মনে হচ্ছিল কেয়ামত হতে চলেছে

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের ৫ তলায় পুরুষ ওয়ার্ডের বেডে আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিচ্ছেন ডার্ড গ্রুপের সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার তাহরীম খান নিশো। মুখে নেবুলাইজার মাস্ক। চোখে আতঙ্কের ছাপ। ক্ষণে ক্ষণে  শিশুর মতো হাত- পা কেঁপে উঠছে। পাশেই তিনজন বন্ধু তাকে মানসিক সান্ত্বনা এবং সাহস যোগাচ্ছিলেন। তিনি এতটাই মানসিক ট্রমার ভেতরে ছিলেন যে পাশে থাকা বন্ধুকে ডেকে বলেন, ‘আচ্ছা আমার বয়স কতো রে’?
নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তাহরীম বলেন, দুপুর পৌনে ১টার দিকে হঠাৎ করে এডমিনের ল্যান্ডফোন বেজে ওঠে। এডমিনের পক্ষ থেকে বলা হয় বিল্ডিংয়ে আগুন লেগেছে। সবাই নিজেদের মতো করে নিরাপদে নিচে নেমে যান।
এসময় ১২ তলায় ফ্লোরে থাকা আমরা ২০ থেকে ২২ জন একত্রে নিচে নামার জন্য সিঁড়ির কাছে যাই। সিঁড়ির কাছে গিয়ে হঠাৎ আমাদের পা আটকে যায়। কারণ তখন সিঁড়ি এতটাই গরম ছিল যে, আমরা নামতে গেলে হয়তো আগুনের তাপে গলেই যেতাম। আমরা অনেকটা জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে যে যার আত্মীয়স্বজনদের কাছে ফোন দিতে থাকি। আমি আমার কাছের এক বন্ধুকে ফোন দেই। এদিকে ফ্লোরের ভেতরে ধোঁয়ার কারণে চোখে কিছু দেখা যাচ্ছিল না।
ধোঁয়ার পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে, আমাদের দম বন্ধ হয়ে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। এসময় ফোনের ওপ্রান্তে থাকা বন্ধু আমাকে পরামর্শ দেয় জানালার গ্লাস ভাঙার। বন্ধুর কথানুযায়ী জানালার কাছে গিয়ে অনেক চেষ্টার পর গ্লাস ভেঙে ফেলি। মনে হচ্ছিল কেয়ামত হতে চলেছে। এসময় নিজের জীবন বাঁচাতে এতটাই মরিয়া ছিলাম যে, আমার সঙ্গে আটকা পড়া বাকিদের কথা আমার মাথায় ছিল না। জানালার কাঁচ না ভাঙতে পারলে এতক্ষণে হয়তো লাশ হয়ে যেতাম। অনেকক্ষণ চেষ্টার পরে ফায়ার সার্ভিসের লেডারের সাহায্যে নিচে নামি। আমাদের সঙ্গে একজন গর্ভবতী নারীও ছিলেন। জানি না তার ভাগ্যে কী ঘটেছে।
পাশের বেডেই শুয়ে ছিলেন ২৫ বছর বয়সী ডার্ড গ্রুপের এক্সিকিউটিভ মো. রিফাত হোসেন খান। হাতে সামান্য কাটা দাগ। আরেক হাতে গামছা পেঁচানো। কখনো রিফাত অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আবার দুই এক মিনিটের মাথায় সংজ্ঞা ফিরে পান। হঠাৎ যেন লাফিয়ে ওঠেন। পাশে থাকা বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনরা তাকে জোর করে শুইয়ে রাখেন। এভাবে কয়েক মিনিট চলতে থাকে। সংজ্ঞা ফিরে আসলে রিফাত বলেন, কিছু মনে নেই আমার। চারপাশে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া।
শ্বাস নিতে পারছিলাম না। দুপুর সোয়া ১টার দিকে বন্ধু সাইফকে ফোন দিয়ে বললাম- আর মনে হয় বেঁচে ফিরবো না। আমার জন্য দোয়া করিস। কোনো ভুলত্রুটি করে থাকলে মাফ করে দিস। এভাবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা হয়। কোনো উপায় না দেখে হাতে গামছা পেঁচিয়ে জানালায় খুব জোরে আঘাত করতে থাকি। এরপর কি হয়েছে মনে নেই। পাশে থাকা রিফাতের বন্ধু সাইফ বলেন, বিকাল ৪টার পরে আর রিফাতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি নি। পৌনে ৫টায় হঠাৎ একটি ফোন আসে। রিসিভ করতেই ফোনের ওপ্রান্তে থাকা রিফাত শুধু এতটুকুই বলে, ‘কুর্মিটোলা’। এরপর ফোন কেটে যায়। পরে আমরা তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নিচতলায় দেখতে পাই।
আহত তৌকির ইসলাম রূপকের চাচাতো ভাই তাকবির মানজার বলেন, রূপক বিল্ডিংয়ের ১১ তলায় অবস্থিত এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানি ইয়োর সার্ভিস-এর এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। দুপুর ১টায় রূপক আমাকে ফোন দেয়। এসময় তাদের সঙ্গে একরুমে মোট ১০ থেকে ১২ জন ব্যক্তি আটকা পড়েন। ধোঁয়া ও আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার ভয়ে তাদের সঙ্গে থাকা এক ব্যক্তি জানালার গ্লাস ভেঙে ১১ তলা থেকে লাফ দিয়ে মারা যান। তবে আমার ভাইকে আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছে, সুস্থ আছে- এজন্য আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে হাজার শুকরিয়া জানাচ্ছি।
এদিকে নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজ করতে হন্যে হয়ে ছুটেছেন আত্মীয়স্বজনরা। নিখোঁজ মনির হোসেন সরদারের ভাগ্নি হিরা বলেন, ভবনের ১০ তলায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন মামা। গ্রামের বাড়ি বরিশালের কোতোয়ালি থানায়। স্ত্রী ও এক সন্তান ফিলিপাইনে থাকেন। ৬ বোন ও ৩ ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। অগ্নিকাণ্ডের সময় লেডার দিয়ে নামানোর সময় স্লিপ কেটে পড়ে যায় মামা। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে ইউনাইটেড হাসপাতালে আসলে মামার মৃতদেহ আমরা খুঁজে পাই। আগুন লাগার পরে দুপুরে মামার সঙ্গে শেষবার আমার ফোনে কথা হয়। এসময় তিনি বলেন, আমার জন্য তোমরা দোয়া করো। আমি তোমাদের দোয়ায় হয়তো জীবন নিয়ে বের হতেও পারি, নাও হতে পারি।
ইয়োর সার্ভিস কোম্পানির এডমিন অফিসার কাজী এসকে জারিন বৃষ্টিকে খুঁজতে এসেছিলেন তার স্বামীর বন্ধু রাজীব। রাজীব বলেন, তাদের গ্রামের বাড়ি যশোর। তিন বছর আগে আমার বন্ধুর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। আমার বন্ধু রিজেন্সি হোটেলে চাকরি করে। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে হন্যে হয়ে খুঁজছি তাকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা তার কোনো সন্ধান পাই নি।

No comments

Powered by Blogger.