ইলহান ওমর ও ইহুদি বিদ্বেষের অস্ত্র by মিসবাহুল হক

গত বছরের শেষের দিকে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে প্রথম মুসলিম নারী কংগ্রেস সদস্য হিসেবে কোরআন শরীফের ওপর হাত রেখে শপথ নিয়ে ইতিহাস গড়েন ইলহান ওমর। বিপুল সংখ্যক নারীর অংশগ্রহণ ও অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দু’জন মুসলিম নারী শপথ নেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রতিনিধি পরিষদ বৈচিত্রময় রূপ নিয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হয়েছে নানা সমালোচনা ও ষড়যন্ত্র। ‘ইহুদি-বিদ্বেষের’ অস্ত্রে ঘায়েল হতে চলেছেন ইলহান ওমর। ইসরায়েল বিরোধী মন্তব্য করে এখন মার্কিন রাজনীতিতে বিপাকে রয়েছেন তিনি। বিশ্লেষকরা বলছেন- বক্তব্য না, বরং ব্যক্তি ইলহান ওমরই সমালোচকদের প্রধান টার্গেট। তারা ইহুদি-বিদ্বেষের অভিযোগকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে এমন একজন কংগ্রেস সদস্যের পতন ঘটানোর চেষ্টা করছেন, যিনি প্রতিনিধি পরিষদে ইসলামী বিধান অনুসারে হিজাব পরে মানুষের নজর কেড়েছেন।
যিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে, বিশেষ করে ইসরাইল ইস্যুতে স্পর্শকাতর সব তথ্য অকপটে প্রকাশ করেন।
সাম্প্রতিক সমালোচনা ও নিন্দার মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের ক্ষোভেরই বহিপ্রকাশ ঘটেছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের শুরু একটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে ইলহানের দেয়া বক্তব্যকে ঘিরে। সেখানে ইলহান বলেন, আমেরিকানদের মধ্যে বিদেশী আনুগত্য করার প্রবণতা রয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী ইহুদি লবির প্রতি ইঙ্গিত করেন।  এর আগেও ইলহান ইহুদিদের নিয়ে তীর্যক মন্তব্য করেছেন। গত মাসে তিনি টুইটারে দেয়া এক বার্তায় দাবি করেন, ইসরাইলের প্রতি মার্কিন আইন প্রণেতাদের অব্যাহত সমর্থনের মূল চালিকা শক্তি হলো ইহুদিবাদী লবিদের দান করা মোটা অংকের অর্থ। তিনি বুঝিয়েছেন, ইহুদি লবি আমেরিকান-ইসরাইল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (এআইপিসি) কাছ থেকে বিপুল অর্থ পাওয়ার কারনেই মার্কিন আইন প্রণেতারা অব্যাহতভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করে। প্রসঙ্গত, এআইপিসি নামক সংগঠনটি যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের স্বার্থ দেখভাল করে।
ইলহান ওমরের এই বক্তব্যে তোলপাড় শুরু হয় মার্কিন রাজনীতিতে। স্বয়ং প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পও ইলহানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ইহুদি-বিদ্বেষের নিন্দা জানিয়ে একটি রেজ্যুলেশন পাস করে প্রতিনিধি পরিষদ। তখন ইলহান ওমর ক্ষমা চাইলে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়। কিন্তু গত সপ্তাহে ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে করা মন্তব্যের কারণে তিনি আবারো আলোচনায় আসেন। ইলহান ওমর দাবি করেন, আমেরিকানদের মধ্যে ভিন্ন দেশের আনুগত্য করার প্রবণতা রয়েছে। তার এই বক্তব্যে মার্কিন ইহুদিরা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয় ইহুদিবাদী সংগঠন অ্যান্টি ডিফেমেশন লিগের ন্যাশনাল ডিরেক্টর জোনাথন গ্রিনব্ল্যাট প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসিকে একটি চিঠি লেখেন। এতে তিনি ইলহান ওমরের বিরুদ্ধে ইহুদি-বিদ্বেষের অভিযোগ করেন। ইলিয়ট এঞ্জেল ও নিতা লোয়ারিসহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী অনেক কংগ্রেস সদস্য ইলহানের সমালোচনায় সোচ্চার হন। তারা নিজের বক্তব্যের জন্য ইলাহনকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেন।
এমন পরিস্থিতিতে ইলহানের পাশে দাড়িয়েছেন আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিয়ো কর্টেজ সহ একাধিক প্রভাবশালী রাজনীতিক। তারা যুক্তি দেখান, ইলহান তার বক্তব্যে ইহুদি লবির কথা বলেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদিদের নিয়ে কিছু বলেন নি। কিন্তু পরিস্থিতি এতই জটিল রূপ নিয়েছে যে, নিজের দল ডেমোক্রেটিক পার্টিতেও সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে ইলহান ওমরকে। মূলত, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের প্রবল চাপের মুখে ডেমোক্রেটরা এটা করতে বাধ্য হয়েছেন।
