মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে ত্যাগী ও সক্রিয়রা

বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির যেসব সাবেক এমপি-মন্ত্রী সক্রিয় ছিলেন, আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকবেন তারাই। জেল-জুলুমসহ নানা ধরনের নির্যাতন উপেক্ষা করে দলকে সংগঠিত করেছেন- এমন ত্যাগী নেতাদেরই দেয়া হতে পারে অগ্রাধিকার। এসব নেতার মধ্যে বয়সে তরুণ ও ক্লিন ইমেজধারীরাই মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন। অন্যদিকে ক্ষমতায় থাকাকালে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ ছিল, তাদের পাশাপাশি কথিত সংস্কারপন্থী এবং আন্দোলন-সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় সাবেক এমপি-মন্ত্রীদের মনোনয়ন পাওয়া এবার কঠিন হতে পারে। দীর্ঘদিন এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা, সরকারের সঙ্গে গোপন আঁতাতসহ যারা শারীরিকভাবে অসুস্থ, তারা মনোনয়ন না পাওয়ার শঙ্কায় আছেন। শুধু তা-ই নয়, যেসব সংসদীয় আসনে অন্তর্দ্বন্দ্ব চরমে, সেখানে সাবেক এমপিকে মনোনয়ন না দিয়ে তৃতীয় কোনো নেতাকে মনোনয়ন দেয়া হতে পারে। বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। এদিকে সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা যেখানে মনোনয়নবঞ্চিত হবেন, সেসব আসনে বিএনপি নেতাদের পাশাপাশি ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের অনেকেই মনোনয়ন পেতে পারেন- এমন প্রত্যাশায় তারা মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। পাশাপাশি দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম ও দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় থাকার পরও সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের অনেকে তাদের নির্বাচনী এলাকায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। যে কোনো মূল্যে দলীয় মনোনয়ন পেতে শুরু করেছেন লবিং-তদবির।
আগামী নির্বাচনে কারা মনোনয়ন পেতে পারেন জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হতে হবে। সেই নির্বাচনে বিএনপিও অংশ নেবে। আর এমন নির্বাচনের জন্য বিএনপি সব সময়ই প্রস্তুত। সাধারণ মানুষ ও দলে যাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, এমন নেতাদেরই দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে। সাবেক মন্ত্রী বা এমপি যাই হোক, সেটা বড় বিষয় নয়। স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাকে এমপি হিসেবে চায় কিনা, সেটাই হচ্ছে বড় ব্যাপার। মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মতামতকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে জানান দলটির এ নীতিনির্ধারক। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট- দুর্নীতিবাজ, নিষ্ক্রিয়তার ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই। আমাদের প্রত্যাশা- দলের এ ধরনের সাবেক মন্ত্রী-এমপিরা আগামী নির্বাচনে কোনোভাবেই মনোনয়ন পাবেন না। যতদূর জানি, দলের হাইকমান্ডও এ নিয়ে বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। তারপরও যদি ফাঁকফোকর দিয়ে কোনোভাবে দুর্নীতিবাজ, নিষ্ক্রিয় কেউ মনোনয়ন নেয়ার চেষ্টা করেন, তাদের আমরা ওয়ান-ইলেভেনের মতো প্রতিহত করব। এ ব্যাপারে তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও বেশ সতর্ক। ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-২ আসন থেকে এমপি হয়েছিলেন আলী আজগর লবী। বিগত ওয়ান ইলেভেন সরকার আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় গ্রেফতারও হন তিনি। জামিনে ছাড়া পেয়ে বিদেশে পাড়ি জমালে তিনি আর দেশে ফেরেননি। এ ধরনের নেতাদের মনোনয়ন দেয়ার বিষয়ে বিএনপি সতর্ক থাকবে। মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে অসুস্থদের বিবেচনায় নাও নেয়া হতে পারে। মূলত এ ধরনের আসনগুলোতেই তরুণদের মনোনয়ন দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। ২০০১ সালে রাজশাহীর (চারঘাট বাঘা) থেকে কবির হোসেন ও বাগমারা-মোহনপুর থেকে আবু হেনা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এদের মধ্যে কবির হোসেন শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় তার নির্বাচন করার সম্ভাবনা কম। এ আসনে আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলসহ জেলা বিএনপির একাধিক নেতা মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আর আবু হেনা সংস্কারপন্থী ও বিভিন্ন সময়ে বিএনপি নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করায় তাকে মনোনয়ন দেয়ার সম্ভাবনা কম। নওগাঁ-৬ থেকে ২০০১ সালে এমপি ছিলেন আলমগীর কবির। তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। পটুয়াখালী-২ থেকে ২০০১ সালে এমপি হয়েছিলেন শহিদুল আলম তালুকদার। সংস্কারপন্থী অভিযোগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে তার পরিবর্তে ইঞ্জিনিয়ার ফারুক তালুকদারকে মনোনয়ন দেয়া হয়।
