সব বিষয়ে চাই জাতীয় ঐকমত্য: প্রেসিডেন্ট, সমালোচনায় বাধা দেয়া হবে না: প্রধানমন্ত্রী

নিয়মিত কার্যক্রমের মধ্যদিয়ে শুরু হলো একাদশ জাতীয় সংসদের পথচলা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের এটি টানা তৃতীয় সংসদ। গতকাল একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনের সূচনা দিনে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ জাতীয় ঐকমত্য গড়ার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। রেওয়াজ অনুযায়ী অধিবেশনের দেয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট বলেন, জাতীয় ঐকমত্য ব্যতীত শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ পেতে পারে না।
গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা, আইনের শাসন ও অব্যাহত আর্থসামাজিক উন্নয়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণি ও পেশা নির্বিশেষে সবার ঐকমত্য গড়ে তোলার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আমি উদাত্ত আহ্বান জানাই। এদিকে অধিবেশনে দেয়া সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সংসদে বিরোধী দল যথাযথভাবে সরকারের সমালোচনার সুযোগ পাবে। তাদের কোনো বাধা দেয়া হবে না। এদিকে সরকারের সঙ্গে নির্বাচন করা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জানিয়েছেন, সংসদে তার দলের অবস্থান নিয়ে তিনি বিব্রত।
দশম জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়ার সভাপতিত্বে বেলা ৩টায় নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে। এরপরই নির্বাচন করা হয় স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার। একাদশ জাতীয় সংসদেও স্পিকারের দায়িত্ব পালন করবেন রংপুর-৬ আসন থেকে নির্বাচিত ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। আর ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হয়েছেন অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া। দশম জাতীয় সংসদেও তারা এ পদে ছিলেন। এদিকে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচনের পর তাদেরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য দেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অধিবেশন শুরুর পরপরই স্পিকার পদে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এটি সমর্থন করেন চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী লিটন। স্পিকার পদে আর কোনো নাম না থাকায় কণ্ঠ ভোটে তা পাস হয়। স্পিকার নির্বাচনের পর সংসদের অধিবেশন ৩০ মিনিটের জন্য মুলতবি রাখা হয়। মুলতবির এই সময়ে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ নবনির্বাচিত স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে শপথবাক্য পাঠ করান। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনাসহ সরকার এবং বিরোধী দলের সিনিয়র সদস্যরা এসময় উপস্থিত ছিলেন। এরপর আবার সংসদ অধিবেশনের কাজ শুরু হয়। এসময় দায়িত্ব পালন করেন স্পিকার। শুরুতে তিনি ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা করেন। এসময় ডেপুটি স্পিকার পদে অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়ার নাম প্রস্তাব করেন হুইপ আতিউর রহমান আতিক। আর সমর্থন করেন অপর হুইপ ইকবালুর রহিম।
পরে কণ্ঠভোটে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে ডেপুটি স্পিকার হিসেবে নির্বাচন করা হয়। এদিকে সংসদ অধিবেশন চলাকালে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের কাছ থেকে শপথ বাক্য পাঠ করেন। অধিবেশনের শুরুতে স্পিকার হিসেবে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন স্পিকার। এসময় তিনি ৩০শে ডিসেম্বর নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশ নেয়ায় সবাইকে ধন্যাবাদ জানান। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একাদশ জাতীয় সংসদ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নের অভিষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে একাদশ জাতীয় সংসদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আসুন আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি।
এর আগে সংসদ ভবনের নবম তলায় অবস্থিত সরকারি দলের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় স্পিকার, ডেপুটি স্পিকারের নাম চূড়ান্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচনের পর তাদের অভিনন্দন জানায় নতুন সংসদ। পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম নবনির্বাচিত স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় উপনেতা ও জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু আলোচনায় অংশ নেন।
বিরোধীদলীয় উপনেতা ও জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের নবনির্বাচিত স্পিকারকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, সংখ্যায় কম হলেও আমরা মনে করি সঠিকভাবে আমাদের কথা এখানে তুলে ধরতে পারলে সংসদ প্রাণবন্ত ও কার্যকর হবে। মানুষ সংসদকে গুরুত্ব দেবে। সংসদ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রাণকেন্দ্র পরিণত হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমরা সংসদে কথা বলবো। সরকারের ভুল ত্রুটি তুলে ধরবো। আমাদের কথা গুরুত্ব দিলে সংসদ প্রাণবন্ত ও কার্যকর হবে।
ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান প্রেসিডেন্টের:
একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে দেয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা, আইনের শাসন ও অব্যাহত আর্থসামাজিক উন্নয়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে সকল রাজনৈতিক দল, শ্রেণী ও পেশা নির্বিশেষে সবার ঐকমত্য গড়ে তোলার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, জাতীয় ঐকমত্য ব্যতীত শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থায়ী রূপ পেতে পারে না। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, কর্মচঞ্চল, সুখী, সুন্দর ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সবার কাম্য। ইতিহাসের সাহসী সন্তানেরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়ে গেছেন। আমাদের দায়িত্ব এ দেশ ও জাতির অগ্রযাত্রাকে বেগবান করা। একাত্তরের শহীদদের কাছে আমাদের অপরিশোধ্য ঋণ রয়েছে। আসুন, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে এবং দল-মত-পথের পার্থক্য ভুলে জাতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা ও দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার মধ্য দিয়ে আমরা লাখো শহীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করি। তিনি বলেন, ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবো।
আমাদের দৃষ্টি ২০২১ সাল ছাড়িয়ে আরও সামনের দিকে, ২০৪১ সালে বিশ্বসভায় বাংলাদেশ একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে- এটাই জাতির প্রত্যাশা। আমি দৃঢ়ভাবে আশাবাদী, মানবাধিকার, সুশাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণ এবং সমাজের সব স্তরে প্রত্যক্ষ জনসম্পৃক্তির মধ্যদিয়ে আমরা নির্ধারিত লক্ষ্যসমূহ অর্জনসহ একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে সক্ষম হব। চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করায় শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে প্রেসিডেন্ট বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে এবং সার্চ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী গঠিত বর্তমান নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হয়, যা দেশ-বিদেশে সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের বিপুল সমর্থনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। জনগণের এ রায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জননন্দিত নির্বাচনী ইশতেহার ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’-এর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ। সরকার নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত প্রতিশ্রুতিসমূহ বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর।
সংসদের চিফ হুইপ ও হুইপ নিয়োগ
একাদশ জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য নূর ই আলম চৌধুরী লিটন (লিটন চৌধুরী)। তার সঙ্গে হুইপ পদে থাকছেন আতিউর রহমান আতিক শেরপুর-১ আসন, ইকবালুর রহিম দিনাজপুর-৩ আসন ও মাহবুব আরা গিনি গাইবান্ধা-২ আসন থেকে নির্বাচিত। নতুনদের মধ্যে আছেন খুলনা-১ আসনের সংসদ সদস্য পঞ্চনন বিশ্বাস, জয়পুরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ও চট্টগ্রাম-১২ আসনের সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরী। সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ সংসদ নেতা শেখ হাসিনার পরামর্শক্রমে প্রধান হুইপ ও হুইপদের নিয়োগ আদেশ চূড়ান্ত করার পর গতকাল বুধবার এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। চিফ হুইপ পূর্ণ মন্ত্রীর পদমর্যদা ও হুইপবৃন্দ প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা ভোগ করে থাকেন। গতকাল থেকেই তারা দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। বিকাল ৩টায় একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। মাদারীপুর-১ আসন থেকে ৬ বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য নবম সংসদের হুইপ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন লিটন চৌধুরী। দশম সংসদে অনুমিত হিসাব কমিটির সভাপতি ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নে।
সভাপতিমণ্ডলী মনোনয়ন
প্রথম দিনেই নিয়ম অনুযায়ী পাঁচ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীর মনোনয়ন দেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এরা হলেন- আবুল কালাম আজাদ, অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু, এবি তাজুল ইসলাম, ফখরুল ইমাম এবং সাগুফতা ইয়াসমিন। স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে তারা সংসদ অধিবেশন পরিচালনা করবেন। গত ৩০শে ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই জয়ী হয় ২৫৮টিতে। ২২টি আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসে জাতীয় পার্টি। দশম জাতীয় সংসদে এই দলটি ৩৪টি আসন নিয়ে প্রধান বিরোধীদলের আসনে বসেছিল।
