রবিউলরা বেঁচে থাকে সাধারণের মাঝে

হলি আর্টিজানের হামলার ঠিক সাতদিন আগে রবিউলের সঙ্গে শেষ দেখা হয় স্ত্রী উম্মে সালমার। শেষ কথা হয় আগের দিন ৩০শে জুন সকাল ৯টায়। সে সময় প্রেগন্যান্সির লাস্ট ডেট হওয়ায় শরীরের কী অবস্থা জানতে চান গুলশান হামলায় নিহত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী কমিশনার রবিউল করিম। তার অনুপস্থিতি সর্বক্ষণই টের পাচ্ছে তার পরিবার। সালমা বলেন, শেষবারের কথায় ও জানতে চেয়েছিলো ঈদ কোথায় করবো। কালামপুরে বাবার বাড়ি, না মানিকগঞ্জে শ্বশুরবাড়ি।
তখন আমি ওকে বললাম তুমি কি বলো। শুনে সে হাসছিল। এমনিতে ফোনে ও আমার সঙ্গে খুব একটা কথা বলতো না।
কিন্তু ওইদিন ও ফোনটা রিসিভ করে অনেকক্ষণ চুপচাপ ছিল। তখন আমার মনে হলো ও কিছু বলতে চায়। আমি বললাম তুমি কি কিছু বলবা। তখন ও তেমন কিছুই বললো না। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় আমার শরীর ভালো না থাকায় শুয়ে ছিলাম। রাতে আম্মা আব্বাকে বললো ওর শরীরটা মনে হয় ভালো না। ওকে আবার ডাকতে যেওনা। তখন রাত সাড়ে ৯টার দিকে আব্বার ফোনে একটা ফোন আসে। পরপর কয়েকটা ফোন আসলে আব্বা ফোন নিয়ে বাসার বাইরে চলে যান। কথা শেষে বাসায় এসে কম সাউন্ড দিয়ে টিভি অন করেন। এর ঠিক ১৫ মিনিট পর আর একটি ফোন আসলে আব্বা আম্মাকে বলে আমি ঢাকায় যাচ্ছি তুমি বাসার গেট বন্ধ করে দাও। আব্বার কথা শুনে আমি উঠে টেলিভিশনের সামনে যাই। স্ক্রলে লেখা ওঠে গুলশানে হলি আর্টিজানে গোলাগুলিতে দুই পুলিশ সদস্য আহত।
তখন আমার হঠাৎ কেমন জানি লাগলো। এরপর ওর অফিসিয়াল একটা ফোন নাম্বারে আমি ফোন দেই। এক পুলিশ সদস্য ফোনটা রিসিভ করে জানতে চাইলে আমার পরিচয় দেই। তখন সে বলে ভাবি আমরা ইউনাইটেড হাসপাতালে আছি। রবিউল কেমন আছে জানতে চাইলে সে বলে জানি না ভাবি। আল্লাহ আল্লাহ করেন। তখনই আমার সন্দেহ হলো কিছু একটা হয়েছে। এরপর বুঝলাম যে রবিউলের সিরিয়াস অবস্থা। আমার ডাক্তার বড় ভাই ঠিক ঘণ্টাখানেক পরে আম্মাকে ফোন দিয়ে জানালো যে, সব শেষ হয়ে গেছে। ছোট মেয়ে কামরুন্নাহার রায়নার জন্মের মাসখানেক আগেই রবিউল আমাদের ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু আমার মেয়ে রায়নার অভিব্যক্তি দেখলে মনে হয় সে বাবাকে কত না জানি দেখেছে। ৬ মাস বয়সে রায়না প্রথম বাবা বলে ডাকে। এরপর বাবার ছবিকেই সব সময় আব্বু আব্বু বলে ডাকে। সে ভাবে ওই ছবিই তার বাবা। ছবিতে হাত দিয়ে ইশারা করে, আদর করে, চুমু খায়।
বড় ছেলে সাজিদের বর্তমান বয়স ৭ বছর। সে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। সাজিদ সবসময় বাবাকে মিস করে। ওর সকল আবদার, অভাব, অভিযোগ সবকিছু বাবার কাছেই করতো। মা হিসেবে আমি ওকে প্রায় সময়ই শাসন করতাম। বকা দিতাম। তাই সে বাবার প্রতি আহলাদি ছিল। রবিউল ছেলেকে কখনোই কিছু বলতো না। ছেলে যা বলতো বাবা হিসেবে যখন যে অবস্থায় থাকতো তখন সেটা ম্যানেজ করে দিতো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সালমা বলেন, আমার ছেলেটা একদম বাবার ক্যারেক্টার পেয়েছে। শত কষ্ট পেলেও মুখ ফুটে বলতে পারে না। যখন ও খুব কষ্ট