রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নয়া মার্কিন দূত: শুনলেন নিপীড়নের করুণ কাহিনী by সরওয়ার আলম শাহীন

রোহিঙ্গা ক্যাম্প পারিদর্শন করলেন বাংলাদেশে নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আল রবার্ট মিলার। ৫ সদস্যের সফরসঙ্গী নিয়ে গতকাল বেলা সাড়ে ১২টার  দিকে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে কোনার পাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন তিনি। এ সময় রাষ্ট্রদূত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি বাংলাদেশে নতুন এসেছি, তাই আপনাদের দেখার জন্য এসেছি। জানতে চাই আপনাদের সুখ দুঃখের কথা। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাস্তুচ্যুতদের বলেন, বাংলাদেশ সরকার আপনাদের নিরাপদে স্বদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে চাপ প্রয়োগ করে আসছে। যে কারণে মিয়ানমার এখন ফেরত নেয়ার কথা বলছে। যদি রাখাইনে বাড়ি ঘরসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দেয়া হয় তাহলে আপনারা রাখাইনে ফিরে যাবেন কিনা? জবাবে এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, আমাদের এখানে এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমরা যেকোনো সময়ে স্বদেশে ফিরে যেতে রাজি আছি।
তবে মিয়ানমারে অবস্থানরত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মতো আমাদেরকেও সম্পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তাও জাতিসংঘের সার্বিক নিরাপত্তার অধীনে। নো-ম্যান্স ল্যান্ড থেকে ফিরে মার্কিন দূত দুপুর দেড়টার দিকে বালুখালী টিভি টাওয়ার সংলগ্ন ঘুমধুম ইউএনএইচসিআর নির্মিত ট্রানজিট ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। ক্যাম্পে সদ্য মিয়ানমার থেকে আসা ৯ সদস্যের দুই পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে চান, তারা কেন এসেছেন? এসময় মিয়ানমারের বুচিদং নাইক্ষ্যংপাড়া থেকে আসা আমান উল্লাহ (৫৫) জানান, সেখানে মিয়ানমার সেনা ও রাখাইন, উগ্রবাদী জনগোষ্ঠী পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে এনভিসি কার্ড নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। বাড়ি থেকে বের হতে দিচ্ছে না। যে কারণে তারা বাধ্য হয়ে এপারে চলে এসেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিলার বালুখালী ময়নারঘোনা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এ সময় রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গাদের বেশ কয়েকটি থাকার ঘরও ঘুরে দেখেন। পরে ময়নারঘোনা ক্যাম্প ও ব্লকের ৫০ জন মাঝি ও ব্লক প্রতিনিধিদের সঙ্গে  কথা বলেন তিনি। নয়া রাষ্টদূত জানতে চান, তারা এখানে কেমন আছেন, জবাবে মাঝিরা বলেন তারা এখানে খুব ভালো আছেন।
নিয়মিত ত্রাণ সামগ্রী পাচ্ছেন। চিকিৎসা সেবা ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় দিন পার করলেও তারা মিয়ানমার ফিরতে আগ্রহী। সেখানে রাষ্ট্রদূতের উদ্দেশ্যে আবু তাহের মাঝি বলেন, কয়েকটি এনজিও সংস্থার দ্বিমুখী আচরণের কারণে ১৫ই নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হয়নি। এজন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, সরাসরি জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করে তাদের সহায় সম্পদ ফেরত দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হলেই তারা ফিরবেন। কেউ রোহিঙ্গাদের এখানে রাখতে পারবে না। তাহের মাঝি যা বলেন, তার মোদ্দা কথা ছিল এমন ‘স্বদেশের মায়া সবার আছে।’ এ সময় রাষ্ট্রদূত তাদের সম্মানের সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় বাংলাদেশের সহায়তায় পাশে আছে বলে জানান। এর আগে সকাল ১১টার দিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের দরগাহবিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মার্কিন অর্থায়নে নির্মিত সাইক্লোন সেন্টার কাম স্কুল ভবন পরিদর্শন করেন। দিনভর ক্যাম্প এলাকায় ব্যস্ত কর্মসূচিতে কাটিয়ে বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে মিলার কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওনা করেন।
সচিবের সঙ্গে প্রথম বৈঠকেই বার্নিকাটের ওপর হামলার অগ্রগতি জানতে চাইলেন মিলার: এদিকে আমাদের কূটনৈতিক রিপোর্টার জানান, গত বৃহস্পতিবার বিকালে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করে নয়া মার্কিন দূতের ঢাকায় অভিষেক হওয়ার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনই হচ্ছে প্রথম পাবলিক ফাংশন। কূটনৈতিক সূত্রে আগেই খবর বেরিয়েছে, ক্যাম্প পরিদর্শনের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ মিশন শুরু করতে চেয়েছেন আর্ল রবার্ট মিলার। কার্যত তা-ই করেছেন। তবে ঢাকায় আগের দুদিনেও কিছু কর্মসূচি ছিল তার। গুরুত্বপূর্ণ ছিল পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের বিষয়টি। সোমবার সকালে সচিবের সঙ্গে তার পরিচিতিমূলক তবে আনুষ্ঠানিক বৈঠকটি হয়। সেখানে একটি অবাধ সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে ওয়াশিংটনের আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত করেন মিলার। একই সঙ্গে তিনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান? সেটিও ব্যক্ত করেন। আলোচনায় আসে রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গও। তবে সচিবের সঙ্গে প্রথম বৈঠকেই মার্কিন দূত তার পূর্বসূরি (সদ্য বিদয়ী রাষ্ট্রদূত) মার্শা বার্নিকাটের গাড়ি বহরে হামলার তদন্তের অগ্রগতি চানতে চান। নয়া দূত এ-ও বলেন, এ হামলার ঘটনায় ওয়াশিংটন খুবই মর্মাহত। অপরাধীদের দ্রুত বিচার দেখতে চান তারা।
জবাবে ঢাকার তরফে ওই ঘটনাটিকে ‘দুঃখজনক’ এবং ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ উল্লেখ করে হামলার তদন্ত পুলিশ করছে জানিয়ে বলা হয়- স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে তদন্তকাজ এগিয়ে চলেছে। ঢাকার ওই বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত সন্তুষ্ট কি-না? জানতে চাইলে দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তার মন্তব্য ছিল এমন- ‘মুখে তো কিছু বলেনি, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখেও বোঝা যায়নি। তবে প্রথম বৈঠকে ইস্যুটি তোলায় মনে হয়েছে তারা সিরিয়াস। দেখি সামনে কী হয়।’ উল্লেখ্য, গতকাল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন কর্মসূচি শেষ হলেও নতুন মার্কিন দূত ঢাকায় ফিরেননি। আজ কক্সবাজারে জেলা প্রশাসকসহ স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে তার বৈঠক রয়েছে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গেও মতবিনিময় করছেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.