সৌদি যুবরাজের শাসনামল কি শেষের পথে?

এক পক্ষ বলেছেন, সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের আদেশেই সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যা করা হয়েছে। অন্য পক্ষ বলছেন, তার আদেশের সীমা অতিক্রম করে ঘটনাস্থলে থাকা কর্মকর্তাই হত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। ইয়েমেন যুদ্ধ ও খাশোগিকে হত্যার ঘটনায় সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের জোর দাবি উঠেছে পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু খাশোগির হত্যায় তুলনামূলকভাবে নীরব ফ্রান্স মন্তব্য করেছে, অঞ্চলটির স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে এবং তাদের দেশের প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রয়োজনে সৌদি আরবকে দরকার। সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ বিষয়েও তাকে পছন্দ করা না করার বিষয়ে জনমত বিভক্ত। একদল মনে করেন, তিনি আর সম্পদ নন, বোঝা। অন্যদিকে মোল্লাতন্ত্রের কুক্ষিগত ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সংস্কার বাস্তবায়নের চেষ্টা করায় দেশটির তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশের কাছে এমবিএস প্রশংসিত। নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া থেকে শুরু করে নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে চাকরির সম্ভাবনা তৈরিতে যুবরাজের ভূমিকায় তারা খুশি। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক এমন দ্বিধাবিভক্ত পরিস্থিতির বাস্তবতায় যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ভবিষ্যৎ কী? তিনি কি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকতে পারবেন?
বিবিস লিখেছে, কেউ তাকে ‘বিষাক্ত’ মনে করেন, আর কেউ মনে করেন ‘নায়ক।’ তার ‘বিষাক্ত’ হওয়া না হওয়ার প্রসঙ্গে সবচেয়ে আলোচিত মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার ঘটনাটি। গত ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তানবুলে অবস্থিত সৌদি কনস্যুলেটে খাশোগিকে হত্যা করে যুবরাজ সালমানের পাঠানো এজেন্টরা। সৌদি আরব প্রথম থেকে এ ঘটনার একাধিক পরস্পরবিরোধী বয়ান হাজির করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে, খাশোগিকে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় বিশ্বজুড়ে মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া সমালোচনার প্রেক্ষিতে সৌদি আরব বলেছিল, হাতাহাতির ঘটনায় খাশোগির মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তারা মৃত দেহ দেখাতে পারেনি। পরবর্তীতে জানা যায়, তার মৃতদেহ কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। তুরস্কের তদন্তকারীরা বলেছেন, তার দেহাবশেষ এসিড দিয়ে গলিয়ে ফেলা হয়েছে। সৌদি আরব অভিযুক্ত এজেন্টদের গ্রেফতার করে আটক রাখার দাবি করে বলেছে, যুবরাজ খাশোগিকে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছিলেন, হত্যার নয়।
কাতারের সঙ্গেও সৌদি আরবের দ্বন্দ্ব রয়েছে। যুবরাজের নেতৃত্বে থাকা সৌদি আরব কাতারকে ইরানের পক্ষভুক্ত মনে করে এবং দেশটির বিরুদ্ধে অবরোধ জারি করে করে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র যে তার দুই মিত্রের মধ্যে এমন সম্পর্কের অবসান চায় তার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে মানামায় অনুষ্ঠিত নিরাপত্তা বিষয়ক সম্মেলনে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিসের দেওয়া বক্তব্য থেকে। তিনি জানিয়েছেন, কাতারে ১৭ দেশের সম্মিলিত বিমান ঘাঁটি হবে।
এ বছর কানাডার সঙ্গেও যুবরাজের মতবিরোধ হতে দেখা গেছে। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মানবাধিকার প্রসঙ্গে সমালোচনা করায় সৌদি আরব পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে কানাডায় পড়তে যাওয়া সব সৌদি শিক্ষার্থীকে দেশে ফেরার আদেশ দেয়।
