উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি -বিবিএসের শ্রমশক্তি জরিপ

প্রবৃদ্ধি হলেও সেই তুলনায় দেশে বাড়ছে না কর্মসংস্থান। ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে মোট শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ শিক্ষিতই বেশি বেকার। উচ্চমাধ্যমিক পাস তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। এই হার ১১.২ শতাংশ। অন্যদিকে যারা কখনো স্কুলে যায়নি, শিক্ষার সুযোগ পায়নি; তাদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম। এই হার ১.৫ শতাংশ। সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপে (২০১৬-১৭) এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
জরিপে দেখানো হয়েছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে ১৪ লাখ শ্রমশক্তি যুক্ত হয়েছে যাদের বয়স ১৫ বছরের উপরে। কিন্তু এ সময় দেশের অভ্যন্তরে নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ১৩ লাখ। ফলে বেকার বেড়েছে। সবমিলিয়ে দেশে বেকার রয়েছে ২৬ লাখ ৮০ হাজার। আগের অর্থবছর এই সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ।
বেকারত্বের হার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার বাড়ছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর তরুণ বেকারদের মধ্যে উচ্চ শিক্ষিতের হার ছিল ১২.১১ ভাগ। ২০১৬-১৭ অর্থবছর এই হার দাঁড়িয়েছে ১৩.৪ ভাগে। সংখ্যার হিসাবে ৩ লাখ ৯০ হাজার তরুণ উচ্চশিক্ষিত বেকার রয়েছে যাদের বয়স ৩০ বছরের নিচে। তাদের মধ্যে ১১.২ ভাগ ২ বছরের বেশি সময় ধরে বেকার রয়েছেন।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞানুযায়ী যারা সপ্তাহে অন্তত ১ ঘণ্টা কর্মে নিয়োজিত থাকবেন তারা আর বেকার নন। বাংলাদেশে সপ্তাহে এক ঘণ্টাও কাজ করতে পারেন না এমন বেকারের সংখ্যা বেড়ে ২৬ লাখ ৮০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার কম কাজ করেন অথবা নিজেদের উপযোগী নয়, তাই নতুন কাজ খুঁজছেন এমন ‘আন্ডার এমপ্লয়মেন্ট’ এর সংখ্যা কিছুটা কমে ১৫ লাখ হয়েছে। অর্থাৎ দেশে প্রকৃত বেকারত্বের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৪১ লাখ ৮০ হাজারে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বেকারত্বের হার তুলনামূলক কম ৬.২ ভাগ। অন্যদিকে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়েছে এমন পর্যায়ে এই হার ২.৭ ভাগ। অর্থাৎ শিক্ষার উচ্চ পর্যায়ে বেকারত্বের হার বেশি।
বিবিএস প্রকল্প পরিচালক কবির উদ্দিন আহমেদ উল্লেখ করেন, মূলত: উচ্চ শিক্ষিতরা ভালো চাকরির জন্য অপেক্ষা করেন। এজন্য সে পর্যায়ে বেকারের হার বেশি।
বিশ্লেষকরা বলেন, যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেই হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এজন্য শুধু প্রবৃদ্ধি বাড়ালেই হবে না। কর্মসংস্থানের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। যাতে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের সংযোগ ঘটে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কর্মসংস্থান কমার কোনো কারণ নেই। তবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির রয়েছে। কিন্তু তারপরও তো কিছুটা বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু বেকার সংখ্যা বাড়াটা স্বাভাবিক। কেননা প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ কর্মের বাজারে প্রবেশ করছে। সে তুলনায় কর্মসংস্থান হচ্ছে না।
বিবিএসের শ্রমশক্তির জরিপের তথ্য মতে, গত এক বছরে দেশে মোট কর্মসংস্থান হয়েছে ৩৭ লাখ। এর মধ্যে নতুন কর্মসংস্থান ১৩ লাখ। মজুরি ছাড়াই কাজ করতেন (আনপেইড) এমন ১৪ লাখ মানুষ মজুরিভিত্তিক (পেইড) কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছেন। আর প্রবাসের শ্রমবাজারে যোগ দিয়েছেন ১০ লাখ মানুষ।
জরিপে দেখা গেছে, অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ঘটেছে রূপান্তর। কর্মক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তন। এসব পরিবর্তনের অংশ হিসেবে দেশের কৃষিখাতে কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা কমেছে। বিপরীতে বেড়েছে শিল্প ও সেবাখাতে শ্রমশক্তির সংখ্যা। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৫৬ শতাংশ কৃষি, শিল্প ও সেবাখাতে নিয়োজিত রয়েছে, যা সংখ্যায় ৬ কোটি ৮০ লাখ। শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে ৪ কোটি ৫৫ লাখ মানুষ।
এতে আরো বলা হয় ৬ কোটি ৩৬ লাখ শ্রমশক্তির মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৪ কোটি ৩৫ লাখ। আর নারীর সংখ্যা ২ কোটির মতো। ২০১৫-২০১৬ সালের জরিপে ৬ কোটি ২১ লাখ শ্রমশক্তির মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৩১ লাখ। আর নারীর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৯১ লাখ। এ হিসেবে ২ বছরে শ্রমশক্তিতে নারীর হার বেড়েছে প্রায় ৯ লাখ। গত এক দশকে শ্রমের রূপান্তর ঘটছে অনেক। কৃষিনির্ভরতা থেকে শ্রম চলে গেছে সেবা ও শিল্পের দিকে।
জরিপে বলা হয়েছে, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে কৃষিখাতে নিয়োজিত ছিল ২ কোটি ৫৪ লাখ মানুষ। সেখান থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কমে গিয়ে কৃষি শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৪৭ লাখ। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সেবাখাতে। গত অর্থবছরে সেবাখাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ২ কোটি ৩৭ লাখ। তার আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল দুই কোটি ২০ লাখ। এছাড়া শিল্পখাতে গত অর্থবছরে নিয়োজিত ছিল ১ কোটি ২৪ লাখ, তার আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২২ লাখ।

No comments

Powered by Blogger.