সম্প্রতি ডেমোক্রেট নিয়ন্ত্রিত প্রতিনিধি পরিষদে ইহুদি-বিদ্বেষের সমালোচনা করে আরেকটি রেজ্যুলেশন তোলা হয়েছে। কার্যত ইলহান ওমরকে তিরস্কার করা এই রেজ্যুলেশনের উদ্দেশ্য। কিন্তু কিছু ডেমোক্রেট নেতা ওই রেজ্যুলেশনে ইহুদি-বিদ্বেষের পাশাপাশি মুসলিম-বিরোধী আক্রমণেরও সমালোচনা করার দাবি তুলেছেন। ডেমোক্রেট সদস্যদের বিরোধীতার কারণে উত্থাপিত ওই রেজ্যুলেশনের ওপর ভোটাভোটি পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন প্রতিনিধি পরিষদ রেজ্যুলেশনে এমন শব্দ অন্তর্ভুক্ত করার কথা ভাবছে, যাতে শুধু ইহুদি-বিদ্বেষ না বুঝিয়ে সাধারণভাবে ধর্মান্ধতা বা গোড়ামি বুঝায়।
মেরিল্যান্ডের ডেমোক্রেট প্রতিনিধি স্টেনি হোয়ার জানান, ওই রেজ্যুলেশনের ওপর ভোটাভোটির দিনক্ষণ এখনো নির্ধারিত হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা ভাষা নিয়ে কাজ করছি। আবারো বলছি, প্রত্যেক ডেমোক্রেটই এসব ‘ইজম’, বিদ্বেষ ও কুসংস্কারের বিরোধী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, প্রেসিডেন্ট নিয়মিত এগুলো উস্কে দেন।,  স্টেনি হোয়ার আরো বলেন- ‘এটা সুস্পষ্ট যে, ইসরাইল সবসময় রাষ্ট্র হিসেবে ছিল না। এটা নতুন কোন বিষয় না।’ ইলহান ওমরকে ইহুদি-বিদ্বেষী বলতেও নারাজ এই যুক্তরাষ্ট্রের এই কংগ্রেসম্যান।
তথাকথিত ইহুদি-বিদ্বেষী বক্তব্যের কারণে আফ্রিকান বংশোদ্ভুত আমেরিকান ইলহান ওমরের ওপর দিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে সমালোচনার ঝড় বইছে। ব্যাপক পরিসরে বলতে গেলে, ইলহান এখন মুসলিম-বিদ্বেষী আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন। এমনকি ৯/১১ হামলার সঙ্গেও তাকে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ার রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি অঞ্চলে ৯/১১ হামলার সঙ্গে ইলহানের যোগসূত্র দেখিয়ে পোস্টারও টানানো হয়েছে।
হামলার শিকার টুইন টাওয়ারের ওপর ইলহানের ছবি ছাপানো হয়েছে। ইলহানকে বলতে দেখা যাচ্ছে যে, ‘আমিই সেই প্রমাণ যা তোমরা ভুলে গেছো।’ যদিও পরে ওই পোস্টারটি সরিয়ে ফেলা হয়। এছাড়াও, প্রতিনিয়ত ইলহানকে মৃত্যুর হুমকি দেয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহে ইলহান ওমর নিজে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সম্প্রতি কয়েক জায়গায় ‘ইলহানকে হত্যা করো’ এমন লেখাও দেখা গেছে। কে বা কারা এসব কার্যক্রম চালাচ্ছে, তা উদঘাটনে তদন্ত শুরু করেছে এফবিআই।
অধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও কংগ্রেসের অব্যাহত সমালোচনার কারণে ইলহান ওমরসহ অন্য মুসলিমদের ওপর বিদ্বেষী হামলা বেড়ে গেছে। ইন্সটিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের ফেলো ফিলিস বেনিস  গত সপ্তাহে ওয়াশিংটন ডিসিতে ওই প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান, ইলহান ওমর ওই অনুষ্ঠানে সরাসরি ইহুদী-বিদ্বেষী কোন মন্তব্যই করেননি। তার ওপর যে আক্রমণ চালানো হচ্ছে, এজন্য তার বক্তব্যের চেয়ে ব্যক্তিত্ব বেশি দায়ী। এখন মানুষ তার পতন ঘটানোর চেষ্টা করছে।
মানবাধিকার কর্মী খালেদ বেইদুন মনে করেন, যদিও ইলহান মার্কিন কংগ্রেসের প্রথম মুসলিম সদস্য না, কিন্তু তার পরিধান করা হিজাব তাকে কংগ্রেসের সবচেয়ে আলোচিত মুসলিম ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে। এর কারণেই তার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছে। লাগানো হয়েছে ‘ইহুদি-বিদ্বেষের’ লেবেল। আল জাজিরাকে খালেদ বেইদুন আরো বলেন, এখন ইসরাইল রাষ্ট্রের সমালোচনামূলক যে কোন বিষয়কে ইহুদি-বিদ্বেষের রূপ দেয়া হচ্ছে। চলমান নিন্দা ও সমালোচনার বিষয়ে ইলহান ওমরও অভিন্ন যুক্তি দেখিয়েছেন। তিনি বলেন- ‘আমি ও রাশিদা তিলাইব ( বর্তমান কংগ্রেসের আরেক মুসলিম নারী সদস্য) মুসলিম হওয়ার কারণে অনেক ইহুদী সহকর্মী, অনেক সমর্থক ও মিত্র চিন্তা করেন যে, আমরা যা-ই বলি তা ইহুদি-বিদ্বেষী। কেননা আমরা মুসলিম।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে এটা সুস্পষ্ট যে, ইহুদি-বিদ্বেষকে এখন অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে ঘায়েল করার জন্য এই অস্ত্র সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করছে রিপাবলিকানরা। তাহলে ইলহান ওমর কি ইহুদি-বিদ্বেষের অস্ত্রেই ঘায়েল হবেন? এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতই বলে দেবে।

No comments

Powered by Blogger.