বিশ্ব রাজনীতি ছাপিয়ে ফুটবল উৎসব

২০১০ সালের ডিসেম্বর। স্থান জার্মানির জুরিখ। মুখে হাসি নিয়ে উপস্থিত হলেন ভ্লাদিমির পুতিন। পায়ে বসন্তের ছন্দ। পকেটে একটি ভাষণ। এর মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ২০১৮ বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক হিসেবে নাম ঘোষণা করা হয়েছে রাশিয়ার। প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন মঞ্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তার মুখভরা হাসি। উপস্থিতদের সামনে বক্তব্য রাখলেন সেই ভাষায় যে ভাষায় তিনি ভালো করে কথা বলতে পারেন। তবে সাধারণত তিনি প্রকাশ্যে এ ভাষায় কথা বলেন না। তিনি সাবলীল ইংরেজিতে বললেন, ‘ফ্রম দ্য বটম অব মাই হার্ট, থ্যাংক ইউ’। তিনি বিশ্বের জন্য একটি শুভ শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করলেন ফুটবলকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার নিজের শহর লেনিনগ্রাদ (যা বর্তমানে সেন্ট পিটার্সবুর্গ)-এর কাহিনী বললেন। ওই সময় নাৎসীরা ওই শহর দখল করে নিয়েছিল। বৃষ্টির মতো বোমা ফেলা হয়েছিল। খাদ্য ও জ্বালানি শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরও একটি বিষয় অব্যাহত ছিল। তা হলো ফুটবল। গত আট বছরে দুনিয়ায় অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। তবে বিশ্বরাজনীতিতে ভ্লাদিমির পুতিনের প্রভাব একটুও কমেনি। বরং বেড়েছে। গত শুক্রবার ফিফার ওয়ার্ল্ড কাপ ইউটিউব চ্যানেল ভ্লাদিমির পুতিনের একটি স্বাগত বক্তব্য প্রচার করেছে। তাতে পুতিনকে দাঁড়ানো দেখা গেছে। তিনি ছিলেন গুরুগম্ভীর। তার মুখে তেমন হাসি ছিল না। দাঁড়িয়ে ছিলেন ক্রেমলিনের কোনো একটি ভবনে। পুরো বক্তব্যটিই ছিল রাশিয়ান ভাষায়। তাতে পরিষ্কার যে বার্তা দেয়া হয়েছে তা হলো- এখন চার্জে আছি আমরাই।
সে যাই হোক রাজনীতি এখন ব্যাকফুটে চলে গেছে। ফুটবল। চামড়ার এক গোলকের দুর্বার আকর্ষণে পুরো বিশ্বের নজর এখন এক বিন্দুতে। আর কেন্দ্রস্থল রাশিয়া। দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ- ফুটবল বিশ্বকাপ আসরের পর্দা উঠছে আজ। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে রাত ৯টায় আসরের উদ্বোধনী ম্যাচে মুখোমুখি হবে স্বাগতিক রাশিয়া ও সৌদি আরব। আধাঘণ্টা আগে হবে ৩০ মিনিটব্যাপী উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। মাসব্যাপী এ আসরকে ঘিরে ফুটবল জ্বরে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। বাংলাদেশের অংশগ্রহণ নেই এখানে। কিন্তু আনন্দ আর উৎসবে দুনিয়ার আর কোন দেশ থেকে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ। এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে উন্মাদনা। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা মোটামুটি এ দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে বাংলাদেশ। পতাকা টানাতে গিয়ে মৃত্যুর মতো মর্মান্তিক ঘটনাও ঘটেছে। পছন্দের দলের পক্ষে চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন ফুটবলপ্রেমীরা। আবার সমর্থকদের কথার লড়াই জমেছে ফেসবুক, টু্‌ইটারের মতো বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।
২০১০ সালে দেয়া বক্তব্যে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্বকে একটি নিরাপদ ও স্বস্তিকর স্থানে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পুতিন। তিনি তখন ইংরেজিতে বলেছিলেন, এক্ষেত্রে আমাদের কাছে কতিপয় প্রস্তাবনা আছে। তা হলো- ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার। এক শহর থেকে আরেক শহরে ভাড়াহীন চলাচল। এছাড়াও আপনি রাশিয়াকে জানতে পারেন। এটি হলো এমন একটি দেশ যার রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। এটা মোটেও বাজে কিছু নয়। বিশ্ব সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে এটা ছিল রাশিয়ার একটি অভিবাদন বার্তা। বিশ্বকাপ আয়োজনের মাধ্যমে তারা এক ধাপ এগিয়ে গেল। জানিয়ে গেল রাশিয়াকে ভালোবাসার আহ্বান। তাদের মধ্যে এক রকম স্বস্তি কাজ করেছিল। তা হলো তারা স্পেন, পর্তুগাল, বেলজিয়াম ও হল্যান্ডকে পেছনে ফেলে বিড জিতে প্রথম হয়েছে। ডেভিড বেকহ্যাম, ডেভিড ক্যামেরন ও প্রিন্স উইলিয়ামের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেয় রাশিয়া। ফলে অর্থ যা দাঁড়ায় তা হলো সবকিছু পাল্টে গেছে। বিশ্বের প্রতি বাহু উন্মুক্ত করেছে রাশিয়া। তাতে সহায়তা প্রয়োজন।
বিশ্বকাপ ফুটবল শুরুর প্রাক্কালে এটা যেন এক অতিশয়োক্তি নয়, এক অসীম শ্রেষ্ঠত্ব। সারা বিশ্বকে মাত করেছে। রাশিয়া বিশ্ব রাজনীতিতে কি করেছে সেদিকে ফিরে তাকানোর অবকাশ কারো নেই এখন। এখন শুধু দৃষ্টি রাশিয়ার দিকে। কখন বাঁশিতে ফুঁ দেবেন রেফারি! সঙ্গে সঙ্গে মেতে উঠবে বিশ্ব। তার আগে জমকালো উদ্বোধনী এক আসর অবলোকন করবে বিশ্ববাসী। ফুটবলের এক জ্বলজ্বলে পিণ্ডে পরিণত হবে রাশিয়া। সিরিয়া, মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার বেসামরিক নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানির কথা ভুলে যাবে বিশ্ব। ভুলে যাবে চীন-ভারতের মধ্যে বৈরিতা, ভারত-পাকিস্তানের রেষারেষির কথা। ইয়েমেনে হয়তো ঝরবে আরো রক্ত। ইরাক, লিবিয়ায় বয়ে যেতে পারে রক্তের বন্যা। আফগানিস্তানে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে হয়তো কোনো মা, বোন, ভাইয়ের মৃতদেহ। বিশ্বকাপের এই উন্মাদনায় তাদের কথা হয়তো ভুলে যাবে অনেক মানুষ। তারা বিশ্ব রাজনীতিকে পেছনে ফেলে, রেষারেষিকে পেছনে ফেলে, পারমাণবিক অস্ত্রের ঝনঝনানি থেকে মুক্ত হয়ে ভেসে বেড়াবেন এক অপার আনন্দের ভুবনে।
রাজনীতিকে ছাপিয়ে ফুটবল সামনের সারিতে চলে এলেও রাজনীতিকে বাইরেও রাখা যাচ্ছে না। তার আদর্শ উদাহরণ জার্মানির মেসুত ওজিল, ইলকাই গুনডোয়ান, মিশরের মোহাম্মদ সালাহ। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে দেখা করে গত মাসে একটি ছবি পোস্ট করেছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভূত দুই জার্মান ফুটবলার ওজিল-গুনডোয়ান। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জার্মানির সর্বশেষ প্রস্তুতি ম্যাচে গুনডোয়ানের পায়ে বল গেলেই দুয়োধ্বনি দিয়ে উঠছিলেন জার্মানির সমর্থকরা। ওজিল-গুনডোয়ানের ঘটনায় হইচই যে থামেনি, তা বোঝা গেল জার্মানি দলের ম্যানেজার অলিভার বিয়েরহফের কথায়। বিয়েরহফ বলেন, ওজিল এ নিয়ে একটা কথাও বলবে না। ও ভুল করেছে, বুঝতে পেরেছে। বুঝিয়ে দেয়াও হয়েছে।’ আর জার্মানি থেকে চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মরকেলের মন্তব্য আরো কঠিন। তিনি বলেন, আমার মনে হয়, ওই দুই ফুটবলার বুঝতে পারেনি এটার গুরুত্ব কোথায়। বার্লিন এবং আঙ্কারার রাজনৈতিক সম্পর্ক একেবারে তলানিতে। আর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানির যে কোনো সংবাদ সম্মেলনে ঘুরে ফিরে আসছে ওজিল-গুনডোয়ান সংক্রান্ত প্রশ্ন।
ওজিলে যদি জড়িয়ে যায় ইউরোপের সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাজনীতিক মরকেলের নাম, তাহলে মোহাম্মদ সালাহর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন স্তালিনের পর রাশিয়ায় সবচেয়ে বেশি রাজত্ব করা ভ্লাদিমির পুতিন। সালাহর দেশ মিশর এবার বেস ক্যাম্প করেছে চেচনিয়ায়। আর দুদিন আগে মোহাম্মদ সালাহকে নিজের গাড়িতে পাশের সিটে বসিয়ে মিশরের অনুশীলনে হাজির হন চেচনিয়ার আলোচিত নেতা রমজান কাদিরভ। ওঠে সমালোচনার ঝড়। কাদিরভের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অনেক অভিযোগ রয়েছে। রাশিয়া থেকে আলাদা হতে চাওয়া চেচনিয়া নব্বইয়ের দশকে দুবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। আর ক’দিন আগে ব্লুমবার্গে একটি লেখার শিরোনাম ছিল, ওয়ার্ল্ড কাপ পলিটিক্স: মস্কো ১-০ লন্ডন। বৃটেন থেকে বিশ্বকাপ বয়কটের যে যে বেসরকারি ডাক উঠেছিল, তাতে আইসল্যান্ডের নেতারা ছাড়া তেমন সাড়া দেয়নি কেউ।
