ভারতের নির্বাচনে কু-কথার রাজনীতি by পরিতোষ পাল

ভারতে নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে ছোট-বড় সব রাজনৈতিক নেতা কু-কথার বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। নির্বাচনের শেষ লগ্নে এসে শুরু হয়েছে কু-কথার রাজনীতি। শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে চলছে আক্রমণ। কে কাকে কত ধরনের কু-কথা বলেছেন তা নিয়ে জনতার দরবারে হাজির হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে কংগ্রেস সহ বিরোধী নেতারা। তবে প্রধানমন্ত্রী মোদি যেভাবে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল  গান্ধীকে আক্রমণ করতে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে নিয়ে একের পর এক আক্রমণ করে চলেছেন তাকে অনেকেই নীতিহীন কাজ বলেছেন।
সর্বশেষ মোদি বলেছেন রাজীব নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে পারিবারিক ভ্রমণে গিয়েছিলেন। অবশ্য কংগ্রেসও মোদিকে পাল্টা বলেছেন, মোদি ভারতীয়  যুদ্ধবিমানকে নিজের ট্যাক্সির মতো ব্যবহার করছেন। মাত্র ৭৪৪ রুপি ভাড়াও দিয়েছেন একটি সফরের জন্য।
এর আগেই মোদি আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত রাজীব গান্ধীকে ভ্রষ্টাচারী নম্বর ওয়ান বলেছিলেন। বিরোধী নির্বাচনে পরাজয় জেনেই মোদি এখন জনসভায় দাঁড়িয়ে অনুযোগ করছেন, তাকে কত রকমের কু-কথা বলা হয়েছে। অথচ এই মোদিই আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত একটি মানুষকে নিয়ে টানাটানি করেছেন, তাঁর স্ত্রীকে ‘বিধবা’ এবং ‘জার্সি গরু’ বলেছেন, তাঁর পুত্রকে বলেছেন ‘হাইব্রিড বাছুর’।
অথচ গত বুধবার কুরুক্ষেত্রে এক জনসভা থেকে অনুযোগ করেছেন, তাঁকে নর্দমার কীট, পাগল কুকুর, ভস্মাসুর, দাউদ ইব্রাহিম, কি না বলা হয়েছে। আমাকে যখন ওঁরা এই কথাগুলো বলেন, তখন তো কেউ কোনো শব্দ করে না। গত বুধবারই পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় এসে কংগ্রেস সভাপতি বলেছিলেন, আমরা ভালোবাসা দিয়েই ওঁকে হারাতে যাচ্ছি। আর তার জের টেনে মোদি বলেছেন, সত্যের ভূমি কুরুক্ষেত্রে যখন এসেছি, তখন শুনে নিন ওঁদের ভালোবাসার অভিধানে কী কী শব্দ আছে। আমাকে বলা হয়েছে ‘সব চেয়ে নির্বোধ প্রধানমন্ত্রী’, ‘জওয়ানদের রক্তের দালাল’।... কংগ্রেসের এক নেতা আমাকে নর্দমার কীট বলেছিলেন, একজন বলেছিলেন পাগল কুকুর, এক প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাঁদরও বলেছিলেন। মোদি অভিযোগ করেছেন, কু-কথা থেকে রেহাই পাননি তাঁর মা-ও। ওঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, আমার বাবা কে? মনে রাখবেন, এ সবই বলা হয়েছে একজন প্রধানমন্ত্রীকে।
