযোদ্ধারা। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ছাড়পত্র আদায় করে নিলো বাংলাদেশ।
বিশ্বকাপে প্রথম জয়ঃ মিনহাজুল আবেদিন নান্নু ৬৮* প্রতিপক্ষ: স্কটল্যান্ড ( ১৯৯৯)
একদিকে বিরুদ্ধ ইংলিশ কন্ডিশন। অন্যদিকে নিন্দুকদের বাঁকা কথা। বিশ্বকাপের প্রথম দুটো ম্যাচে নিউজিল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে যাচ্ছেতাইভাবে হারলো বাংলাদেশ। বিশ্বকাপের পরিবেশ দূষণ করছে বাংলাদেশ- জোরেশোরেই উঠতে শুরু করলো এমন কথা। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ হারবে এমন বিশেষজ্ঞ মত দেয়ার মানুষেরও অভাব হলো না। এই পরিস্থিতিতে স্কটল্যান্ডকে হারানোটা টাইগারদের জন্য হয়ে উঠলো সময়ের দাবি। মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর ব্যাটে সেই দাবি পূরণ করলো বাংলাদেশ। এডিনবার্গে স্বাগতিক স্কটিশদের বিপক্ষে টসে হেরে আগে ব্যাট করতে নেমে মিনহাজুলের দৃঢ়তায় ৯ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়ালো ১৮৫। ম্যাচে একটা পর্যায়ে মাত্র ২৬ রানে ৫ উইকেট খুঁইয়ে বসে টাইগাররা। এমন খাদের কিনার থেকে নাইমুর রহমান দুর্জয়কে (৩৬) সঙ্গে নিয়ে দলকে টেনে তুললেন মিনহাজুল। ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে যোগ হলো ৬৯ রান। মিনহাজুল অপরাজিত থাকলেন ৬৮ রানে। এই রান ভালোভাবেই রক্ষা করলেন বোলাররা। ২২ রানে জিতলো বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বকাপে প্রথম জয়ের স্বাদ পেলো বাংলাদেশ। আর এই জয় বাড়িয়ে দিলো বাঘের ক্ষুধা।
বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকে বার্তা দিলো বাংলাদেশঃ খালেদ মাহমুদ সুজন (২৭, ৩/৩১)
বিশ্ব ক্রিকেটে জায়গা করে নিতেই এসেছে- এই ম্যাচের মধ্য দিয়ে যেন সেই বার্তা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ৩১শে মে, ১৯৯৯। বাংলাদেশ ক্রিকেটে সোনার অক্ষরে লেখা একটি তারিখ। গ্রুপপর্বে এটা ছিল বাংলাদেশের শেষ ম্যাচ। নর্দাম্পটনে টাইগারদের প্রতিপক্ষ ১৯৯২-এর বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তান। ম্যাচে টসে হেরে আগে ব্যাট করতে নেমে আকরাম খান (৪২) ও খালেদ মাহমুদ সুজনের (২৭) দৃঢ়তায় ৭ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে জমা পড়লো ২২৩ রান। জবাবে মাত্র ১৬১ রানে গুড়িয়ে গেল পাকিস্তান। ৬২ রানের জয় তুলে নিলো বাংলাদেশ। ১০ ওভারে মাত্র ৩১ রান খরচায় ৩ উইকেট শিকার করলেন খালেদ মাহমুদ। বাংলাদেশ ক্রিকেটে এটি জয়ের চেয়েও বেশি কিছু। এই জয়ে এক লাফে অনেকগুলো ধাপ পেরুলো টাইগাররা। বাংলাদেশকে হিসেবের মধ্যে নিতে বাধ্য হলো ক্রিকেট বিশ্ব। ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ জায়গা করে নিলো সেরা আটে।
মোহাম্মদ আশরাফুল ১০০, প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া (২০০৫): দুনিয়া কাঁপানো কার্ডিফ
