একজন বিজ্ঞানী সামাদের কথা by চার্লি মিশেল

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের আবদুস সামাদ অপর একজনকে তার জীবনের বন্ধু করেছিলেন। তার  নিকটতম প্রতিবেশী হলেন শাজু শাহজাহান। এই দুই বন্ধু প্রতিদিন একসঙ্গে ১৮ কিমি যাতায়াত করে স্কুলে যেতেন।
এর ফলে তারা কথা বলার অনেক সুযোগ পেয়েছেন। খেলার জন্য অনেক সময় দিয়েছেন তারা। স্কুলে পড়ার সময় তারা ক্লাসে একসঙ্গে বসেছেন। এবং বাড়ি ফিরে ঘরের কাছাকাছি মসজিদে তারা কোরআন পড়ছেন।
দীর্ঘ ১০ বছর ধরে তারা ছিলেন অবিচ্ছেদ্য। জীবন চলার পথ অবশ্য একসময় তাদের ভিন্ন দিকে নিয়ে যায়।
সামাদ ময়মনসিংহ বিশ্ববিদ্যালয়ে গৎ পশু বিজ্ঞান অধ্যয়ন করেছে; শাহজাহান কয়েক ঘণ্টা দূরে ঢাকায় প্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হন।
তদুপরি তারা ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেছিলেন। উভয়ই কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন।
সামাদ নিউজিল্যান্ডে পড়াশোনা করার জন্য একটি বৃত্তি পান।
তিনি লিঙ্কন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। তিনি নিউজিল্যান্ডকে ভালোবাসতেন। তাই তিনি অবসরে গিয়ে নিউজিল্যান্ডেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বাস্তবে যা তিনি ২০১২ সালে করেছিলেন।
শাহজাহান ওহাইওর ক্লিভল্যান্ডে চলে যান, যেখানে তিনি থাকেন।
শাহজাহান তার সেরা বন্ধু সামাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন গত কয়েক বছর হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের সময় পার্থক্য ছিল। আর সেটা তাদের জন্য অসুবিধাজনক মনে হতো। শাজাহান বলেন, ৬০ বছর আগের বন্ধুত্বের সুবাদে তারা একে অপরের জীবনের বিষয়ে আপ টু ডেট থাকছিলেন।
কয়েক সপ্তাহ আগে, তিনি খবরটি শুনেছেন। ক্রাইস্টচার্চে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের মধ্যে ৬৬ বছর বয়সী আবদুস সামাদ ছিলেন। আল নূর মসজিদে তিনি প্রার্থনারত ছিলেন।
‘এটা এক সপ্তাহের বেশি হয়েছে এবং আমি এখনও কাঁদছি,’ শাহজাহান ক্লিভল্যান্ড থেকে বলেছিলেন।
‘তিনি সবচেয়ে সৎ মানুষদের অন্যতম।’
এই হামলার শিকার হওয়া বেশিরভাগ লোকজনের স্বজনরা নিউজিল্যান্ড থেকে দীর্ঘ দূরত্বে বসবাস করেন, সারা বিশ্ব জুড়ে মানুষ তাদের প্রাণহানির জন্য শোক প্রকাশ করে চলছে।
আবদুস সামাদ বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ড উভয় দেশের মানুষকে শোকাতুর করেছেন। কানাডার পূর্ব প্রান্তের নোভা স্কটিয়া থেকে ওহাইয়ো, সোলোন অঞ্চলের সহকর্মী ও বন্ধুরা শোক প্রকাশ করছেন।
বাংলাদেশের গ্রামে, যেখানে সামাদের পরিবার আছে, স্থানীয়রা তার সম্মানে একটি মানববন্ধন করেছে। পরের সপ্তাহে আরো বড় সমাবেশ হবে তার স্মরণে।
শাহজাহান বলেন, সবাই তাকে পছন্দ করতো।
‘আপনি সেখানে যেকোনো লোককে জিজ্ঞাসা করতে পারেন এবং সবাই তার নাম জানেন।’
