শাহবাগের আদলে আন্দোলন

কে বলেছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় না। অন্তত শাহবাগে সেটা মিথ্যাও প্রমাণ হতে পারে। দাবি হয়তো আলাদা । কিন্তু আদল অনেকটা গণজাগরণ মঞ্চের মতোই। আবেগ আর উপস্থিতির মধ্যে তারতম্য আছে। তবুও ফের নতুন আঙ্গিকে শাহবাগকে যে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে তা এখন অনেকটাই পরিস্কার। অনেক পর্যবেক্ষকেরই ধারণা, এ ইস্যুকে হয়তো টেনে নিয়ে যাওয়া হবে অনেক দূর। কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করেছিল শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু সংস্কার নয়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে পুরো কোটাই বাতিল করে দেয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদেই শাহবাগে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড। গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টায় শুরু হওয়া এ অবরোধ কর্মসূচি গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে দেখা যায়। এদিকে অবরোধের কারণে শাহবাগের মতো রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্পটটির আশেপাশে যানজটের সৃষ্টি হয়। ভোগান্তি দেখা দেয় যাত্রীদের। বিপুল পরিমাণ পুলিশের উপস্থিতি থাকলেও তাদের নীরব দর্শকের ভূমিকায় দেখা গেছে। অবরোধকারীরা ‘কোটা কোটা কোটা চাই, ৩০% কোটা চাই’, ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই, লড়াই করে বাঁচতে চাই’, ‘মুক্তিযুদ্ধের অপমান মানি না মানবো না’, ‘শেখ হাসিনা ভয় নেই, ৩০% কোটা চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়। গতকাল এ অবরোধ কর্মসূচি চলাকালেই বিকালে কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
এরপরই এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায় আন্দোলনকারীরা। বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করা হয় ৬ দফা দাবিও। দাবিগুলো হচ্ছে- বিসিএসসহ সব চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। কোটা সংস্কার চাই, জাকির’স স্পেশাল বিসিএস, বিসিএস আওয়ার গোলসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কটূক্তিকারী পেজের অ্যাডমিনদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির ঘরোয়া প্রতিবেদন বাতিল, বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবার সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। সরকারি চাকরি থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের চিহ্নিত করে বহিষ্কার ও নাগরিকত্ব বাতিল করতে হবে। এ ছাড়াও কোটা সংস্কার আন্দোলনে ভিসির বাসায় হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিকালে আন্দোলনকারীদের অন্যতম নেতা আল মামুন মানবজমিনকে বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের অবরোধ কর্মসূচি চালিয়ে যাবো। গতকাল রাত সাড়ে ৮টা থেকে শুরু হওয়া আমাদের অবরোধ কর্মসূচি লাগাতারভাবে চলছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার থেকে সুস্পষ্ট বক্তব্য না দেয়া হবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা দাবির পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যাবো। এসময় তিনি আগামী শনিবার শাহবাগে মহাসমাবেশ করার কথাও জানান।
এর আগে গত বুধবার রাত ৮টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে মিছিল নিয়ে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা। এরপর তাদের সঙ্গে অন্যেরাও যোগ দেন। রাত ১১টার দিকে আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে তাদের রাস্তা ছেড়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে আন্দোলন করতে অনুরোধ করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তাতে সায় দেয়নি। তারা সরকার থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা আসা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। গতকাল সকালে দেখা যায় রাতে শুরু হওয়া অবরোধ কর্মসূচি তখনো চলছে। তবে এতে অংশগ্রহণকারী হাতেগোনা কয়েকজন। সকালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি মেহেদী হাসান বলেন, জনগণকে কষ্ট দিয়ে রাজপথ দখল করে আমরা আন্দোলন করবো না। এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করে আজ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এসময় তিনি জাতীয় জাদুঘরের সামনে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।
কিন্তু দুপুরে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির বর্তমান সভাপতি শেখ আতিকুর রহমান জানান, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি চলবে। গতকাল দুপুরে দেখা যায়, শাহবাগ মোড়ের গুরুত্বপূর্ণ স্পটটি দখলে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের আন্দোলনের ফলে আশেপাশের এলাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ যাত্রী ও রোগীদের। এদিকে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে অবরোধ কর্মসূচিতে আবারো অংশ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সাবেক সভাপতি মেহেদী হাসান জানান, তারা সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের যে প্রজ্ঞাপন হয়েছে তার বিরুদ্ধে রিট করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি বলেন, পরিপত্র জারি না হওয়া পর্যন্ত আমরা আইনগতভাবে এগোতে পারছিলাম না। এখন যেহেতু পরিপত্র জারির প্রস্তুতি চলছে এবং মন্ত্রিসভায় কোটা বাতিলের প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। তাই আমরা এখন আইনগতভাবে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
