চকবাজার ট্র্যাজেডি: সংসার আর চলছে না by মরিয়ম চম্পা

পুরান ঢাকায় আগের বাসায় খুঁজে পাওয়া যায়নি চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত হাফেজ কাওসারের স্ত্রী ও যমজ সন্তানদের। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে কান্নাজড়িত কন্ঠে কাওসারের স্ত্রী নুশরাত জাহান মুক্তা বলেন, ওইখানে বাসাভাড়া অনেক বেশি। এত টাকা ভাড়া দিতে না পেরে দুই সন্তান ও তাদের নানীকে নিয়ে বর্তমানে কামরাঙ্গীরচরে একটি বাসাভাড়া নিয়েছি। যমজ বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় খাবার দিতে পারছি না। সন্তানদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে আমার। দৈনিক কম হলেও ৫শ টাকা খরচ হয়। এত টাকা আমি কোথায় পাবো। মাঝে মাঝে বলি যে, ‘ওর আব্বুকে না হয় আল্লাহ নিয়ে গেছে।
এখন আমরা তিনজন মইরা গেলে ভালো হয়’। এছাড়া আমার কাছে আর কোনো রাস্তা নাই। বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশন ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হাবিবুর রহমান জুয়েল বাচ্চাদের দায়িত্ব নেয়ার কথা বলে দুই দফায় ১৫ হাজার টাকা দিয়েছেন। বলেছেন, তিনি তার সাধ্যানুযায়ী সাহায্য করবেন। শ্বশুরবাড়ির লোকজনও কোনো খোঁজখবর নিচ্ছে না। বাচ্চা দুটো নিয়ে বেঁচে আছি না কি মরে গেছি খোঁজ নেয়ার এমন কেউ নেই।
তিনি বলেন, আমাদের কেমন সময় যাচ্ছে জানেন? খুব খারাপ। মাঝে ওরা দুই ভাইবোন খুব অসুস্থ ছিল। মেয়ে মেহেজাবিন সারাহ ছেলে জামিল আহমেদ সাফির থেকে মাত্র ৭ মিনিটের বড়। ১ বছর বয়সী দুই শিশুকে আমি কীভাবে মানুষ করবো, ওদের নিয়ে কোথায় থাকবো, কী খাওয়াবো কিছুই জানিনা। বাবুদের নিয়ে আমি ঢাকায় এসেছি অথচ শ্বশুর বাড়ির কেউ আজ পর্যন্ত বলেনি ৫০০ টাকা দিলাম ওদের জন্য খরচ করো। আমার স্বামী কাওসার প্রথম যখন ফার্মেসি ব্যবসা শুরু করে তখন তার বাবার বাড়ি থেকে কোনো আর্থিক সাহায্য পায়নি। বন্ধুদের থেকে টাকা ধার করে ব্যবসা শুরু করে। পরবর্তীকালে আমার বাবার বাড়ি থেকে কিছু টাকা এনে ব্যবসার কাজে সাহায্য করি। ওর বাবা বলেছিল, আর কিছুদিন পরেই তো আমার পড়ালেখা শেষ হবে। আর ব্যবসাটাও দাঁড়িয়ে যাবে। তখন সবার পাওনা টাকা শোধ করে দেবো। ওর আব্বুর এখনো ৯ লাখ টাকা দেনা আছে। এই টাকা আমি কীভাবে পরিশোধ করবো জানিনা।
আমি মহিলা মাদরাসা থেকে দাওরা পরীক্ষা দেবো। ৮ই এপ্রিল আমার পরীক্ষা। চার ভাইয়ের মধ্যে কাওসার ছিল তৃতীয়। কুমিল্লায় কাওসারের বাবা মো. খলিলুর রহমানের ফার্মেসি ব্যবসা আছে। আমার দেবর ভাসুররা যদি বলতেন যে দুই বাচ্চাকে নিয়ে এখানে সেখানে দৌড়াদৌড়ি না করে আমাদের সাথে থাকো। দুই বাচ্চার দায়িত্ব আমরা দুই ভাই নিলাম। এটা বললে হয়তো স্বামীকে মাটি দিয়ে ৫ দিনের মাথায় দুটি নিষ্পাপ ও অসুস্থ বাচ্চা নিয়ে ঢাকা আসতে হতো না। আমার আপনজনরা আমাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। এখন দুটি বাবুকে নিয়ে আমার রাস্তায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। জমিজমা কিংবা ব্যাংকে টাকা কোনো কিছুই আমার নেই। শ্বশুরবাড়িতেও তেমন কোনো জায়গা-জমি নেই। ওর বাবার অংশে শুধু একটি রুম রয়েছে। ২০১৫ সালের ২১শে আগস্ট পারিবারিকভাবে কাওসারের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। কাওসার মুক্তার চাচাতো ভাইয়ের বন্ধু ছিল। মুক্তার বাবার বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া। আট ভাই বোনের মধ্যে বোনদের সবার ছোট সে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ১ মাস আগে দুই বাচ্চাকে অনুদান দেয়ার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত কিছুই পাইনি। আমার কিছু লাগবে না। দুটি বাবুকে যদি একটু সাহায্য করা হয় আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরদিন ঋণী থাকবো। ওদেরকে নিয়ে আমি খুব বিপদে আছি। খুব কষ্টের মধ্যে দিনগুলো যাচ্ছে।
অনুদান পাওয়ার আশায় এখনো আছি। সামনে আমার পরীক্ষা। কবে পরীক্ষার শেষ হবে আর কবেই বা সার্টিফিকেট হাতে পাবো ও চাকরির আবেদন করবো। মাঝের এই দিনগুলো কীভাবে দুই বাচ্চাকে নিয়ে পার করবো? বাচ্চাদের এবং আমার খাবার খরচ কীভাবে যোগাবো সেই রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না। প্রথম দিকে ৫শ, ১ হাজার টাকা দিয়ে অনেকে সাহায্য করেছে। সেই টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা চুড়িহাট্টার বাসা ভাড়া দিয়েছি। বাকি যে সামান্য কিছু টাকা আছে, সেটা দিয়ে এখন চলছি। মাঝে বাচ্চাদের বাবার এক বন্ধু এসে বাজার করে দিয়ে গেছে। কেউ যদি আমার বাচ্চা দুটির স্থায়ী দায়িত্ব নিতেন, তাহলে হয়তো চিন্তামুক্ত থাকতাম। উল্লেখ্য, ২০শে ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাওসার আহমেদ নিহত হন। কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ছেলে কাওসার। চকবাজার এলাকার আল মদিনা ফার্মেসি নামে একটি ওষুধের দোকান ছিল তার। লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের হাল ধরতে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষে বড় চাকরি করবেন। সেই স্বপ্ন আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় হয়েছিলেন ১৭তম।

1 comment:

  1. ধন্যবাদ মরিয়ম চম্পাকে রিপোর্ট টির জন্য, উনাদের কে সাহায্য করতে চাই। ফোন নম্বর বা ঠিকানা দিলে উপকৃত হব। যদি অন্য কোনো উপায় থাকে জানাবেন।

    ReplyDelete

Powered by Blogger.