ক্ষমা চাইলেন এ কে খন্দকার

মানবজমিন, ২ জুন ২০১৯, রবিবার: ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’ বইটিতে ‘জয় বাংলা’র পাশে ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দ ব্যবহার করায় দুঃখ প্রকাশ করে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বীর উত্তম। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের বইয়ের বিষয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, আমার লেখা বই ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’ ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে প্রথমা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। বইটির ৩২ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লিখিত বিশেষ অংশ ও বইয়ের আরও কিছু অংশের প্রতি সারা দেশে প্রতিবাদ ওঠে। সেখানে লেখা ছিল ‘বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণেই যে মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তা আমি মনে করি না।
এই ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’। তিনি যুদ্ধের ডাক দিয়ে বললেন ‘জয় পাকিস্তান’! এ কে খন্দকার জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেন, এই অংশটুকুর জন্য দেশপ্রেমিক অনেকেই কষ্ট পেয়েছেন বলে আমি বিশ্বাস করি। এই তথ্যটুকু যেভাবেই আমার বইতে আসুক না কেন, এই অসত্য তথ্যের দায়ভার আমার এবং বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে কখনোই ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দ দুটি বলেননি। তাই আমার বইয়ের ৩২ নম্বর পৃষ্ঠার উল্লিখিত বিশেষ অংশ সম্বলিত পুরো অনুচ্ছেদটুকু প্রত্যাহার করে নিচ্ছি এবং একইসঙ্গে আমি জাতির কাছে ও বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।
তিনি বলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ  মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল।
৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর বাঙালী জাতি স্বাধীনতার মনোবল নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়েই আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, সামরিক বেসামরিক সর্বস্তরের পেশাজীবী, পুলিশ, বিডিআর, ছাত্র, কৃষক, সাধারণ জনগণ মাতৃভূমির স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সাড়ে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা পেয়েছিল বাঙালী জাতি। এই স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে বিশ্বে খ্যাতির শীর্ষে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে পরিচিত। তারই বুদ্ধিদীপ্ত নেতৃত্বে দেশ আজ যুদ্ধাপরাধী মুক্ত। জীবন সায়হ্নে দাঁড়িয়ে পড়া একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার প্রতি কৃতজ্ঞ। প্রথমা প্রকাশনীর কাছে বইয়ের ৩২ নম্বর পৃষ্ঠার বিতর্কিত অংশটুকু বাদ দিয়ে পুনর্মুদ্রণের দাবি জানিয়ে লেখক বলেন, আমার বয়স এখন ৯০ বছর। আমার সমগ্র জীবনে করা কোনো ভুলের মধ্যে এটিকে আমি একটি বড় ভুল বলে মনে করি। জীবনের গোধূলি বেলায় দাঁড়িয়ে পড়ন্ত সূর্যের মত আমি আজ বিবেকের তাড়নায় দহন হয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মার কাছে ও জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থী। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। আশা করি প্রথমা প্রকাশনী আমার বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠার বিতর্কিত অংশটুকু বাদ দিয়ে পুনর্মুদ্রণ করবে।
শ্রবন সমস্যার কারণে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে এ কে খন্দকার বীর উত্তম এর পক্ষে কথা বলেন তাঁর সহধর্মিনী ফরিদা খন্দকার। তিনি বলেন, এ বিষয়ে মতিউর রহমান সাহেবকে আমি বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম- আপনি কি বিষয়টি পড়ে দেখেননি? তিনি বলেছিলেন- আমি পড়ি না, আমাদের লোক থাকে। তারা লেখার গ্রামার এবং বানান দেখে। এছাড়া অন্য কোনও কিছু আমরা খেয়াল করি না।
ফরিদা খন্দকার বলেন, তারপরও আমি চেষ্টা করেছিলাম সংশোধনের। কিন্তু কিছু লোক আমাকে করতে দেয়নি। আমি কোনও ঝগড়াঝাটির মধ্যে যেতে চাই না। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে ফরিদা খন্দকার বলেন, ‘তাজউদ্দিন আহমেদের পিএস মঈদুল হাসান ও কাজী জাফর উল্লাহসহ আরও বেশ কিছু লোক এসেছিলেন। তারা বেশ কিছুদিন পাহারা দিয়ে রেখেছিলেন যেন সংশোধন করতে না পারি। মঈদুল হাসান বলেছিলেন, গুলি তো ছেড়ে দিয়েছো, এখন কি গুলির পিছে দৌড়াবা?’ এসময় সাংবাদিকরা এ কে খন্দকারের স্ত্রীর কাছে জানতে চান কাজী জাফর উল্লাহ বলতে আওয়ামী লীগের কাজী জাফর উল্লাহকে বুঝাচ্ছেন কিনা? এসময় তিনি বলেন, জাফরউল্লাহ। সাদা, লম্বা চুল, গোঁফ ওয়ালা জাফরউল্লাহ। এতদিন কেন বিষয়টি স্পষ্ট করেননি জানতে চাইলে ফরিদা খন্দকার বলেন, বইটি প্রকাশের পর কী যে যন্ত্রণা সহ্য করেছি, তা বলার মতো নয়। বইটি সংশোধন না করাতে পেরে উনি কিন্তু মানসিক রোগী হয়ে গেছেন। সিএমএইচে চিকিৎসা নিয়েছেন, এখনও নিচ্ছেন।
ফরিদা খন্দকারের অভিযোগের বিষয়ে প্রথমা প্রকাশনের ব্যবস্থাপক জাফর আহমেদ রাশেদ মানবজমিনকে বলেন, এ কে খন্দকার সাহেবের সংবাদ সম্মেলনের লিখিত বক্তব্যের বাইরে সেখানে যা বলেছে সে বিষয়ে আমি কিছু জানি না। সুতরাং ওই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। তথ্য সংশোধনের বিষয়ে তিনি বলেন, বইটি প্রথম প্রকাশের পরপরই যখন বিতর্ক তৈরী হয় তখন আমরা লেখকের কাছে গিয়েছি। তার অবস্থান ব্যাখ্যা করতে বলেছি। তিনি একটি মাত্র সংশোধনী দিয়েছেন-সেখানে তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণ শেষ করেছেন ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান বলে’। এখন উনি সংবাদ সম্মেলন করে বলছেন, এই তথ্যের জন্য মানুষ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি তথ্যগুলো প্রত্যাহার করে নিতে চান। সেক্ষেত্রে প্রথমা প্রকাশনের বক্তব্য হল- বইটির লেখক এ কে খন্দকার। তার বইয়ের যে কোনো তথ্য যদি তিনি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন তার প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। কারণ বইটি তার, আমাদের না।

No comments

Powered by Blogger.