রাজধানীজুড়ে তীব্র যানজট, দুর্ভোগ: রাজধানীর মিরপুর থেকে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বাসযোগে যাচ্ছিলেন সাদ্দাম হোসেন। গন্তব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। বাসে বসে ক্রমেই অসুস্থতা বাড়ছিল ওই নারীর। বাস চলছিল ধীরগতিতে। যানজটে আটকে ছিল মোড়ে মোড়ে। স্ত্রী বমি করেছিলেন। আর স্বামী সাদ্দাম শুধু আল্লাহকে স্মরণ করছিলেন যেন দ্রুত হাসপাতালে যেতে পারেন। তখনও সাদ্দাম জানতেন না কী কারণে তীব্র যানজট। দীর্ঘ সময় পরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়ে এসে শাহবাগের যাত্রীদের নামিয়ে দেয় বাস চালকের সহকারী। স্ত্রীর হাত ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। সময় তখন দুপুর সাড়ে ১২টা। সাদ্দাম জানান, মিরপুর-১১ থেকে সকাল ৯টায় বাসে উঠেন তারা। যানজটের কারণে এই দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে এই দম্পতিকে।
শুধু এই দম্পতি না, রাজধানীর প্রায় প্রতিটি সড়কেই এরকম দুর্ভোগের শিকার হয়েছে অসংখ্য মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকতে হয়েছে তাদের। বাধ্য হয়ে অনেকে পায়ে হেঁটে চলাচল করেছেন। দিনব্যাপী প্রচণ্ড দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন শিশু, নারী, বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিরা। সকাল থেকেই মগবাজার, মালিবাগ, কাকরাইল, পল্টন, প্রেসক্লাব, মৎস্য ভবন থেকে, মিন্টু রোড হয়ে বাংলামোটর, কাওরানবাজার, ফার্মগেট সর্বত্র ছিল তীব্র যানজট।
সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের দাবিতে বুধবার রাত থেকেই শাহবাগ মোড় দখল করে অবরোধ করেন মুক্তিযোদ্ধা সন্তানরা। এতে শাহবাগসহ আশপাশে এলাকায় যানচলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। শাহবাগ মোড়ে অবস্থানের কারণে মৎস্য ভবন থেকে শাহবাগগামী সব যানবাহন কাকরাইল মোড় হয়ে মিন্টু রোডের পাশ দিয়ে যাতায়াত করেছে। একইভাবে সায়েন্সল্যাব থেকে শাহবাগগামী সব যানবাহনকে যেতে হয়েছে বাংলামোটর ও মিন্টো রোড হয়ে। এতে সকালে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় আশপাশের এলাকায়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানজটের প্রভাব পড়তে থাকে রাজধানীর প্রায় সব সড়কে। যনাজটের প্রভাব পড়ে অলিগলিতেও।
হামিদুর রহমান নামে এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান, ‘সকালে পৌনে ৯টায় পৌঁছলাম শেরাটন (নতুন নাম হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) ক্রসিংয়ে। উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব। শেরাটনের মোড় থেকে বারডেমের সামনে ওভারব্রিজের নিচে যেতে আধা ঘণ্টা লেগেছে। এমনটা কখনোই এর আগে হয়নি।’
সাড়ে ৯টায় মোহাম্মদপুর থেকে যাত্রাবাড়ীতে যাওয়ার জন্য বাসে উঠেছিলেন এক যাত্রী। মাহবুব আব্দুল্লাহ নামের ওই যাত্রী জানান, বাটা সিগন্যাল যেতেই সময় লেগেছে আড়াই ঘণ্টা। পরবর্তীকালে শাহবাগ থেকে পায়ে হেঁটে পল্টনে যান তিনি। একইভাবে সিলেট থেকে উচ্চ আদালতে জামিন নিতে এসেছিলেন হুমায়ুন কবির তালুকদার, মহিউদ্দিন মিলাদসহ বেশ কয়েক জন। ফকিরাপুল থেকে সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া নিয়েও রাস্তার তীব্র যানজট দেখে দৈনিক বাংলায় সিএনজি অটোরিকশা ছেড়ে পায়ে হেঁটে আদালতে পৌঁছান যানজটের কারণে। সকালে বাংলামোটর থেকে অনেকের মতো এক বয়স্ক দম্পতিকে দেখা গেছে পায়ে হেঁটে শাহবাগের দিকে যাচ্ছেন। তাদের চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। কপাল থেকে ঘাম ঝরছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। তবু একে-অন্যের হাত টেনে ধরে হাঁটছিলেন তারা। বয়স্ক ব্যক্তির নাম রবিউল ইসলাম।
তিনি জানান, তারা কাজীপাড়া থেকে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশ্যে বাসে উঠেন। ছেলে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি। কিন্তু রাস্তায় তীব্র যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটেছে যানজটে। নিজেদের ক্ষুধাও পেয়েছে। অন্যদিকে ছেলের জন্য মনটা কাঁদছে। ছেলে দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে শুনে গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহ থেকে রাতে এসেছেন তারা। যানজটের কারণে পায়ে হেঁটেই যাচ্ছেন তারা।
যানজটের প্রভাব পড়েছিল বাড্ডা, রামপুরা এলাকাতেও। এর প্রভাব ছিল দিনব্যাপী। গতকাল বিকাল ৪টায় মগবাজার থেকে সিএনজি অটোরিকশাযোগে বারিধারা যান সাদিয়া তমা। তিনি জানান, বারিধারা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় পৌঁছাতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লেগেছে তার। অন্যদিকে, যাত্রাবাড়ী থেকে মগবাজারে আসার জন্য পাঠাওয়ে কল দিয়েও অনেক সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে সেলিম আহমাদকে। কারণ হিসেবে জানান, পাঠাও রাইডার দয়াগঞ্জে ছিলেন। যানজটের কারণে বেশ সময় লেগেছে যাত্রাবাড়ী মোড়ে পৌঁছাতে। এভাবেই শহাবাগে অবরোধের প্রভাব পড়েছিল রাজধানীজুড়ে। দিনব্যাপী দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ।

No comments

Powered by Blogger.