এর আগে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়ের সঙ্গে টেস্ট সিরিজও জিতেছে বাংলাদেশ। সমৃদ্ধ হয়েছে ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলি। ওয়ানডে ম্যাচে জয়ও এসেছে বেশ কিছু। জিম্বাবুয়ে ছাড়াও দেশের মাটিতে ওয়ানডে ম্যাচে ভারতকে হারানোর কৃতিত্ব দেখিয়েছে টাইগাররা। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট যে সঠিক পথেই আছে প্রমাণ করার জন্য এগুলো যথেষ্ট ছিল না। বিশ্ব ক্রিকেটে খুব বড় একটা ঝাকি দেয়াটা প্রয়োজন হয়ে পড়ে বাংলাদেশের জন্য। আশরাফুলের ব্যাটে সেই বড় ঝাকিটাই টাইগাররা দিলো কার্ডিফে। তারিখটা ১৮ই জুন, ২০০৫। শুধু বিশ্বসেরা নয়, অস্ট্রেলিয়া তখন ক্রিকেটকে বানিয়ে ফেলেছে ইচ্ছাপূরণের খেলায়। ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে সফল দলের রেকর্ডও তাদের নামের পাশে। এরকম একটা সময়ে তিন দেশীয় ন্যাটওয়েস্ট সিরিজে কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে ভয়ঙ্কর প্রতাপশালী অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হলো বাংলাদেশ। ম্যাচে টস জিতে আগে ব্যাট করতে নেমে ২৪৯ রানের যথেষ্ট সমৃদ্ধ স্কোর গড়লো আগের দুবারের বিশ্বজয়ীরা। গ্লেন ম্যাকগ্রা, জেসন গিলেস্পিদের ছোবল সামলে বাংলাদেশ ২৫০ রানের টার্গেট স্পর্শ করবে- এমন ভাবনাটাও ছিল ঔদ্ধত্যের সামিল। কিন্তু এই বেয়াড়া ভাবনাটা ভেবেছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। চার নম্বরে খেলতে নেমে মাত্র ১০১ বলের মারাদাঙ্গা ইনিংস খেলে করলেন সেঞ্চুরি। যতক্ষণে আশরাফুল আউট হলেন ততক্ষণে জয় হাতের মুঠোয় চলে এসেছে বাংলাদেশের। ৪ বল হাতে রেখে ৫ উইকেটের জয় তুলে নিলো বাংলাদেশ। ক্রিকেট বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত হয়ে উঠলো বাংলদেশের এই জয়। উইজডেন সাময়িকীর সম্পাদকীয়তে এই জয় নিয়ে লেখা হলো- এরপর বাংলাদেশ ক্রিকেট উন্নতি করেনি এমন প্রশ্ন করার আর কোনো সুযোগ নেই।
মাশরাফি ৪/৩৫ প্রতিপক্ষ: ভারত (২০০৭): বিশ্বকাপ থেকে ভারতের বিদায় ঘণ্টা
একটু বিরতি দিয়ে হলেও বড় দলগুলোর বিপক্ষে জিততে শুরু করলো বাংলাদেশ। কমতে শুরু করলো টাইগারদের এক জয় থেকে আরেক জয়ের গ্যাপ। তবে বড় আসরে বড় দলগুলোর জন্য হুমকি তখনও হয়ে ওঠেনি বাংলাদেশ। ২০০৭ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে বড়দের সঙ্গে পার্থক্য ঘুচালো টাইগাররা। এই বিশ্বকাপে ‘বি’ গ্রুপে বাংলাদেশের সঙ্গী ছিল উপমহাদেশের ক্রিকেটের দুই পরাশক্তি ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বারমুডা। এই বিশ্বকাপে অংশ নেয়ার আগে মাশরাফি বিন মুর্তজা ভারতকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন- ধরে দেবানি।
ত্রিনিদাদের পোর্ট অব স্পেনে ভারতের মুখোমুখি হলো টাইগাররা। মাশরাফির আগুনঝরা বোলিংয়ে ১৯১ রানে শেষ হলো ভারতের ইনিংস। এই সুযোগ আর হাতছাড়া করেনি ব্যাটসম্যানরা। তামিম ইকবাল (৫১), মুশফিকুর রহিম (৫৬) ও সাকিব আল হাসানের (৫৩) দৃঢ়তায় কাঙ্ক্ষিত জয়ের বন্দরে নোঙর করলো বাংলাদেশ। ৯ বল হাতে রেখেই ৫ উইকেটের জয়। এই হারের ধাক্কা আর সামলে উঠতে পারেনি ভারত। বিদায় নিলো গ্রুপপর্ব থেকেই। আর বাংলাদেশ জায়গা করে নিলো সেরা আটে।