আমাকে টুকরো টুকরো করবে বলেছে, এমন লোককেও টিকিট দিয়েছে কংগ্রেস। গত বুধবার পশ্চিমবঙ্গে এসে অমিত শাহ দাবি করেছিলেন, মোদিকে আলাদা আলাদা ৫১টি কটূক্তি করেছে কংগ্রেস। সেই তালিকায় সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ‘ঔরঙ্গজেব’ ও ‘জল্লাদ’। কংগ্রেস নেতা সঞ্জয় নিরুপম বলেছেন, ঔরঙ্গজেব কাশীতে মন্দির ভেঙেছিলেন, জিজিয়া কর বসিয়েছিলেন। মোদি ঔরঙ্গজেবের আধুনিক অবতার। আর বিহারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী রাবড়ী দেবী মোদিকে জল্লাদ বলে অভিহিত করে বলেছেন, উনি তো জল্লাদ, যিনি বিচারক আর সাংবাদিকদের হত্যা করান। এমন মানুষের মন আর আদর্শ তো ভয়ঙ্কর হবে। বিজেপি এবং জেডিইউ নেতাদের ‘নর্দমার কীট’ বলেছেন রাবড়ী। কু-কথার তালিকা থেকে দেখা গেছে, মোদিসহ বিজেপি নেতারা শেষ বেলায় এসে অনুযোগ করলেও তারা কম নজির তৈরি করেন নি। ভারতে আসা অভিবাসীদের উইপোকা বলেও অভিহিত করেছেন বিজেপি নেতারা। কংগ্রেসকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করতে গিয়ে কখনও বলা হয়েছে কংগ্রেস ঘেউঘেউ করে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মতো নিরীহ মানুষকে নৈশপ্রহরী বা দেহাতি আওরাত বলে আত্রমণ করা হয়েছে। আর রাহুল গান্ধীকে তো ভাঁড় রাজপুত্র, শাহজাদা, নামদার, পাপ্পু, হাইব্রিড বাছুর এই রকম নানা অভিধা দেয়া হয়েছে বিজেপি নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। অন্যদিকে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী প্রথম থেকেই মোদির বিরুদ্ধে চৌকিদার চোর হ্যায় স্লোগান তুলেছেন। মোদি নিজেকে চৌকিদার হিসেবে হাজির করার পাল্টা হিসেবেই দুর্নীতিকে তুলে ধরতেই কংগ্রেস এই স্লোগান তুলে নির্বাচনী প্রচার চালিয়েছে। অবশ্য মোদিকে মৃত্যুর সওদাগর (গুজরাট দাঙ্গার জন্য), নিষ্কর্মা, গাধা, সাপ, কাঁকড়াবিছে, পুরুষত্বহীন, অশিক্ষিত, নির্বোধ প্রধানমন্ত্রী, দুর্যোধন, হিটলার, মুসোলিনি, পাগল কুকুর এমনি নানা অভিধায় ভূসিত করেছে বিরোধীরা।
তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো ঠাঠিয়ে গণতন্ত্রের থাপ্পড় কশানোর ইচ্ছে প্রকাশ করে জোর শোরগোল তুলেছেন। এখন পর্যন্ত নির্বাচনী পর্বে যেভাবে সীমাহীন ভাবে পরস্পরের প্রতি আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ চলেছে অতীতে কোনো নির্বাচনে তা এমন সীমাহীন মাত্রা পায় নি বলে পর্যবেক্ষদের অভিমত। তবে শেষবেলায় এসে মোদিসহ বিজেপি নেতারা যেভাবে অনুযোগ করছেন প্রকাশ্য জনসভায় তার মধ্যে মেরূকরণের রাজনীতির গন্ধ পাচ্ছেন বিরোধীরা। কংগ্রেস নেতাদের একাংশের দাবি, মোদি নিজেও চান তাঁকে কটূক্তি করা হোক। গুজরাট দাঙ্গার পরে সনিয়া গান্ধী তাঁকে ‘মওত কা সওদাগর’ বলেছিলেন। সেই মন্তব্য অস্ত্র করে ভোটে গিয়ে মেরূকরণের ব্যাপক ফায়দা তুলেছিলেন মোদি। গুজরাটের গত বিধানসভা ভোটের আগে কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার মোদিকে ‘নীচ’ বলেছিলেন। সেখানেও সহানুভূতি কুড়িয়েছিলেন মোদি। জোর ধাক্কা খেয়েও বিধানসভা ধরে রেখেছিল বিজেপি। এবারেও নির্বাচনে শেষ পর্যায়ে এসে সেই মেরূকরণের মাধ্যমে সহানুভূতি জোগাড়ের জন্য মোদি প্রকাশ্যে কু-কথা নিয়ে সরব হয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.