দেশে এখন সিভিল সোসাইটি নেই: রাজনীতিবিদরা না চাইলে কেউ সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেছেন, বাংলাদেশে এখন সিভিল সোসাইটি নেই। সিভিল সোসাইটি রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে । বিভক্ত হয়ে গেলে সেটা আর সিভিল সোসাইটি থাকে না। সিভিল সোসাইটিতে বিভক্তি যদি বাড়তে থাকে তাহলে তাদের কোনো উদ্যোগই সফল হবে না।
মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া, অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন লেখক, গবেষক, অর্থনীতিবিদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. আকবর আলি খান। ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে অনিশ্চয়তা-হানাহানি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একমাত্র রাজনীতিবিদরাই আমাদেরকে এটা থেকে উদ্ধার করতে পারে। অন্য কেউ পারবে না।
সকল রাজনীতিবিদ যদি চান তাহলে দেশে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সম্ভব। আর যদি রাজনীতিবিদরা না চান তাহলে কেউই দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে না। আগামী সংসদ নির্বাচন কেমন হবে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাতে অতীতের অভিজ্ঞতাই আবার পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে মনে হয়। ব্যতিক্রমধর্মী নির্বাচন হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
আকবর আলি খান বলেন, গত ৪৭ বছরে নানা ঘাত-প্রতিঘাত সত্ত্বেও অর্থনীতি এবং সামাজিক খাতে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিস্ময়কর। এই অর্থনৈতিক অর্জন নিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি সত্যিই আনন্দিত। আমরা এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নই। আমরা অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। তবে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়েছে সেভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশও এগিয়েছে। এবং আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য সূচকে আমাদের দেশকে এখনো অনেক দূরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলাম তারা সমাজতান্ত্রিক একটি সমাজ ব্যবস্থা চেয়েছিলাম। সমাজতান্ত্রিক সমাজে আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যে এই সমাজে অর্থনৈতিক বৈষম্য কম হবে। বাংলাদেশে এখন অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে চলেছে। যখন মুক্তিযুদ্ধ হয় তখন আমাদের এখানে ধনবৈষম্য খুব কম ছিল। অর্থনৈতিক এই বৈষম্যটাকে আমরা ‘জিনি সহগ’-এর নিক্তিতে পরিমাপ করে থাকি। ১৯৭০ সালের কাছাকাছি সময় আমাদের ‘জিনি সহগ’ ৩ শতাংশের নিচে ছিল। কিন্তু এখন সেটা ৫ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশের যে ধনবৈষম্য সেটা পৃথিবীর শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ দেশের মধ্যে ছিল। এখন কিন্তু এটা ৬০ ভাগের মধ্যে চলে এসেছে। এবং এটা যদি আরো বাড়ে তাহলে আমরা ৮০ ভাগ দেশের কাছাকাছি চলে যাবো। এ ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই উদ্যোগ নেয়া উচিত। এবং সে জন্য সরকারকেও বিভিন্ন ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করার প্রয়োজন রয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে এসব সমস্যার চট জলদি কোনো সমাধান নেই। এটা যদি অতি দ্রুত সমাধান করতে যাওয়া হয় তাহলে বেসরকারি বিনিয়োগের ওপর তার খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে তিনি বলেন, বৈষম্য তো শুধু বাংলাদেশেই যে হচ্ছে তা নয়। এটা সারা পৃথিবীতেই হচ্ছে। আজকের এই সমাজ ব্যবস্থায় অর্থ কামাই করা অত্যন্ত সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং তার ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ধনবৈষম্য বাড়ছে। তবে বাংলাদেশে এই ধনবৈষম্য বাড়ার পেছনে যে শুধু বৈধ বা আইনগত আয় আছে তা নয়। বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে বেআইনি আয়ও রয়েছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। কারণ যারা কালো টাকা কামাই করে ধনবৈষম্য বৃদ্ধি করছে তাদের বিরুদ্ধে সমাজে অনেক ক্রোধ থাকে। সুতরাং যদি ব্যাংক খেলাপি, কর খেলাপি এবং অন্যদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে বাংলাদেশে ধনবৈষম্য সামাজিক অসন্তোষেরও সৃষ্টি করবে। এ থেকে বেশ বড় ধরনের সামাজিক অসন্তোষ হতে পারে।
শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণদের চাকরির জন্য লড়াই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ঠিকই কিন্তু চাকরি তৈরি হচ্ছে না। এজন্য সরকারেরও যেমন ব্যর্থতা আছে তেমনি মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যর্থতাও রয়েছে। আমাদের যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তারা ‘হোয়াইট কালার’ বা ভদ্রবেশী চাকরি চায়। সুতরাং একটা দেশে সেই পরিমাণ হোয়াইট কালার চাকরি বাড়ানো সম্ভব হয় না। হোয়াইট কালার চাকরির যোগ্যতা সৃষ্টি করে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় এতো সমস্যা রয়েছে যার ফলে আমরা অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য লোক খুঁজে পাই না। ফলে আমাদের এখানে বাইরের প্রতিবেশী দেশগুলোর লোকজন এসে যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি নিয়ে যায়। সেখানে আমাদের দেশের ছেলেরা চাকরি পাচ্ছে না।  এক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনোভাবের পরিবর্তন করতে হবে। এবং সরকারকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত ৩টি প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন করেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় কমিশন কোনো কোটাই থাকা উচিত নয় বলে মত দিয়েছিল। তৃতীয় কমিশনও কোটা মোটামুটি তুলে দেয়ার সুপারিশ করেছিল। তবে মহিলা ও ক্ষুদ্র-নৃ গোষ্ঠীর জন্য কোটা ব্যবস্থা রাখা সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে পরামর্শ দেয় এ কমিশন। ৩টি কমিটিই একই ধরনের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু যে কারণে বাংলাদেশে কোটা ব্যবস্থা চালু আছে তার অন্যতম কারণ হচ্ছে কোটা থেকে যারা উপকার পায় তারা কোনো মতেই কোটা ব্যবস্থার পরিবর্তন চায় না। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী কোটা কোনো চিরস্থায়ী ব্যবস্থা না। কোটা ব্যবস্থা একটি লক্ষ্য নিয়ে করা হয় এবং সেই লক্ষ্য অর্জিত হলো কিনা সেটা নির্দিষ্ট সময় অন্তরালে মূল্যায়ন করা উচিত। এবং মূল্যায়ন করে যদি দেখা যায় লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে তাহলে কোটা তুলে দেয়া উচিত। আর যদি লক্ষ্য অর্জিত না হয় তাহলে প্রয়োজনে কোটা বাড়ানোর বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। এই পর্যালোচনাটি বাংলাদেশে গত ৪৬ বছরেও হয়নি। এ বিষয়ে আমি পাবলিক সার্ভিসের অনুরোধে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম সেখানে আমার বক্তব্য ছিল যে, নিদিষ্ট সময় অন্তরালে কোটা ব্যবস্থা অবশ্যই পর্যালোচনা করা উচিত। বিভিন্ন সরকার কায়েমি স্বার্থবাদীদের স্বার্থ রক্ষার্থে কোটা ব্যবস্থায় কোনো হস্তক্ষেপ করতে রাজি ছিল না। সেহেতু আমি কোটা সংস্কার করার সুপারিশ দিয়েছিলাম। কোটা তুলে দেয়ার সুপারিশ করিনি। তবে সরকার কোটা তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এবং এ সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে একটি সচিব কমিটি গঠন করা হয়। তারা সমস্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে বিচার বিবেচনা করে এই সুপারিশ দিয়েছে। সরকার এটা গ্রহণ করেছে। তবে কোটা নিয়ে যেটাই করা হোক না কেনো সেটা সারা দেশের শতকরা ১শ’ ভাগ লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকার যেহেতু সচিব কমিটির অনুরোধে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তাই এর বিরুদ্ধে যদি কোনো প্রতিক্রিয়া হয় তাহলে সেটা সরকারকেই মোকাবিলা করতে হবে। প্রয়োজনে সচিব কমিটি দিয়ে মহিলা ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এখন কোনো প্রতিবন্ধী কোটা নেই। মাত্র ১% অপশনাল কোটা রয়েছে। অপশনাল কোটা আসলে কোটা না। সেখানে আদৌ তাদের জন্য কোনো কোটা দেয়া সম্ভব কিনা এবং দিলে তার কি প্রতিক্রিয়া হবে সেটাও দেখার প্রয়োজন আছে। বিভিন্ন সার্ভিসে শারীরিক যোগ্যতা নির্ধারণ করা আছে। প্রতিবন্ধীদের শারীরিক যোগ্যতার বিষয়টি অবিলম্বে শিথিল করার প্রয়োজন রয়েছে। এবং তাদের জন্য কোটা ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে। একইসঙ্গে সরকার সামগ্রিকভাবে প্রতিবন্ধীদের জন্য কী করতে পারে সেটা দেখারও প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি।
স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে পারিনি। রাজনীতিবিদরা এবং বাংলাদেশের নাগরিকরাও এর জন্য দায়ী। নাগরিকরা তাদের কর্তব্য ভালোভাবে পালন করতে পারেনি। তবে আমি আশা করবো নাগরিকরা এ ব্যাপারে সচেতন হবেন। এবং যেরকমভাবে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য সাধারণ ছাত্ররা আন্দোলন করেছেন একইভাবে দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করার জন্য দেশের সাধারণ নাগরিকরা এগিয়ে আসবেন বলে বিশ্বাস করি।

No comments

Powered by Blogger.