আশরাফুল ৮৭, প্রতিপক্ষ: দক্ষিণ আফ্রিকা (২০০৭): নতুন উচ্চতায় বাংলাদেশ
ভারতের বিদায় ঘণ্টার মধ্য দিয়েই মিশন শেষ করেনি বাংলাদেশ। উপমহাদেশের বাইরের প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলোর বিপক্ষে অন্তত বিশ্বকাপে বলার মতো সাফল্য ছিল না টাইগারদের। শক্তির বিচারে ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার পরের নাম দক্ষিণ আফ্রিকা। সাধারণত অঘটন দেখা যায় গ্রুপ পর্বেই। সুপার এইট কিংবা এই ধরনের পর্বে স্বমূর্তি ধারণ করে বড় দলগুলো। স্বাভাবিক কারণেই ওপরের রাউন্ড কিংবা পর্বে সর্বোচ্চ সাফল্য পাওয়াটা অনেক কঠিন। তবে আশরাফুলের ব্যাটে সম্ভব হলো সেই কঠিন কাজটাই। গায়ানার প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামে টস জিতে আগে ব্যাট করতে নেমে আশরাফুলের বিস্ফোরক ব্যাটিংয়ে ৮ উইকেট হারিয়ে ২৫১ রান সংগ্রহ করলো বাংলাদেশ। আশরাফুলের ৮৭ রান এলো মাত্র ৮৩ বলের কনকর্ডে চড়ে। জবাবে ১৮৪ রানে শেষ হয়ে গেল দক্ষিণ আফ্রিকার ইনিংস। ৬৭ রানে জিতলো বাংলাদেশ।
এই বিশ্বকাপে সেরা আটের লড়াইয়ে চমক দেখানো আয়ারল্যান্ডের কাছে ৭৪ রানে হারে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যে কতটা পিচ্ছিল সেই অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল টাইগারদের।
সাকিব আল হাসান (২১৩ রান, ১১ উইকেট), প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড (২০১০) : বাংলা ধোলাই
ওই সময় পর্যন্ত দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে ওঠা জিম্বাবুয়ে আর অপেক্ষাকৃত দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ জয়, এর বাইরে প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর বিপক্ষে কোনো দ্বিপক্ষীয় সিরিজ জেতেনি বাংলাদেশ। সাকিব আল হাসানের অলরাউন্ড পারফরমেন্সে সেই আক্ষেপ ঘুচলো এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের। পাঁচ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে নিউজিল্যান্ডকে ৪-০ ব্যবধানে হারালো বাংলাদেশ। সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয় বৃষ্টিতে। শেষ ম্যাচটি জেতার সময় বাংলাদেশের ধারাভাষ্যকার আতাহার আলী খান বললেন, বাংলা ওয়াশ। সাকিবের দুর্দান্ত নৈপুণ্যে প্রতিরোধহীন অবস্থায় আত্মসমর্পণ করা কিউইরা সিরিজ শেষ করলো বাংলা ধোলাইয়ের লজ্জা নিয়ে।
নিয়মিত অধিনায়ক মাশরাফি এই সিরিজের প্রথম ম্যাচেই ইনজুরি আক্রান্ত হয়ে মাঠ ছাড়লে অধিনায়কত্বের গুরুদায়িত্ব বর্তায় সাকিবের ওপর। মজাটা হচ্ছে, ওই সিরিজের আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তো বটেই ঘরোয়া ক্রিকেটেও কখনো নেতৃত্ব দেননি সাকিব। কিন্তু কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি এই অলরাউন্ডারের। সিরিজে সর্বোচ্চ রান (২১৩) ও সর্বোচ্চ উইকেট (১১) সকিবের। সঙ্গে ধারালো নেতৃত্ব। ওই সময় কিউই অধিনায়ক ড্যানিয়েল ভেট্টোরি আর সাকিবের মধ্যে কে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার এ নিয়ে একটা আলোচনা ছিল ক্রিকেট বিশ্বে। সিরিজ চলাকালীন এক সংবাদ সম্মেলনে সাকিবের শ্রেষ্ঠত্ব নিজ মুখেই স্বীকার করলেন ভেট্টোরি।
