বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় নির্বাচন: দেশ-বিদেশে প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনিয়ম ও সহিংসতার ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে এ সকল বিষয়ে উত্থাপিত অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
ইউরোপের ২৮ রাষ্ট্রের ওই জোট ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক মুখপাত্র মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ভোটের দিনে সহিংসতা এবং প্রচার-প্রচারণায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকা বিশেষত পুরো প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য বাধাদান ভোট এবং ভোটের পরিবেশকে দূষিত করেছে। নির্বাচনের দিন এবং তার আগে ঘটে যাওয়া সহিংস ঘটনাগুলোর পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তদন্ত চেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
তাছাড়া, বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে উত্থাপিত সব অভিযোগের স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাজ্য। গতকাল মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরে এমন আহ্বান জানান দেশটির পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড বলেন, নির্বাচন ঘিরে গ্রেপ্তার এবং বাধা প্রদানের বিশ্বাসযোগ্য ঘটনাগুলোর পাশাপাশি এসব ঘটনা যে বিরোধী দলগুলোর নির্বাচনী প্রচারকে সীমিত করেছে অথবা প্রচারণা থেকে বিরত রেখেছে, সেসব বিষয়ে তিনি অবগত। নির্বাচনের দিন অনিয়মের কারণে ভোটারদের ভোট দিতে না পারার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। এসব অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য সমাধানের আহ্বান জানান তিনি।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই বিবৃতিতে মার্ক ফিল্ড নির্বাচনী প্রচারকালে ঘটে যাওয়া ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং সংঘাতের ঘটনাগুলোর নিন্দা জানান।
ওদিকে, বাংলাদেশে নির্বাচনের দিনে ভোটারদের ভোটদানে বিরত রাখার অনিয়মের অভিযোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, ভোটারদের বাধা প্রদানে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর যে আস্থা তা খর্ব হয়েছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে সব পক্ষকে নিয়ে গঠনমুলকভাবে সমাধান করতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এসব কথা বলা হয়েছে।
এদিকে বিএনপি অভিযোগ করেছে, ভোটে ‘কারচুপির’ পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী মতের মানুষের ওপর ‘সন্ত্রাস’ চালাচ্ছে।
দলটির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী এবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হননি, বরং প্রত্যেক এলাকার ইউএনও, থানার ওসি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।”
ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচনের নামে নিষ্ঠুর রসিকতা করে এখন জনপদের পর জনপদে ধানের শীষের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ওপর চলছে পৈশাচিক বর্বরতা। আক্রমণ করে ভেঙে ফেলা হচ্ছে নিরীহ মানুষের বাড়ি-ঘর-দোকানপাট-বাজার। অগ্নি সংযোগ করা হচ্ছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষি খামার-সহায় সম্পদের ওপর বেপরোয়া হানা দেওয়া হচ্ছে অবিরামভাবে।”
এর আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন সদ্য সমাপ্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি  আহ্বান জানিয়েছেন।
ড. কামাল হোসেন
মঙ্গলবার একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ড. কামাল বলেন, 'আমি আশা করি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের জনগণের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এ ‘ভোট ডাকাতি’র নির্বাচনকে কোনোভাবেই স্বীকৃতি দেবে না।'
তিনি আরও বলেন, 'প্রহসনের এ নির্বাচনে জনগণের মতামতের কোনো প্রতিফলনই ঘটেনি। এটিকে সরকারের একটি ‘পাতানো নির্বাচন’ বলেও দাবি করেন প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ।'
অপরদিকে, ঐক্য ফ্রন্টের শরীক কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আজ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভাবীকালে দেশের ইতিহাসে একটা কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। সরকারের এ বিজয় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নিন্দার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে।
বুধবার মোহাম্মদপুরস্থ নিজ বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ভাড়া করা কিছু বিদেশি পর্যবেক্ষক সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে দাবি করলেও এটি ছিল অস্বাভাবিক কারচুপির নির্বাচন, ত্রুটিতে ভরা কলঙ্কিত নির্বাচন। এর মাধ্যমে  দেশে নির্বাচন পদ্ধতির অপমৃত্যু ঘটেছে।
এদিকে, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেছেন, গত ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতন্ত্র ও সংবিধান পরাজিত হয়েছে স্বৈরতন্ত্র জয়ী হয়েছে। তাই এ নির্বাচন বাতিল করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে পুনঃনির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট  আইনজীবী সমিতিরি সভাপতি।  
এর আগে, নির্বাচনে অংশ নেয়া ইসলামি দল খেলাফত মজলিস ৩০ ডিসেম্বরের সংসদ নির্বাচনকে জাতির কাছে অগ্রহণযোগ্য ভোট ডাকাতি ও প্রহসনের নির্বাচন উল্লেখ করে ওই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করা এবং একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবিলম্বে পুনর্নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে।
খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে গৃহীত এক প্রস্তাবে  বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে, জনগণের উপর পৈচাশিক নির্যাতন চালিয়ে ভোটাধিকার হরণ করে ফ্যাসিবাদী সরকারকে মসনদে টিকিয়ে রাখার জন্যে নির্বাচনের নামে যে মহাপ্রহসন মঞ্চস্থ করা হলো তা জাতির ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হয়ে থাকবে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে খোদ নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতিই মানুষের আস্থা চিরতরে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এভাবে জালিয়াতি আর নীলনক্সার নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার কোনভাবেই জনগণের সরকার হতে পারে না। 
খেলাফত মসলিজ দাবি জানিয়েছে, দলীয় সরকারের পরিবর্তে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধিনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর এ দাবি আদায়ে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.