আগের রাতে ব্যালট ভর্তি বন্ধে ইভিএম চান সিইসি: প্রতিক্রিয়া বিশিষ্টজনদের

বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা গতকাল (শুক্রবার) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় মন্তব্য করেছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্সে ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না।
তার আগে গত বুধবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সামনে রেখে সুনামগঞ্জে বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভায় প্রধান অতিথি হয়ে নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আমি পরিষ্কারভাবে জানাতে চাই, নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরা কিংবা ভোটের দিন, ভোটের পর গণনার সময় কোনো অনিয়ম মেনে নেওয়া হবে না।’
নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরা প্রসঙ্গে খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং একজন দায়িত্বশীল কমিশনারের মন্তব্যের কারণে অনেকে কৌতুকবোধ করলেও বিরোধী রাজনৈতিক দল ও বিশ্লেষকেরা বলছেন- নির্বাচন কমিশন প্রকারান্তরে এ সংক্রান্ত অভিযোগ স্বীকার করেই নিয়েছেন।
বাংলাদেশে গত ৩০ ডিসেম্বর আনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন থেকেই নির্বাচনে আংশগ্রহণকারী দল বিএনপি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোট ও ইসলামী আন্দোলন আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার অভিযোগ করে আসছে। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের শরিক জাসদের (আম্বিয়া) পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রশাসনের একশ্রেণির অত্যুৎসাহী অংশ ভোটের আগের রাতেই ভুয়া ভোটের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখাসহ নানা অনিয়ম সংঘটিত করেছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পর্যবেক্ষণেও আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গত ২২ ফেব্রুয়ারি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম প্রসঙ্গে গণশুনানি করে। এ গণশুনানিতে ফ্রন্টের মনোনীত ধানের শীষ প্রায় সব প্রার্থীই অভিযোগ করেছেন, নির্বাচনের আগের রাতেই তাঁদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ভোটের বাক্স ভরে রাখা হয়।
ইতোমধ্যে জাতীয় নির্বাচনে ভোট কারচুপির অভিযোগ করে নির্বাচন বাতিলের দাবিতে হাইকোর্টের নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা ৭৪টি মামলা দায়ের করেছেন।
এছাড়া, আটটি বাম দলের সমন্বয়ে গঠিত বাম গণতান্ত্রিক জোট গত ১১ জানুয়ারি একাদশ সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে গণশুনানি করে। এতে জোটের ১৩১ জন প্রার্থীর অধিকাংশই প্রার্থীই, আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে রাখা, ভোটের দিন সরকারি দলের লোকজনের কেন্দ্র দখল, বিরোধী দলের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া- ইত্যাদি অভিযোগ করেছেন।
এ প্রসঙ্গে বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক রেডিও তেহরানকে বলেন, নির্বাচন কমিশন আগের রাতে ব্যালটবাক্স ভরে ফেলার বিষয়টি স্বীকার করার পর এখন তাদের উচিত হবে কোথায় কিভাবে কারা এ কাজটি করেছে তা চিহ্নিত করা এবং সকল ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করা। তাছাড়া অবিলম্বে এ অবৈধ সংসদ বাতিল করে নিরপেক্ষ সরকারের মাধ্যমে দ্রুত একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও দাবি করেন তিনি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন,  সিইসি তার বক্তব্যে ২৯ ডিসেম্বর রাতে ব্যালট বাক্স ভরে যে ভোট ডাকাতি হয়েছিল, তা স্বীকার করে নিলেন। তবে ইভিএম চালু করলেও তা করা হবে ডাকাতির উদ্দেশ্যে।
এছাড়া, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার প্রসঙ্গ টেনে সিইসি ও একজন কমিশনার যা বলেছেন, তাতে ধরে নিতে হবে যে এ সংক্রান্ত অভিযোগ সম্পর্কে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছেন। প্রকারান্তরে তাঁরা এটা স্বীকার করেও নিয়েছেন। এখন নির্বাচন কমিশনেরই উচিত একটি তদন্ত করে দেশবাসীকে জানানো যে, ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে কোন কোন কেন্দ্রে এরকম ঘটনা ঘটেছিল। 
এদিকে, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেছেন, গতকালের বক্তব্যের মাধ্যমে সিইসি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলেন যে আগের রাতে সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার ঘটনা ঘটেছে।
ইফতেখারুজ্জামানের মতে, ইভিএমে ভোট হলে এটা যে হবে না, তাও নির্ভর করছে ইসি ও ক্ষমতাসীন দলের ওপর। ইসি যদি তার ওপর দেওয়া সাংবিধানিক দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে পালন না করে, সরকারি দল যদি আন্তরিক না হয়, তাহলে ইভিএম কেন, যেকোনো পদ্ধতিতে ভোট হলে এর অপব্যবহারের সুযোগ থেকে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.