অপহরণ তদন্তে বেরিয়ে এলো লোমহর্ষক হত্যার রহস্য

প্রথমে বন্ধুত্ব। ঘনিষ্ঠতা। নানির মৃত্যুর সংবাদে বন্ধুকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার বদান্যতা। কিন্তু সেই কৌশল টেরই পায়নি আকাশ (১৯)। গত ৭ই অক্টোবর সান্তনা দিতে দিতেই খাওয়াতে নিয়ে যায় নিজের বাসায়। রাজধানীর বিমানবন্দরের পাশে হজ ক্যাম্পের কাছে।
তারপর একটি কক্ষে বন্দি করা হয় আকাশকে। এরপর মারধর। উলঙ্গ করে খারাপ নারীর সঙ্গে ধারণ করা হয় ভিডিওচিত্র। তা দেখিয়ে ঢাকা ন্যাশনাল পলিটেকনিকের ওই ছাত্র আকাশের পিতা দিলীপ কুমার সাহার কাছ থেকে দাবি করা হয় ৩০ লাখ টাকা চাঁদা।
রাজধানীর বসুন্ধরা থেকে অপহরণের পর বিমানবন্দর থানায় জিম্মির এসব ঘটনাই হয় মালদ্বীপ প্রবাসী বন্ধু শ্যামলের (২২) পরিকল্পনা ও নির্দেশনায়। এতে অংশ নেয় তার অপরাধ জগতের সঙ্গী জুয়েল রানা (২২), সোহেল (২১) ও ইয়াসিন (২৫)। পুত্র অপহরণের ঘটনায় কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের স্বর্ণের ব্যবসায়ী দিলীপ গত ১৯শে অক্টোবর বিমানবন্দর থানায় মামলা করেন। তা তদন্ত ও অনুসন্ধানের ভার পড়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপর। মাঠে নামে টিম। বেরিয়ে আসে একের ভেতর বহু অপরাধ। উদঘাটন হয় দেশে-বিদেশে হত্যাসহ আরো বেশকিছু অপরাধের রহস্য। ধরা পড়ে একটি ভয়ঙ্কর অপরাধী চক্র।
জানা যায়, আকাশের বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। সেখানেই তার পিতার স্বর্ণের দোকান রয়েছে। দিলীপ ও তার ভাইয়ের সঙ্গে আগে ব্যবসা করতেন শ্যামল। কয়েক বছর আগে তিনি ব্যবসা গুটিয়ে মালদ্বীপ চলে যান। কিন্তু আকাশের সঙ্গে মোবাইল ও ফেসবুকে যোগাযোগ রাখতেন। শ্যামল মোবাইল-ফেসবুকের মাধ্যমে ঢাকায় অবস্থানরত তার ঘনিষ্ঠ জুয়েল রানা, সোহেল ও ইয়াছিনের সঙ্গে আকাশের পরিচয় করিয়ে দেয়। কুমতলবে তারাও তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এরপর গত ৭ই অক্টোরব তার নানির মৃত্যুর সংবাদে প্রবাসী শ্যামলের নির্দেশে ফাঁদ পাতে তারা। নিজেদের গাড়িতে তাকে চৌদ্দগ্রামে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে বিভ্রান্ত করে। বন্ধুত্বের কারণে সেও তাদের বিশ্বাস করে। গাড়িতে উঠার আগে সহানুভূতি প্রকাশ করে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যায় সোহেলের বাড়িতে। এরপরই বাসার একটি কক্ষে তাকে জিম্মি করা হয়। রাখা হয় অর্ধ মাসের বেশি সময়। সেখানে তাকে নির্যাতন করে ও উলঙ্গ ভিডিওচিত্র ধারণ করে ঘটনা প্রকাশ ও মামলা না করতে হুমকি দেয়া হয়।
কিন্তু তার পিতা দিলীপের মামলার পর তাদের উদ্দেশ্য আর সফল হয়নি। মাঠে সক্রিয় হয়ে ওঠে ডিবি সদস্যরা। বন্দি ভিকটিম আকাশকে খাবার সরবরাহকারী সোহেলের বাবা-মাকে আটকের পর সে ধরা পড়ে। এরপর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নবীনগর, কুমিল্লার মুরাদনগর ও কোম্পানীগঞ্জ, গাজীপুরের জয়দেবপুর, রাজধানীর দক্ষিণখান, উত্তরখান, খিলক্ষেত ও ভাটারা থানার বিভিন্ন এলাকায় একে একে অভিযান চালায় ডিবি সদস্যরা। ডিবি’র উপ-কমিশনার মীর মোদাচ্ছের হোসেনের নির্দেশনায় ও অতিরিক্ত এডিসি মাহমুদ আফরোজ লাকী তা তত্ত্বাবধান করেন। আর টিমের নেতৃত্ব দেন ডিবি’র অর্গানাইজড ক্রাইম প্রিভেনশন টিমের সহকারী কমিশনার মো. নজরুল ইসলাম। অবশেষে গত ২৯শে অক্টোবর রাজধানীর উত্তরাসহ একাধিক এলাকা থেকে ধরা পড়ে একে একে তিন দুর্ধর্ষ অপরাধী।
এর মধ্যে জুয়েল রানার বিরুদ্ধে নরসিংদী, নবীনগর ও মুরাদনগর থানায় খুন, অস্ত্র ও মারামারির ৪ টি মামলা রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর তার ফ্রিজ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ৩ টি বিদেশি পিস্তল। এছাড়া ২০১৪ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর ইতালিতে বাংলাদেশি যুবক পিংকুকে খুন করে মোবাইল, অর্থ ও স্বর্ণালংকার চুরি করে পালিয়ে দেশে চলে আসে। তাকে খুঁজছে ইতালির পুলিশ। বাংলাদেশে সে গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে ইতালির পুলিশও তাকে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে সোহেল ও জুয়েলের বাড়ি রাজধানীর দক্ষিণখান থানায়। মামলার অন্যান্য আসামি শিমুল, জুয়েল রানা, ইয়াছিন এর বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নবীনগর থানায়।
ডিবি’র সহকারী কমিশনার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রথমে অপহরণকারীকে উদ্ধারে মাঠে নামি। এরপর আসামিদের গ্রেপ্তার করা হলে খুনসহ আরো বেশ কয়েকটি ভয়াবহ অপরাধ। শুধু দেশেই নয়, তাদের একজন বিদেশেও খুন করে এসেছে। এসব ঘটনায় অপহরণ ও অস্ত্র আইনে দু’টি মামলা হয়েছে বলেও জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.