আমিরাতের শ্রমবাজার ছয় বছর ধরে বন্ধ, খুলবে কবে? by সাদ্দিফ অভি

গত ছয় বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া একরকম বন্ধ রেখেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। বন্ধ থাকা এ শ্রমবাজার খোলার বিষয়ে এ বছরের ১৮ এপ্রিল দেশটির সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ। সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার পর ধারণা করা হচ্ছিল, শিগগিরই এ বাজার পুরোপুরি খুলে যাবে। কিন্তু সমঝোতা স্মারক সইয়ের পর সাত মাস পেরিয়ে গেলেও এই বাজারে আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে আমিরাতের বাজার পর্যবেক্ষণ ও সম্ভাবনার বিষয়ে আলোচনা করতে এমাসে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে যাবেন তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। ২০১২ সালের আগস্ট মাসে হঠাৎ করেই বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ ঘোষণা করে ভিসা বন্ধ রেখেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। এরপর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় একটি ভিসা ও কনসুলার অফিস খুলে দেশটি। অফিসটি প্রতিদিন ৬০০ জনকে ভিসা দিতে সক্ষম। তখন সবাই ধারণা করেছিল— তিন বছর পর ফের নতুন করে বড় আকারে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিতে। সে হিসাবে প্রতি সপ্তাহে ৩ হাজার এবং প্রতিমাসে ১২ হাজার ভিসা দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও, পরবর্তী বছরের (২০১৬) জানুয়ারি-মার্চ মেয়াদে আরব আমিরাতে লোক পাঠানোর চিত্র ছিল অত্যন্ত করুণ। ওই তিন মাসে সেদেশে লোক গেছে মাত্র ২ হাজার ১৭৩ জন। তবে ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে গিয়েছিল ৭ হাজার ১৬৬ জন।
এরপর আবারও কূটনৈতিক চ্যানেলে ব্যাপক চেষ্টার ফলে ব্যক্তিপর্যায়ে চাহিদার ভিত্তিতে ১৯ ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশি কর্মী নেওয়ার আগ্রহের কথা জানায় সংযুক্ত আরব আমিরাত, যার ফলশ্রুতিতে এ বছরের ১৮ এপ্রিল সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মী নিয়োগ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক সই হয়। দেশটির মানবসম্পদ এবং এমিরাটাইজেশন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নাসের আল হামলি’র উপস্থিতিতে বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নমিতা হালদার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মানবসম্পদ ও এমিরাটাইজেশন মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি সাইফ আহমেদ আল সুআইদি দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারকে সই করেন। সমঝোতা স্মারকটি বাস্তবায়নের জন্য উভয় দেশের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি জয়েন্ট কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়। এই সমঝোতা স্বাক্ষরের পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে জয়েন্ট কমিটি গঠন করে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কথা থাকলেও, এখনও পর্যন্ত সেদেশে কর্মী পাঠানো নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
সমঝোতা স্বাক্ষরের পর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত আমাদের একটি অন্যতম শ্রমবাজার।  সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হলো। শ্রমবাজারটি উন্মুক্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উভয় দেশের নিয়মনীতি অনুসরণ করে কর্মী পাঠাতে হবে। সুষ্ঠু অভিবাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হলে পরবর্তীতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও শিক্ষকসহ প্রফেশনালদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই।’
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য মতে, এ বছরের এপ্রিলের পর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমিরাতে কর্মী গেছেন মাত্র ১ হাজার ৪০৪ জন। প্রতিমাসে গড়ে যাচ্ছেন ২০০ জন, অথচ শ্রমবাজার খোলা থাকার সময় সর্বোচ্চ শ্রমিক গিয়েছে ২০০৮ সালে ৪ লাখ ১৯ হাজার ৩৫৫ জন।   
