শুধু রমজান এলেই তোড়জোড়!

সারাবছরই অস্থিতিশীল থাকে ভোগ্যপণ্যের বাজার। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মনগড়া দামে পণ্য বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা। আছে ভেজালের ভয়। তবুও নড়েচড়ে না প্রশাসন। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও নেয় না কার্যকর কোনো ব্যবস্থা। তবে রমজান এলেই দেখা যায় এসব সংস্থাগুলোর তোড়জোড়।
প্রতিবছরের ন্যায় এবারো রমজানকে ঘিরে বৃহস্পতিবার থেকে বাজার মনিটরিং শুরু করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। একটু-আধটু নড়ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনও। যা নিয়ে স্বস্তির পাশাপাশি প্রশ্ন সৃষ্টি করছে চট্টগ্রাম নগরবাসীর মনে।
নগরবাসীর প্রশ্ন, শুধুমাত্র রমজান এলেই কি পণ্যের মূল্য বাড়ে। ভেজাল হয়। ওজনে কারচুপি হয়। বছরের বাকি সময় কি সবকিছু ঠিক থাকে। থাকে না। তাহলে শুধু রমজান এলেই কেন প্রশাসনের তোড়জোড় বাড়ে।
নগরবাসীর ভাষ্য, বছরের বাকি সময়ও তো বাজারে কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ে, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ক্রেতার পকেট কাটে ব্যবসায়ীরা। ভেজাল, ওজনেও কারচুপি করে। তখন তো কোনো নড়াচড়া দেখা যায় না। তখন প্রশাসন যায় কোথায়।
কয়েকজন ক্রেতা জানান, বছরের বিভিন্ন সময়ে চাল ও পিয়াজের বাজার অস্থির ছিল। তার স্থায়িত্ব ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। কাঁচাবাজারও সবসময় বিক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। কোনো পণ্যের দাম আজ ১০ টাকা বাড়লে কাল ৫ টাকা কমানো হয়েছে। আবার একই পণ্য বাজারভেদে দামও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। বহাদ্দারহাটে এক রকম তো চকবাজারে অন্যরকম। আবার বিভিন্ন মৌসুমেও দাম বাড়ানোর হিড়িক ছিল। মুসলিমদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবগুলো যেমন মহরম, শবেবরাত, শবে মেরাজে মুরগি-ডিমসহ কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়েছিল অস্বাভাবিক হারে। আবার হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজার সময়েও বেড়ে যায় কিছু পণ্যের দাম। ওই সময়গুলোতেও চুপ ছিল বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাশহুদুল কবীর বলেন, সারা বছরই বাজার মনিটরিং করা হয়। কিন্তু রমজানের বিষয়টি ভিন্ন এবং একটু এক্সক্লুসিভ। রমজান এলে দেখা যায়, পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং এটাকে পুঁজি করে পণ্যের মূল্যও বাড়িয়ে দেয় অনেকে। পিয়াজ, রসুনসহ নিত্যপণ্যের পাশাপাশি ছোলা, ডাল, চিনি, তেলসহ যেসব খাদ্যপণ্যের চাহিদা তৈরি হয় সেগুলোর দাম রমজান এলেই বেড়ে যায়। তাই রমজানকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বাজার যাতে স্থিতিশীল থাকে সেজন্য আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। পুরো রমজান মাসজুড়ে চলবে। তার মানে এই না, সারা বছর খবর থাকে না। প্রতি মাসে জেলা প্রশাসন বাজার মনিটরিং কমিটির সভা করে। সেখানে ব্যবসায়ীরা থাকেন। বাজারের বিভিন্ন পণ্যের তালিকা সরবরাহ করা হয় মিটিংয়ে। যদি দেখা যায়, স্বাভাবিক সময়েও কোনো পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে বা ঊর্ধ্বগতি হচ্ছে তখন কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া হয়।
তিনি বলেন, নগরীতে ১৯টি কাঁচাবাজার আছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায়। কয়েকটি মার্কেটও আছে। আবার এসব বাজার ও মার্কেটের বিভিন্ন কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য আছে সংস্থাটির বাজার মূল্য পর্যবেক্ষণ, মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কমিটি। আছেন দুইজন ম্যাজিস্ট্রেটও (নির্বাহী ও স্পেশাল)। অথচ বাজারগুলো নিয়মিত মনিটরিং হয় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বাজার মূল্য পর্যবেক্ষণ, মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক কমিটির সভাপতি এস এম এরশাদ উল্লাহ বলেন, সারাবছর বাজার মনিটরিং হয় না, এটা ঠিক। তবে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়। হয়তো সেটারও ধারাবাহিকতা থাকে না। এর কারণ আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা উচ্ছেদ কার্যক্রমগুলোতে বেশি সময় দিয়ে থাকেন। রাস্তা, নালা, ফুটপাথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তৈরি সাধারণ মানুষের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করলে, বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ কার্যক্রমে কিন্তু আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটগণ সারাবছরই ব্যস্ত থাকেন। এইজন্য বাজার মনিটরিংটা কিছু কম হয়। তবে রমজানে কার্যক্রম পরিচালিত হবে। গত ৬ই মে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। তাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে পণ্যমূল্যের তালিকা টাঙিয়ে রাখার জন্য।
শুধু রমজানে কেন চাইলে তো সারাবছই পণ্যমূল্যের তালিকা টাঙানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেন। এমন মন্তব্যে তিনি বলেন, এবার যে বৈঠকে আমরা সেটাই স্পষ্ট করে বলেছি, সারাবছরই যেন তালিকা টাঙানো হয়। আশা করছি, ধারাবাহিকতা থাকবে। আমাদেরও ইচ্ছে, রমজানের পরেও মনিটরিং অব্যাহত থাকবে।
বাজার নিয়ন্ত্রণে আছে সরকারি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণও। বাজারের বিভিন্ন অসঙ্গতিগুলোর বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু তা খুব একটা দেখা যায়নি বছরজুড়ে।
এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের সহকারী পরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাশ বলেন, আমাদের প্রধান কাজই হলো অভিযান পরিচালনা করা। চট্টগ্রাম শহর এবং জেলায় প্রতি মাসে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি অভিযান পরিচালনা করে থাকি। পরিচালিত অভিযানে খাদ্যে ভেজাল, পণ্যের মূল্য বেশি নেয়া, ওজনে কারচুপি সংক্রান্ত বিষয়গুলোই দেখা হয়। এর বাইরে কারো কোনো অভিযোগ থাকলে সে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখে থাকি। নিয়মিত অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে লোকবল সংকট বাধা উল্লেখ করে তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে তিনজন এবং জেলা কার্যালয়ে মাত্র একজন অফিসার আছেন। আমাদেরকে দাপ্তরিক কাজও করতে হয়। সীমিত লোকবল সত্ত্বেও সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে আমরা অভিযানগুলো পরিচালনা করে থাকি।
আগামী রমজানকে ঘিরে গৃহীত কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিদপ্তরের এ কর্মকর্তা বলেন, রমজান উপলক্ষে প্রতিদিন অভিযান পরিচালনার নির্দেশনা আছে আমাদের উপর। এমনকি বন্ধের দিনেও। তাই রমজানে শনিবারেও অভিযান পরিচালনা করবো।
ভোক্তাদের নিয়ে কাজ করে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ক্যাব)। বাজার সংক্রান্ত জেলা প্রশাসনের বিভিন্ন বৈঠকেও অংশ নেন সংস্থাটির প্রতিনিধিরা। কিন্তু সেখানে যে খুব একটা প্রভাব রাখতে পারেন তা নয়। 
এ বিষয়ে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন বলেন, আমরা সব সময় বলি সারাবছরই যেন বাজার মনিটরিং করা হয়। সেটা সংশ্লিষ্টরা শুনতে চান না। ব্যবসায়ীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি, হয়তো সে কারণে ভোক্তাদের কথা কানে যায় না।
নাজের হোসাইন বলেন, বছরের কোনো না কোনো সময়ে কিছু কিছু ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। যেমন গত বছর পিয়াজের দাম এক নাগাড়ে অনেকদিন বেশি ছিল। চালের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা দেখেছি। সবজির বাজারেও লম্বা সংকট ছিল। সংকট হলেই দাম বেড়ে যায়। সংকট কি আসলে থাকে নাকি তৈরি করা হয়। সংকট তৈরি হলে ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের কাছে এমন বার্তা দেন, দাম আরো বেড়ে যাবে। তাড়াতাড়ি স্টক করেন। এসব বলেই দাম বাড়ানোর ফন্দি আঁটে। ওই জায়গাটা দেখা উচিত সারাবছরই। বছরে বিভিন্ন সময়ে আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়। বিভিন্ন মৌসুমে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা হয়। যেমন পূজার সময় কিছু পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। শবে কদর, শবেবরাত, রমজানসহ বিভিন্ন মৌসুমেও দাম বাড়ানো হয়। যদিও ওই সময়ের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.