নির্বাচনের পর ৩রা জানুয়ারি নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির ছয়জন এবং গণফোরামের দুজন এবং আরও চারজন বাদে বাকিরা এদিন শপথ নেন। ওইদিনই টানা ত্বতীয়বারের মতো সংসদ নেতা নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হয়েও রেকর্ড সৃষ্টি করেন শেখ হাসিনা। এবার প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ হন বিরোধীদলীয় নেতা। যদিও দশম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা ছিলেন তার স্ত্রী ও জাতীয় পার্টির সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকায় একাদশ সংসদের প্রথম দিন অনুপস্থিত ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। অন্যদিকে ব্যাংককে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শপথ নিতে পারেননি। আগামী ২৮শে ফেব্রুয়ারি এ আসনে উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বোন সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন এই নির্বাচনে।
সমালোচনায় বাধার সৃষ্টি করবো না-প্রধানমন্ত্রী: গণতান্ত্রিক ধারায় সমালোচনা সব সময় গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমি এইটুকু আশ্বাস দিতে পারি এই সমালোচনা আমাদের বিরোধী দলে যারা আছেন, তারা যথাযথভাবে করতে পারবেন। এখানে আমরা কোনো বাধা সৃষ্টি করবো না। কোনো দিন বাধা আমরা দেইনি, দেবো না। গতকাল বিকালে একাদশ জাতীয় সংসদ অধিবেশনে টানা তৃতীয়বারের মতো স্পিকার নির্বাচিত হওয়ায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে সংসদ নেতা একথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে আমরা একটা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়েছি। কারণ এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ মা বোনেরা, প্রথম যারা ভোটার তারা, তরুণ ভোটাররা সকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। একটি সফল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমি বাংলাদেশের জনগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই এবং কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি বলেন, সংসদ নেতা হিসেবে আমার দায়িত্ব সংসদের সকল সদস্যের অধিকার যেমন দেখা এবং সেই সঙ্গে আপনি স্পিকার হিসেবে সকল সদস্য যাতে সমানভাবে সুযোগ পায়, এখানে সরকারি দল বিরোধী দল সকলেই যেন পায় অবশ্যই আপনি সেটা দেখবেন। এ ব্যাপারে আমরা আপনাকে সব রকমের সহযোগিতা করবো। সংসদ নেতা বলেন, গণতন্ত্রই একটি দেশকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় আর তা আজ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রমাণিত সত্য। আজ আমরা আর্থ সামাজিক ভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেয়ে আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছি। এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বাংলাদেশের জনগণকে একটি ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্রমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করে আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে স্বপ্ন, যে স্বপ্ন নিয়ে তিনি এ দেশকে স্বাধীন করেছিলেন, সেই ক্ষুধা মুক্ত, দারিদ্র্য মুক্ত সোনার বাংলা আমরা ইনশাআল্লাহ গড়ে তুলবো।
সেটাই আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ যেহেতু ভোট দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচিত করে এবং আমরা যারা প্রতিনিধিরা বসেছি সকলেই কিন্তু আমরা বিভিন্ন জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছি। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এখানে আমরা আমাদের স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করবো। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে আমাদের ভোটাররা, যারা নির্বাচিত করে এখানে পাঠিয়েছে তাদের সার্বিক উন্নয়ন, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং দেশে দেশে যেন একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করে। বাংলাদেশ জঙ্গিমুক্ত, মাদকমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত ও একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ যেন গড়ে ওঠে এবং দেশের মানুষের জীবনে যেন শান্তি-নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় সেটাই আমাদের সব সময় লক্ষ্য রাখতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, অতীতে একটা চমৎকার পরিবেশে সংসদ পরিচালিত হয়েছিল বলেই আমরা মানুষের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিলাম। আবার আমরা যেহেতু সংসদে নির্বাচিত হয়ে এসেছি অবশ্যই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করে বাংলাদেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব। এটাই আমাদের লক্ষ্য।