বিশ্বকাপের এটি ২১তম আসর। তবে পূর্ব ইউরোপে বিশ্বকাপ আসর বসছে প্রথমবার। বিশ্বকাপ ফুটবল প্রথমবার মঞ্চস্থ হয় ৮৮ বছর আগে। ১৯৩০-এ উরুগুয়েতে আয়োজিত হয় ফুটবলের এ মহাযজ্ঞ। এবার রাশিয়ার ১১ শহরের ভিন্ন ১২টি ভেন্যুতে হবে এবারের বিশ্বকাপের খেলাগুলো। এতে মোট ম্যাচ ৬৪। দর্শকরা প্রথমবার টেলিভিশনে বিশ্বকাপের খেলা দেখার সুযোগ পান ১৯৫০’র আসরে। তবে কালক্রমে টিভিতে বিশ্বকাপের দর্শকপ্রিয়তা বেড়েছে ব্যাপকহারে। টেলিভিশনে এবারের বিশ্বকাপের খেলা উপভোগ করবে বিশ্বজুড়ে ৫০ কোটি দর্শক। এবারের বিশ্বকাপেও খেলছে ৩২টি দেশ। ব্রাজিলের মাটিতে গত বিশ্বকাপে অংশ নেয়া ২০ দেশ খেলছে এবারো।
রাশিয়ায় এবারো আর্জেন্টিনার প্রত্যাশা আবর্তিত লিওনেল মেসিকে ঘিরে। সদ্য শেষ হওয়া মৌসুমে এফসি বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫৭ ম্যাচে সর্বাধিক ৪৫ গোলের রেকর্ড মেসির। আর আর্জেন্টিনার সর্বশেষ প্রস্তুতি ম্যাচে হাইতির বিপক্ষে ৪-০ গোলের জয়ে হ্যাটট্রিক নৈপুণ্য নিয়ে নিজের টাটকা ফর্মই দেখাচ্ছেন মেসি। এবারের হট ফেভারিট ব্রাজিল। আর ইনজুরি থেকে ফিরে ভক্ত-সমর্থকদের প্রত্যাশার পালে হাওয়া দিচ্ছেন ট্রান্সফার ফি বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলার নেইমার। শেষ দুই প্রস্তুতি ম্যাচেই গোল পেয়েছে এ ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড। মৌসুমে ৪৪ ম্যাচে ৪৪ গোলের কৃতিত্ব ২০১৬’র ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপাজয়ী পর্তুগিজ স্ট্রাইকার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চমক
সাধারণত বিশ্বকাপের থিম সংয়ের গায়করা পারফর্ম করে থাকেন আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। গত ক’আসরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মঞ্চ মাতান পপ শিল্পী রিকি মার্টিন, শাকিরা, জেনিফার লোপেজ, ব্যান্ড পিট বল। তবে প্রথা ভাঙছে এবার। এবারের বিশ্বকাপের থিম সং গেয়েছেন মার্কিন তারকা উইল স্মিথ, পুয়ের্তোরিকান নিকি জ্যাম ও আলবেনিয়ান শিল্পী এরা এসত্রেফি। কিন্তু মস্কোয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে দেখা যাবে না এদের কাউকেই। এবার মঞ্চ মাতাবেন বৃটিশ রক মিউজিক তারকা রবি উইলিয়ামস। প্রতিবছর কিকঅফের একঘণ্টা আগে শুরু হয় বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এবারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যাপ্তি ৩০ মিনিট। বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে আটটায় শুরু হবে অনুষ্ঠান। পারফর্ম করবেন জনপ্রিয় রুশ শিল্পী আইদা গারিফুলিনা। এই দু’জনের পাশাপাশি মঞ্চে উঠবেন কিংবদন্তি স্প্যানিশ শিল্পী এবং অপেরা আইকন প্লাসিদো ডমিঙ্গো। তার পরে মঞ্চে উঠবেন আরেক জনপ্রিয় শিল্পী জুয়ান ডিয়েগো ফ্লোরেজ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন দুইবারের বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রোনাল্ডোও। রবি উইলিয়ামস তার জনপ্রিয় গানের কয়েকটি গাইবেন। সারা বিশ্বের বিভিন্ন ঘরানার ক্লাসিক্যাল মিউজিককে প্রাধান্য দেয়া হবে। অনুষ্ঠানে প্রায় ৫০০ নৃত্যশিল্পী থাকবেন। তারা রাশিয়ান সংস্কৃতি তুলে ধরবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে। এখানে ৮০ হাজার দর্শক অনুষ্ঠানটি মাঠ থেকে দেখার সুযোগ পাবেন। একই সময়ে শহরের বিখ্যাত রেড স্কয়ারে কনসার্ট হবে।
রিপোর্টটি লিখেছেন মোহাম্মদ আবুল হোসেন ও পিন্টু আনোয়ার

No comments

Powered by Blogger.