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১২ সালের আগস্ট থেকে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশটি নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশ সরকারের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও গত ছয় বছরেও পুরোপুরি খোলেনি আমিরাতের শ্রমবাজার। নিরাপত্তা ও বন্দি বিনিময় সংক্রান্ত বিষয়ে দুদেশ চুক্তি স্বাক্ষর করলেও, শ্রমবাজার পুরোপুরি চালু নিয়ে এখনও ধোঁয়াশায় রেখেছে আমিরাত সরকার। বাংলাদেশিদের সম্পর্কে আমিরাতের নেতিবাচক মনোভাব পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে বিস্তর আলোচনা করেও মেলেনি কোনও সুসংবাদ। পরবর্তীতে, ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড এক্সপো-২০২০ নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ দুবাইকে প্রথম দফায় ভোট না দেওয়ার কারণে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে পড়ে। এটি সহজভাবে নেয়নি আরব আমিরাত। এ নির্বাচনে বাংলাদেশ রাশিয়াকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে সিদ্ধান্ত হয় প্রথম দফায় রাশিয়াকে ভোট দেওয়া হবে এবং পরবর্তীতে আমিরাতকে সমর্থন দেওয়া হবে।
দীর্ঘ ছয় বছর বন্ধ থাকার পর নতুন করে সমঝোতা স্বাক্ষরের মুহূর্ত থেকে কর্মী প্রেরণ কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও, বাস্তবে তার কোনও প্রতিফলন ঘটেনি। সমঝোতা স্মারকটিতে বাংলাদেশ থেকে ১৯টি ক্যাটাগরিতে কর্মী নিয়োগের বিধান, পদ্ধতি, রিক্রুটমেন্ট এজেন্সি ও উভয় দেশের সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য, কর্মীদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা, নিয়োগকর্তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, নিয়োগ চুক্তির বিধান ও পৃথক একটি বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থার কথা উল্লেখ রয়েছে।
এদিকে, নভেম্বর মাসে আমিরাতের বাজার পর্যবেক্ষণ ও সম্ভাবনার বিষয়ে আলোচনা করতে সেদেশে তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল যাবে বলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। প্রতিনিধি দলে রয়েছেন— মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অর্থ ও প্রশাসন ) আমিনুল ইসলাম, বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসেল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব মরনকুমার চক্রবর্তী ও ডিজিএম আরিফুল হক।
আমিরাতের শ্রমবাজার অফিসিয়ালি বন্ধ নয় দাবি করে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আমিনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমিরাতের বাজারে বর্তমানে আমাদের অনেক কর্মী আছে। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের কর্মীদের চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়বে বলে মনে হয় না। আমাদের কর্মীরা মূলত কনস্ট্রাকশন কাজে ওইসব দেশে যায়। আইসিটিসহ অন্যান্য সেক্টরে চাহিদা বেশি ভারতীয়দের। একটা রাষ্ট্র কত আর বিল্ডিং বানাবে? একসময় তো প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। আমার ধারণা, আধ্যাত্মিক কিছু না ঘটলে মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের কর্মীর চাহিদা বাড়বে না।’
অতিরিক্ত সচিব আমিনুল ইসলাম আরও বলেন, ‘দুবাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা যাবো। আরব আমিরাতের সরকারের সঙ্গে আমাদের এই মুহূর্তে দর কষাকষির কিছু নেই। কারণ, যখন সমঝোতা চুক্তি হয়েছে, যা আলোচনা করার তা হয়েছে। আমরা সেখানে গিয়ে মূলত আমাদের বাংলাদেশি কমিউনিটি, ব্যবসায়ী এবং কর্মীদের কাছ থেকে ধারণা নেবো আমিরাতের বাজার সম্পর্কে। কারণ, তারা এ সম্পর্কে ভালো জানেন। আমরা তাদের পরামর্শ নেবো, কোন সেক্টরে কীভাবে কী করা যায়। আমরা আমাদের লোকজনের সঙ্গে বেশি আলাপ করবো এবার। তারা কী বলছে, তাদের কথা শুনে দেখবো।’
তবে আমিরাতের বাজারে বাংলাদেশি কর্মীদের প্রচুর চাহিদা রয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘আমিরাতের বাজার অনেক দিন ধরেই বন্ধ। আরব আমিরাতে কর্মীর চাহিদা এত বেশি যে, আমি দুবাই গিয়ে দেখেছি অন্য দেশের পাসপোর্ট করে বিভিন্ন জায়গায় কাজ নিচ্ছে বাঙালিরা। আরব আমিরাতে আমাদের প্রচুর লোকের চাহিদা আছে। আমি মনে করি, আমাদের স্কিলড লোক তৈরি করতে হবে। প্রচুর পরিমাণে লোক পাঠানোর চিন্তা না করে আমাদের দক্ষ লোক তৈরির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।  একলাখ অদক্ষ লোক গেলে যে রেমিট্যান্স আসবে,  ১০ হাজার দক্ষ লোক গেলে তার চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসবে। কাজেই আমাদের সংখ্যার দিকে না যেয়ে, মানের দিকে নজর দেওয়া উচিত।’

No comments

Powered by Blogger.