শোক প্রস্তাব, আশরাফের স্মৃতিচারণ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবেগজড়িত কন্ঠে বলেন, সৈয়দ আশরাফকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখতাম। সৈয়দ আশরাফ অত্যন্ত সৎ ও মেধাবী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। সে আমার পরিবারের সদস্যদের মতো ছিল, আমাকে বড় বোনের মতো শ্রদ্ধা করতো। গতকাল সংসদে শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এর আগে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মৃত্যুতে জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাব আনা হয়। এরপর সংসদে তার জীবনীর ওপর আলোচনা হয়। তার সম্মানে সংসদের বৈঠক ৩৫ মিনিট মুলতবি রাখা হয়। এরপর শুরু হয় প্রেসিডেন্টের বক্তব্য। শোক প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতিটি ক্ষেত্রে সে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছে। রাজনৈতিক জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অসাধারণ মেধাসম্পন্ন নেতা ছিল সৈয়দ আশরাফ।
তিনি বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল সৈয়দ আশরাফ। আজ আমরা যে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছি সেক্ষেত্রে সৈয়দ আশরাফেরও বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। অসম্ভব সোজা সরল ছিল সে। ভাইদের হারিয়ে যে ক’জনকে ভাইয়ের মতো পেয়েছিলাম, সৈয়দ আশরাফ তাদের একজন। তার বাবা দেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ছিলেন, সৈয়দ আশরাফও দীর্ঘদিন মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু সবসময় অসম্ভব সৎ জীবন-যাপন করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওর টাকা নেই, পয়সা নেই। কষ্ট করে চলতে হতো। তার চিকিৎসার জন্য যা যা করার আমি তা করেছি। তার মতো একজন প্রজ্ঞাবান ও জ্ঞানী রাজনীতিকের চলে যাওয়ার ক্ষতি কোনোদিন পূরণ হবার নয়। তার মৃত্যু দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এবং দেশের জন্য সৈয়দ আশরাফের চলে যাওয়া অপূরণীয় ক্ষতি হলো। কিশোরগঞ্জবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সৈয়দ আশরাফের সততা ও নিষ্ঠার কারণে অসুস্থতা সত্ত্বেও তাকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করেছে। তার বোন ডা. লিপিকে উপ-নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়েছি।
আমরা আশা করি, সৈয়দ আশরাফের স্মৃতি ধরে রাখতে ডা. লিপিকে ভোট দিয়ে কিশোরগঞ্জবাসী নির্বাচিত করবেন। শোক প্রস্তাবের ওপর আরো আলোচনা করেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মোহাম্মদ নাসিম, কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক এবং সাবেক বিরোধী দলের নেতা জাতীয় পার্টির বেগম রওশন এরশাদ। এ ছাড়াও শোক প্রস্তাবে সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার আবদুল বাতেন, নুরুল আলম চৌধুরী, তরিকুল ইসলাম, ড. ফজলে রাব্বী চৌধুরী, মাওলানা নুরুল ইসলাম, আশরাফুন নেছা মোশাররফ ও বোরহান উদ্দিন খান, কিংবদন্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা, গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী এবং লেখক আমজাদ হোসেন, বরেণ্য সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মৃণাল সেন, নারী মুক্তিযোদ্ধা বীরপ্রতীক তারামন বিবি, জাতীয় প্রতীকের নকশাকার মোহাম্মদ ইদ্রিস, প্রখ্যাত সাংবাদিক শাহরিয়ার শহীদ, ভাষাসৈনিক সৈয়দ আবদুল হান্নান, একাত্তরের বীরযোদ্ধা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার কুলদীপ সিং চাঁদপুরী, চলচ্চিত্র নির্মাতা সাইদুল আনাম টুটুল এবং প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনের ও সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর স্ত্রী মেহজাবিন চৌধুরীর মৃত্যুতে সংসদ গভীর শোক প্রকাশ করেছে।
সংসদে ভূমিকা নিয়ে বিব্রত মেনন: জাতীয় সংসদে নিজেকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আমরা আনন্দিত। তবে এই আনন্দের সঙ্গে আমরা একটু বিব্রতও বটে। আজকে ঢোকার মুখেও আমাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। জানতে চেয়েছে সংসদে আপনাদের অবস্থান কী হবে? এ প্রসঙ্গে দলীয় ফোরামে প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে মেনন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী তার দলের বৈঠকে একটি মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেছেন, এই সংসদে সরকারি দল যেমন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের হবে, তেমনি বিরোধী দলও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের হবে। আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য অত্যন্ত যৌক্তিক। কিন্তু বিষয়টিকে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত যেটা দাঁড়িয়ে গেছে...। আমাদের বলা হচ্ছে, আপনারা কেন বিরোধী দলে গিয়ে বসছেন না। বিষয়টি নিয়ে তো আমাদের কেউ জিজ্ঞাসা করবে, প্রশ্ন করবে বা আলোচনা করবে কিন্তু তা হয়নি। মনে হয় এই সিদ্ধান্ত যেন আমাদের ওপর...। মনে হচ্ছে, সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে।’ রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আমরা সরকারের সব উন্নয়ন কাজের প্রশংসা করবো। সঙ্গে সঙ্গে ত্রুটি-বিচ্যুতি যা থাকবে সেটা যদি বিরোধিতার প্রয়োজন হয় তা অবশ্যই করবো।

No comments

Powered by Blogger.