কিন্তু ফারুক তালুকদারের বিরুদ্ধে তৃণমূলের নানা অভিযোগ রয়েছে। তিনি এলাকায় না গিয়ে ঢাকায় ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। তাই আগামী নির্বাচনে তাকে বিবেচনা করা হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে। নবম সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-৬ থেকে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন সাবেক এমপি মেজর (অব.) মঞ্জুর কাদের। বর্তমানে তিনি শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ। এ আসনে ছাত্রদলের সাবেক এক নেতা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। ফরিদপুর সদর আসন থেকে কয়েকবার এমপি নির্বাচিত হন সাবেক মন্ত্রী চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ। সংস্কারপন্থী হওয়ার কারণে নবম জাতীয় সংসদে তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। ওই আসনে জোটের পক্ষে মনোনয়ন পান জামায়াতের আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে এরই মধ্যে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। এ আসন থেকে আবারও মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ। সংস্কারপন্থী হওয়ার কারণে এখনও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। তার পাশাপাশি যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুবুল হাসান ভুইয়া পিংকুও মনোনয়ন পাওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন। বিগত উপজেলা নির্বাচনে সদর থেকে তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন। অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হলেও ধানের শীষের পক্ষে প্রায় এক লাখ ভোট পান তিনি। শহীদুল হক জামাল বরিশাল-২, ইলেন ভুট্ট ঝালকাঠি-২, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী পটুয়াখালী-১ থেকে এমপি নির্বাচিত হন। কিন্তু শহীদুল হক জামাল ওয়ান ইলেভেনে সংস্কারপন্থী অংশের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। ইলেন ভুট্ট দীর্ঘদিন থেকেই নিষ্ক্রিয়। আলতাফ হোসেন চৌধুরী সংস্কারপন্থী অংশের হলেও তিনি মূলধারার রাজনীতিতে ফিরেছেন বেশ আগেই। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যানের পাশাপাশি পটুয়াখালী জেলা বিএনপির সভাপতিও তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ- তিনি নিয়মিত ঢাকাতেই অবস্থান করেন। এ অবস্থায় পটুয়াখালীতে তার বিপক্ষে দলের বড় একটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে গেছে। এ কারণে বলা যায়, পটুয়াখালীর দলীয় কর্মকাণ্ড স্থবির। এ অবস্থার শেষ পর্যন্ত সমাধান না হলে মনোনয়ন নিয়ে শঙ্কায় পড়তে পারেন আলতাফ হোসেন চৌধুরী। চলমান সংকট নিরসন না হলে ওই এলাকার এক শিল্পপতিকে মনোনয়ন দেয়া হতে পারে বলে দলীয় সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে।
আলতাফ হোসেন চৌধুরী বিদেশে থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। নাটোর-১ থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য ফজলুর রহমান পটল মারা যাওয়ায় এ আসনে মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদকসহ একাধিক নেতা। একই অবস্থা পঞ্চগড়-২ আসনেও। সেখানকার সাবেক এমপি মোজাহার হোসেন মারা যাওয়ায় ছাত্রদলের সাবেক নেতা একক প্রার্থী হিসেবে এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। মাদারীপুর-১ থেকে ২০০১ সালে প্রথমে মনোনয়ন পান সাবেক মহিলা এমপি নাবিলা চৌধুরী। কিন্তু পরে তা পরিবর্তন করে ঠান্ডু চৌধুরীকে দেয়া হয়। ঠান্ডু চৌধুরী বর্তমানে অসুস্থ। এ আসনে মনোনয়ন দৌড়ে ছিলেন দুই নেতা। তাদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। ফলে অপর নেতা জামান কামাল মোল্ল্যা নুরুদ্দিনের ভাগ্যে মনোনয়ন শিকে ছিঁড়তে পারে বলে দলের সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া আইনি জটিলতার কারণে মনোনয়নবঞ্চিত হতে পারেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু প্রমুখ। তৃণমূলের নেতা বরিশাল উত্তর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমরা যারা তৃণমূলে রাজনীতি করি, তারা সবাই বর্তমান সরকারের সীমাহীন নির্যাতনের শিকার। এর আগে ওয়ান ইলেভেনের কঠিন মুহূর্তেও আমরা আমাদের নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের মতো তৃণমূল নেতাকর্মীদের ত্যাগের বিষয়টি দলের হাইকমান্ডও জানেন। দল পুনর্গঠনে চেয়ারপারসন যেমন তৃণমূলের মতামত আমলে নিচ্ছেন, তেমনি সামনে দলের মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রেও তৃণমূল নেতাকর্মীদের মতামত নেবেন। এটা আমাদের প্রত্যাশা নয়, এটা চেয়ারপারসনের কাছে আমাদের দাবি। তিনি বলেন, যদি তৃণমূলের মতামতে মনোনয়ন দেয়া হয়, তাহলে অর্ধশতাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপির এবার মনোনয়ন মিলবে না।

No comments

Powered by Blogger.