দিনাজপুরে অদ্ভুত ‘বৃষ্টিগাছ’! by বিপুল সরকার সানি

দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ধর্মপুর শালবনের ভেতর এক অদ্ভুত গাছের সন্ধান মিলেছে। বিশেষ এই গাছ থেকে বৃষ্টির মতো ঝিরঝির আকারে পানি ঝরে পড়ছে সব সময়। গাছের নতুন কাণ্ডের বাকলের ফাটা অংশ দিয়ে এভাবে পানি বের হওয়াকে অস্বাভাবিক বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এখন পর্যন্ত এই ধরনের গাছ নিয়ে কোনও গবেষণা হয়নি বলেও মত তাদের। এদিকে ‘বৃষ্টিগাছ’ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা, সৃষ্টি হচ্ছে নানা গল্প।
দিনাজপুরের বিরল উপজেলার ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা ধুলাপাথার। উপজেলার কালিয়াগঞ্জ বাজার থেকে কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে গোবরার বিলের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার একটি গেছে বনের ভেতরে। এই এলাকার বনের প্রায় এক কিলোমিটার গভীরে বিশেষ বৃষ্টি গাছের সন্ধান মিলেছে। এমন চারটি গাছ রয়েছে সেখানে। গাছগুলো থেকে সবসময় ঝিরঝির করে পানি ঝরছে। অবাক করে দেওয়ার মতো এমন ঘটনা দেখতে অনেকেই সেখানে ভিড় জমাচ্ছেন।
স্থানীয় আদিবাসী গোদাবাড়ী এলাকার রমজান পাহান (৩৬) বলেন, 'জঙ্গলে গাছটি দেখেছি। ধর্মপুর শালবনের ধুলাপাথারের গাছটির নিচে গেলেই পানি পড়ে। বৃষ্টির ফোঁটার মতো পানি গাছের নিচে পুরো স্থান জুড়ে পড়ে।'
আরেক আদিবাসী ধর্মজল এলাকার সুখি টুডু (৫০) বলেন, গাছটিকে আমরা ‘শেখরেদারে’ বলে ডাকি। গাছটি থেকে পানি পড়ে তা দেখেছি। এটা অবাক করার মতো।
বিশেষ ধরনের এই বৃষ্টিগাছ প্রস্থে প্রায় ৪ ফুট এবং লম্বায় ১২ ফুটের মতো। অনেকটা ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এর পাতা গোলাকার।
এরই মধ্যে অদ্ভুত গাছটির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দিনাজপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের একটি দল। তারা গাছ পরিদর্শন করে তথ্য-উপাত্ত, ডাল, পাতাসহ বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেছেন। পানি পড়ার বিষয়টিকে গাছের প্রস্বেদন প্রক্রিয়া বলে ধারণা করছেন গবেষকরা। তবে এত দ্রুতগতিতে পানি বের হওয়াকে অস্বাভাবিক বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দলের সদস্য দিনাজপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের এমএসসির শিক্ষার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, 'গাছটির কচি কাণ্ড এবং পুরাতন কাণ্ডের সংযোগে বাকল ফেটে নতুন কুঁড়ি বের হওয়ার স্থান থেকে পানি বেরিয়ে ঝির ঝির করে ঝরছে। বিষয়টি আশ্চর্যের! উদ্ভিদ থেকে পানি এভাবে ঝরার বিষয়টি নতুন বলেই মনে হয়েছে।'
মোসাদ্দেক হোসেন আরও জানান, ওই বনে আরও বেশকিছু এই একই প্রজাতির গাছ রয়েছে এবং প্রতিটি থেকেই পানি ঝরার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা। গাছটির গবেষণা করে পরিচিতি এবং যাবতীয় বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের জানানোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
সরেজমিন গাছটি পর্যবেক্ষণ করেছেন উদ্ভিদ বিষয়ক গবেষক, লেখক ও দিনাজপুর সরকারি কলেজের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, 'বনের ভেতরে থাকা চারটি গাছের সন্ধান মিলেছে। এগুলোর তথ্য-উপাত্ত, গাছের ডাল, পাতা, বাকল ও নমুনা সংগ্রহ করেছি। এরপর কলেজের ল্যাবে এনে তা পরীক্ষার পাশাপাশি গবেষণার প্রতিবেদনগুলোও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।'
তবে এই ধরনের গাছ নিয়ে আগে কোনও গবেষণা হয়নি বলে জানান তিনি। একইসঙ্গে গাছ থেকে বেগ কিংবা চাপে নির্দিষ্ট সময় পর পর এভাবে পানি বের হওয়াকেও অস্বাভাবিক বলে ধারণা তার।
অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন জানান, বর্ষাকালে অনেক গাছই অতিরিক্ত পানি শোষণ করে। এই গাছটিও বেশি পরিমাণে পানি শোষণ করেছে। পুরাতন কাণ্ড ভেদ করে নতুন কাণ্ড বা নতুন কুঁড়ি বের হওয়ার জায়গায় গাছটির ভাস্কুলার বান্ডেল তথা পরিবহন কলাগুলো বেরিয়ে পড়েছে। ফলে উদ্ভিদের মূল থেকে আরোহিত পানি কাণ্ডের ওই অংশ থেকে বিন্দু বিন্দু আকারে ঝরে পড়ছে। অতিরিক্ত পানির চাপ থাকায় ভাস্কুলার বান্ডেল তথা পরিবহন কলা কাণ্ডের ছিদ্র দিয়ে পানি বাইরে সজোরে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভ্যাপার বা বাষ্পায়ন না ঘটার ফলে গাছের নিচে কেউ গেলে বৃষ্টির মতো ঝরা পানি অনুভব করছে এমনটি হতে পারে। তবে এই গাছ থেকে বেগ বা চাপ দিয়ে স্প্রে করার মতো যে পানি বের হচ্ছে তা অস্বাভাবিক।
তিনি বলেন, 'এখন পর্যন্ত এ ধরনের গাছ নিয়ে গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। গাছটির পরিচিতি জানতে এবং অধিকতর গবেষণার জন্য এর নমুনা উন্নত গবেষণাগারে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।'

No comments

Powered by Blogger.