হোয়াইট ওয়াশ হওয়ার পর কান্নাকাটি পড়ে গেল নিউজিল্যান্ডে। এই সিরিজ হারকে তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় লজ্জা হিসেবে উল্লেখ করল সে দেশের মিডিয়া ও সাবেকরা। বাংলাদেশের সামনে পড়ে বড় দলগুলোর এমন আর্তনাদ এখন প্রায় নিয়মিতই।
মাহমুদউল্লাহর ১০৩ ও রুবেলের আঘাত, প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড (২০১৫): কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলাদেশ
২০০৭ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো সেরা আটে জায়গা করে নেয় টাইগাররা। ঘরের মাঠে ২০১১ বিশ্বকাপে তিন ল্যান্ডকে (ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস) হারালেও নক আউট পর্বে (কোয়ার্টার ফাইনালে) পৌঁছতে পারেনি বাংলাদেশ। গত বিশ্বকাপে সেই কৃতিত্ব দেখায় টাইগাররা।
২০১৫ বিশ্বকাপে ‘এ’ গ্রুপে বাংলাদেশ ছাড়াও ছিল আরো ছয়টি দল। এর মধ্যে আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ড টেস্ট স্ট্যাটাস বর্জিত। তাই কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নেয়ার জন্য আফগান ও স্কটিশদের হারানোই যথেষ্ট ছিল না। ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা কিংবা অস্ট্রেলিয়া- এই চার দলের মধ্যে কমপক্ষে এক দলকে হারানোর বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়ে গেল টাইগাররা। এই বড় চালেঞ্জে ইংলিশদের বিশ্বকাপ স্বপ্ন চূর্ণ করে নক আউট পর্বের ছাড়পত্র আদায় করে নিলো বাংলাদেশ।
অ্যাডিলেড ওভালের এই ম্যাচে টস জিতে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের সেঞ্চুরিতে (১০৩) বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়াল ৭ উইকেটে ২৭৫। জবাবে প্রয়োজনের সঙ্গে তাল রেখেই এগুচ্ছিল ইংল্যান্ড। ৪৫.৪ ওভার শেষে তাদের স্কোরবোর্ডে উঠল ২৩৮/৬। ম্যাচ জিততে ২৬ বল থেকে তাদের প্রয়োজন ৩৮ রান। উইকেটে দুই ডেঞ্জারম্যান জস বাটলার ও ক্রিস ওকস। এরই মধ্যে সপ্তম উইকেট জুটিতে ৬০ বল থেকে ৭৫ রান তুলে নিয়েছেন দুজন। ম্যাচের পাল হেলে পড়েছে ইংল্যান্ডের দিকে। এ অবস্থায় বাটলারকে (৬৫) আউট করে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ করে দিলেন তাসকিন আহমেদ। কিন্তু নবম উইকেট জুটিতে ২২ রান সংগ্রহ করে ম্যাচটা নিজেদের দিকে নিয়ে গেলেন ওকস ও স্টুয়ার্ট ব্রড। ম্যাচ জিততে শেষ ১২ বলে ইংলিশদের দরকার মাত্র ১৬ রান। এরপরই রুবেল হোসেনের সেই জোড়া ড্রিম ডেলিভারি। ৪৯তম ওভারের প্রথম বলে দুর্দান্ত ইয়র্কারে ব্রডকে সরাসরি বোল্ড আউট করলেন রুবেল। এক বল বাদ দিয়ে তৃতীয় বলেই আবারো ইয়র্কারেই বোল্ড করলেন জেমস অ্যান্ডারসনকে। ১৫ রানে ম্যাচ জিতলো বাংলাদেশ। সেইসঙ্গে মসৃণ হয়ে গেল কোয়ার্টার ফাইনালের পথও।
মোস্তাফিজুর রহমান (১৩ উইকেট) প্রতিপক্ষ ভারত (২০১৫): কাটার মাস্টারে ভারত বধ
অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে সাফল্য পাওয়ার পর ২০১৫ সালে শুধু এগিয়েই গেছে বাংলাদেশ। দেশের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানকে হোয়াইট ওয়াশের লজ্জায় ডোবায় বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি সিরিজেও জিতেছে টাইগাররা। পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ ম্যাচে অভিষিক্ত হলেন মোস্তাফিজুর রহমান। দুর্দান্ত বোলিংও করলেন। কিন্তু ‘কাটার মাস্টার’ মোস্তাফিজ তখনও অচেনা। আসল মোস্তাফিজকে চিনলো ভারত।
মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারতকে কোনো সুযোগই দিলেন না মোস্তাফিজ। অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে ভারতকে হারিয়ে দিলেন ৭৯ রানে। দ্বিতীয় ম্যাচে তার শিকার ৬ উইকেট। বাংলাদেশের জয়ও ৬ উইকেটের ব্যবধানে। তৃতীয় ও শেষ ম্যাচ হাতে রেখেই সিরিজ জিতলো বাংলাদেশ। শেষ ম্যাচে সান্ত্বনাসূচক জয় পেলো ভারত। নিজের ওয়ানডে অভিষেক সিরিজে ১৩ উইকেট শিকার করলেন মোস্তাফিজ। উইকেট পিছু খরচ মোটে ১১.৫৪ রান।
এরপরই মোস্তাফিজেরর স্লোয়ার, কাটারে কাটা পড়লো দক্ষিণ আফ্রিকাও। ভারতের মতোই ওয়ানডে সিরিজে ১-২ ব্যবধানে হারলো প্রোটিয়ারা। আর মোস্তাফিজের স্লোয়ার, কাটার বাংলাদেশ ক্রিকেটকে উন্নীত করলো ভিন্ন এক মানদণ্ডে।
মেহেদী হাসান মিরাজ (৬/৮২ ও ৬/৮৭), প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড (২০১৬): পিছিয়ে পড়েও টেস্ট সিরিজ ড্র
ওয়ানডে ক্রিকেটে বড় দলগুলোর বিপক্ষে ম্যাচ তো বটেই বাংলাদেশের সিরিজ জয়ও প্রায় নিয়মিত। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ যেন অন্য আরেকটি দল। হারার জন্যই যেন টেস্ট খেলতে নামে টাইগাররা। গত বছর সফরকারী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে নতুন চেহারায় আবির্ভূত হলো বাংলাদেশ। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ চট্টগ্রাম টেস্টে ২২ রানে হারলো মুশফিক বাহিনী। সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার মানসিক ধাক্কা দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে টাইগাররা কাটিয়ে উঠতে পারবে কি-না এ নিয়ে সংশয়ে অনেকেই। কিন্তু সব অনিশ্চয়তা দূর করে দিলেন তরুণ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শততম টেস্ট জয়ঃ তামিম (৪৯, ৮২) সকিব (১১৬,১৫ ও ২/৩৩, ৪/৭৪), প্রতিপক্ষ শ্রীলঙ্কা (২০১৭): শততম টেস্টে জয়
এ বছরের মার্চ মাসে শ্রীলঙ্কা সফরে প্রথম টেস্টে হেরে দুই টেস্ট সিরিজে ০-১ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে বাংলাদেশ। এ অবস্থায় নিজেদের শততম টেস্টে টাইগাররা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি-না এ নিয়ে সংশয়ে ছিলেন অনেকেই। মাঠে নেমেই সব শঙ্কা দূর করে দিলো টাইগাররা। কলম্বোর পি সারা ওভালে প্রথম দিন থেকে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে বাংলাদেশ জিতলো ৪ উইকেটের ব্যবধানে।

No comments

Powered by Blogger.