পায় তখন বাবার মতোই চোখ দুটো লাল হয়ে যায়। আর নীরবে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। ও ইদানীং বাবাকে খুব মিস করে যখন ওর স্কুলের অন্য বন্ধুদের বাবা স্কুলে যায়। তখন ও বড় করে নিশ্বাস ফেলে। এলাকায় মেলার সময় আমি ওকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেও বাবার অভাব বোধটা ওর মাঝে থেকেই যায়। বিশেষ করে রাতের বেলা। আগে ওর আব্বু রাতে যতক্ষণ পর্যন্ত না বাসায় আসতো ততোক্ষণ জেগে থাকতো। বাসায় আসলে বাবার সঙ্গে দুষ্টুমি করে এরপর ঘুমাতো। এখনো রাতের বেলায় আড্ডা দেয়ার সময় সাজিদ বলে., আম্মু এখন যদি আব্বু থাকতো তাহলে কতই না মজা হতো। আমরা চারজন মিলে অনেক দুষ্টুমি ও মজা করতাম। গত শুক্রবার রাতে ও হঠাৎ আমাকে বলে, আম্মু আব্বু যে আমাকে একটা ফোন দিয়েছিল সেই ফোনটা কোথায়। আমি বললাম কেন? তুমি ফোন দিয়ে কি করবে। সাজিদ জানায়, সে আব্বুকে ফোন করে কথা বলবে।
পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটি চলে যাওয়ার পর সরকার ও পুলিশ বাহিনী থেকে সহানুভূতি পেয়ে কৃতজ্ঞ স্ত্রী উম্মে সালমা। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিন অফিসার হিসেবে শিক্ষা শাখায় চাকরি হওয়াতে অনেক ব্যস্ত সময় পার করছি। এই চাকরিটাই এখন আমার ফ্যামিলি হয়ে গেছে। কাজের সুবাদে নতুন নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া তাদের ভর্তি করার মাঝে এক ধরনের সুখ খুঁজে পাই। সালমা বলেন, ওর শূন্যতা কোনোভাবে পূরণ হওয়ার নয়। ‘যার হারায়, একমাত্র সেই বোঝে’। ওর স্মৃতিগুলো আমি দিন, মাস বা বছর হিসেবে নয় ঘণ্টা হিসেবে হিসাব করি। ওর সঙ্গে আমার স্মৃতি ও আন্ডারস্ট্যান্ডিং এক জনমে কেন হাজার জনমেও শেষ হবে না। ওর স্মৃতিকে আকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাই। আজ (১লা জুলাই) রবিউলের স্মরণে মানিকগঞ্জের একটি স্কুলে অনুষ্ঠান রয়েছে। রবিউলের জন্মস্থান মানিকগঞ্জের কাটিগ্রাম বাজার সংলগ্ন একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে রবিউলের নামে। রাস্তার উদ্বোধন, র‌্যালি, শোকসভা, মিলাদ অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) এস.এম মোস্তাক আহমেদ খান বলেন, ওয়াকিটকিতে পুলিশ সদস্যদের সহযোগিতার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) মোহাম্মদ রবিউল করিম। আমরা বেশ কয়েকজন জিম্মিকে উদ্ধার করতে পেরেছিলাম। নতুন আর একজন জিম্মিকে উদ্ধার করে আমরা যখন আবার আগের জায়গায় ফিরে আসি, তখনই সন্ত্রাসীদের নিক্ষিপ্ত একটি গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটে। তাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন রবিউল ও সালাহ্‌?উদ্দিন। রবিউল তার গ্রামে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য একটি স্কুল খুলেছিলেন। নিজ বেতনের টাকা দিয়েই তিনি চালাতেন তার সেই স্কুল। চাকরির মাত্র দুই বছরের মাথায় এ রকম একটি স্কুল পরিচালনা মানবসেবায় সত্যি তার ত্যাগ আর উদারতার এক অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ!

No comments

Powered by Blogger.