সব মিলিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমালোচিত যুবরাজের ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরতে সৌদি আরবের রাজপরিবার যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ডেকে পাঠিয়েছে তার সমালোচক আহমাদ আব্দুল আজিজকে। তাকে বিমানবন্দর থেকে গ্রহণ করতে উপস্থিত থাকতে হয়েছিল স্বয়ং যুবরাজকে। রাজপরিবারের যেসব সদস্য এমবিএসকে ‘বিষাক্ত’ মনে করেন, তাদের প্রত্যাশা আহমাদ বিন আব্দুল আজিজ হয় যুবরাজের ক্ষমতা খর্ব করবেন, আর নয়তো যুবরাজের বিকল্প তৈরিতে সহায়তা করবেন।
এসব গেল তার বিরোধিতার প্রশ্নে চলা ঘটনাপ্রবাহ। কিন্তু তার পক্ষে সমর্থকরাও রয়েছে। গত বছর রিয়াদের রিৎজ কার্ল হোটেলে রাজপরিবারের সদস্য, ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তিনি আটক করে রেখেছিলেন। তার দাবি, এসব ব্যক্তি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেছেন। পরবর্তীতে বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করে ছাড়া পান আটক ব্যক্তিরা। এ ঘটনায় সৌদি আরবের অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা সন্তুষ্ট হয়। যুবরাজ নিজে যে ৪৫ কোটি ডলার ব্যয়ে বিলাসবহুল নৌযান কিনেছেন তাতে তাদের খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি।
যুবরাজ মোল্লাতন্ত্রের কুক্ষিগত ক্ষমতাকে উপেক্ষা করে দেশটিতে নারীদের গাড়ি চালানো বৈধ ঘোষণা করেন। তার আদেশে দেশটিতে প্রথমবারের মতো বড় বড় কয়েকটি শহরে চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর অনুমতি দেওয়া হয়। তেলনির্ভর অর্থনীতিকে হাই-টেক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে চান তিনি। এজন্য প্রস্তাব করেছেন ভিশন ২০৩০ নামের পরিকল্পনারও। নতুন প্রজন্মের সৌদি নাগরিকরা মনে করেন, তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তারা সবাই চাকরি পাবেন।
খাশোগির হত্যা ও ইয়েমেন যুদ্ধ নিয়ে যুবরাজের নেতৃত্বাধীন সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রবল হয়ে উঠলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফ্রান্সের একজন মন্ত্রী রয়টার্সের কাছে মন্তব্য করেছেন, যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে হারানোর ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়। বিষয়টি শুধু অস্ত্র বিক্রির নয়। যুবরাজের প্রভাব যদি ক্ষুণ্ণ হয় তাহলে পুরো অঞ্চলটিকেই অনেক বড় মাসুল দিতে হবে। ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মন্তব্য করেছেন, সৌদি আরবের সঙ্গে অস্ত্র বিক্রির চুক্তি রক্ষা করাটা ফ্রান্সের কর্মীদের চাকরির সুরক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিবিসি লিখেছে, বদ্ধ দুয়ারের পেছনে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন গুরুতর আলোচনা চালাচ্ছে সৌদি রাজপরিবার। তাকে কি নামকাওয়াস্তে কোনও পদ দেওয়া হবে যাতে তিনি কার্যত অত্যন্ত সীমিত ক্ষমতা হাতে পান? শুধু ক্ষমতা খর্ব করলেই কি মার্কিন কংগ্রেস ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তিগুলো সন্তুষ্ট হবে? তাতে কি তারা সৌদি আরবের কাছে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখবে? নাকি তাকে একেবারেই ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে?
২০০১ সালে আরব বসন্তের মাত্র কয়েক মাস পরে সংশ্লিষ্টরা ধরে নিয়েছিল সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ কয়েক মাসের মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত হবেন। কিন্তু সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তিনি বহাল তবিয়তেই আছেন। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কী হবে?

No comments

Powered by Blogger.