তার জীবন কঠিন পরিস্থিতিতে শুরু হয়েছিল, কিন্তু সামাদ ছিলেন একজন বুদ্ধিজীবী, যিনি নিজের সম্ভাবনা আরো বাড়াতে কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন।
তার তিন ভাইবোন, যাদের মধ্যে একজন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশে পরিণত হয়।
তিনি যে গ্রামে বড় হয়েছিলেন, সেটি ভারতের উত্তর সীমান্তের কাছে কুড়িগ্রাম জেলার মধুরহিলা নামে পরিচিত। গ্রামে পানি সরবরাহ ছিল না। এবং অধিকাংশ বাসিন্দার সামান্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল, শাহজাহান মন্তব্য করেন।
কিন্তু সামাদ বুদ্ধিমান এবং অধ্যবসায়ী ছিল। তিনি একটি আত্মাহুতি হিসেবে শিক্ষাকে দেখেছিলেন। যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, তখন তিনি তার গ্রামেই থাকতেন, যদিও যাতায়াতে অনেক সময় লেগে যেত।
পরিবারটির ক্রাইস্টচার্চের বাড়িতে বসে সামাদের ছেলে তারিক মুহাম্মদ বলেন, ‘বাবা অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন।’
‘তিনি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তবে আপনি যদি তার সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে আপনি কখনো জানতে পারবেন না যে, তিনি অত্যন্ত শিক্ষিত ছিলেন।’
ক্রাইস্টচার্চে তাকে পিএইচডি দেয়ার সময় সামাদ ছিলেন এক ডজন বা তারও বেশি মুসলিমের মধ্যে একজন, যারা আল নূর মসজিদ নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন, আর যেখানে তিন দশক পরে তাকে হত্যা করা হলো।
যদিও তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসেন, কিন্তু তিনি সব সময় নিউজিল্যান্ডে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। তার পরিবার ২০০৪ সালে ফিরে আসে, কিন্তু তিনি তার নাতিদের পড়াশোনায় সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশে থাকতেন।
তিনি সর্বদা নিউজিল্যান্ড সম্পর্কে কথা বলেন, বলেন, তার বড় ছেলে তোহা মুহাম্মদ, যিনি বাংলাদেশে থাকেন।
‘তিনি এই দেশকে ভালোবাসা দিতে ফিরে এসেছিলেন,’ তোহা অশ্রু চেপে মন্তব্য করেন।
‘এখানকার মানুষ বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ, আপনার একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আছে, প্রতিষ্ঠানগুলি ভালো। তিনি তাই এই দেশকে পছন্দ করতেন।’
সামাদ ২০১২ সালে স্থায়ীভাবে ক্রাইস্টচার্চে চলে যান।
তিনি যখন তা করেন, তখন তিনি আল নূর মসজিদের মুয়াজ্জিন হন। যিনি প্রার্থনা করার আহ্বান পাঠ করেন। তিনি মসজিদটিতে পাঁচবার যেতেন। এবং চেষ্টা করতেন মুসল্লিরা সবার আগে তার কণ্ঠ শুনতে পান।
‘তার দুই জায়গা ছিল, বাড়ি ও মসজিদ,’ তোহা বলেন।
‘এটাই তার জীবন ছিল।’
নিউজিল্যান্ডে তার প্রাথমিক ফোকাস ছিল তিনি স্থানীয় মুসলিম সমপ্রদায়ের নেতা। যেখানে তিনি একটি কমিউনিটি সংগঠক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। সমপ্রদায়ের অনেকেই আপদে-বিপদে একজন বড় ভাই সামাদের কাছে ছুটে আসতেন।
বিশেষ করে, তিনি নও মুসলমানদের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ইসলামের নীতিগুলো সঠিকভাবে যাতে তারা শিখেন, সেটা তিনি নিশ্চিত করতে ব্যাকুল থাকতেন।
তারিক বলেন, ‘যদি আপনি একজন নতুন মুসলমান হন এবং আপনি খারাপ শিক্ষা পান তবে আপনি চরমপন্থি হতে পারেন।’
‘ইসলামে বর্ণিত সহানুভূতি ও সমবেদনা সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করার বিষয় তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’
প্রথমদিকে, বিদেশি প্রচার মাধ্যম ভুলভাবে জানায় যে, মসজিদের শুটিংয়ে সামাদের স্ত্রীও নিহত হয়েছেন। এবং তাদের ছেলে তারিক নিখোঁজ।
উভয়ই সামাদের সঙ্গে মসজিদে যেতেন। কিন্তু তারা সেইদিন অসুস্থতার কারণে যাননি।
শুটিংয়ের পর বিশৃঙ্খলা ঘটেছে, অনেক পরিবারের মতো সামাদের প্রিয়জনরা চিন্তিত ছিলেন। তাই সামাদ মারা গিয়েছিল কিনা তা খুঁজে বের করতে তারা সংগ্রাম করেছে। রোববার পর্যন্ত জানা যায়নি যে তিনি মৃতদের মধ্যে ছিলেন। মৃতদেহ শনাক্ত করতেও সময় লেগেছে।
তারেক বলেন, ‘তিনি শান্ত, প্রেমময় মানুষ ছিলেন।’
‘এ কারণে তার এমন মৃত্যু এত কঠিন হয়ে আমাদের বুকে বাজছে। যে এত শান্ত-প্রেমময়, বিনম্র, যিনি সব সময় শান্তি শিখিয়েছেন ... তার এমন অকাল তিরোধান, এটা গ্রহণ করা খুব কঠিন।’
তোহা মাত্র গত সপ্তাহেই তার পরিবারকে সাহায্য করার জন্য বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন, তিনি এখনো তার বাবার মৃত্যু মেনে নেননি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য তিনি হিরো, অনুপ্রেরণা, পিতা, সবকিছুই ছিলেন। জ্যেষ্ঠপুত্র হওয়ার কারণে আমার সঙ্গে তার সম্পর্কের মধ্যে ভাইদের মতো কিছুটা অনুভব করতাম।’
‘এটা আমাদের সকলের জন্য এক দুঃসহ বোঝা। আমি এখনো এটি গ্রহণ করতে পারছি না- আমি বুঝতে পারছি না কেন তাকে এবং তাদেরকে হত্যা করা হলো?’
কয়েক বছর আগে, সামাদ তার স্ত্রী ও তার জ্যেষ্ঠপুত্রকে বলেছিলেন যে, ‘তিনি যেখানেই মারা যান, সেখানেই তাকে যেন দাফন করা হয়, সেটা হোক বাংলাদেশ বা নিউজিল্যান্ড।’
তার ইচ্ছানুসারে গত শুক্রবার অন্যান্য কয়েকজন ভিকটিমের মতো তাকেও লিনউড কবরস্থানে দাফন করা হয়।
বিশ্বের অন্য দিকে, ওহাইয়োতে সোলন নামক একটি শহরে, কয়েকশ’ মানুষ ক্রাইস্টচার্চ হত্যার শিকারদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য জড়ো হয়েছিল।
শাজু শাহজাহান মাইক্রোফোনটি গ্রহণ করেন এবং তার সেরা বন্ধু সম্পর্কে কথা বলেন। সামাদ গ্রামীণ বাংলাদেশে বড় হয়েছিলেন, কিন্তু নিউজিল্যান্ডের একটি মসজিদে তার জীবনের আলো নিভে গেল।
ক্লিভল্যান্ড জিউশ সংবাদমাধ্যমকে শাহজাহান সাজু বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে ড. সামাদের সঙ্গে বড় হয়েছিলাম।’
‘তিনি মেধাবী, দয়ালু, ধার্মিক এবং চাপা স্বভাবের এক নিরহঙ্কারী ব্যক্তি ছিলেন।’
[নিউজিল্যান্ডের স্টাফডটকো-এর সৌজন্যে, প্রকাশিত]

No comments

Powered by Blogger.