শুধু শ্রমিকদের মজুরি নেই!

সৌদি আরব তাদের দেশে কর্মরত বিদেশি শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারছে না। এই খবরটি সৌদি রাজতন্ত্রের বাইরে তেমন একটা ছড়ায়নি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দেশটির বড় নির্মাণপ্রতিষ্ঠান বিন লাদেন গ্রুপকেও সরকার বিল দিতে পারেনি। এ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর একটি অংশ ও অন্যান্য শ্রমিকদেরও সে বেতন দিতে পারেনি। কেউ কেউ সাত মাস ধরে বেতন পাচ্ছে না। ভারত ও পাকিস্তান দূতাবাস সৌদি সরকারের কাছে দেনদরবার করছে, তাদের শ্রমিকদের মজুরি যেন পরিশোধ করা হয়। ব্রিটিশ সরকারের মতো যে অর্থনীতিবিদেরা সৌদি রাজতন্ত্রের ব্যাপারে গদগদ, তাঁরা নিরবচ্ছিন্নভাবে বলে যাচ্ছেন, তেলের দাম পড়ে যাওয়ার কারণে সৌদি সরকারের অবস্থা টালমাটাল হয়ে গেছে। তবে তাঁরা এমন কথা বলেন না, যেটা শুনলে পৃথিবীর বাকি দেশগুলো ভীতবিহ্বল হয়ে যায়: দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও সিংহাসনের উত্তরাধিকারী উপযুবরাজ মোহামেদ বিন সালমানের নৈরাশ্যজনক ও নিষ্ফলা ইয়েমেন যুদ্ধ। গত বছর সৌদি রাজার প্রিয় যুবরাজ ইয়েমেনের হুতিদের বিরুদ্ধে এই হাস্যকর যুদ্ধ শুরু করার পর সৌদি ও আমিরাতের বিমানগুলো সেখানকার যত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ওষুধের গুদামে বোমা ফেলেছে, যুক্তরাষ্ট্র সার্বিয়া ও আফগানিস্তানে সম্মিলিতভাবেও সে পরিমাণ বোমা ফেলেনি। তো এর ফলাফল কী? যে দেশটিতে পৃথিবীর ১৬ শতাংশ পরীক্ষিত তেলের মজুত রয়েছে, যেখানকার আরামকো কোম্পানি দিনে এক বিলিয়ন ডলার উপার্জন করে
 এখন সেই দেশটির বাজেট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার, যারা শ্রমিকদের বিল দিতে পারছে না। প্রথম দিকে ইয়েমেনের এই বোমাবর্ষণের ঘটনাকে ‘অপারেশন ডিসাইসিভ স্টর্ম’ বলা হতো, যেটা পরবর্তীকালে ‘অপারেশন রেস্টোর স্টর্ম’ নাম ধারণ করে। মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাসে এটা ‘দীর্ঘতম’ ও সবচেয়ে অকার্যকর যুদ্ধে পরিণত হলে এর নাম পরিবর্তন হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুক্তরাজ্যের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় এ যুদ্ধ চলছে। ফলে সৌদি আরবের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী উপযুবরাজ মোহামেদ যখন বলেন, এ বছর বেতন-ভাতা খাতে রাষ্ট্রের ব্যয় কমবে, যদিও মানুষের আয় বাড়বে—তখন বিস্ময়ের কিছু নেই। পাকিস্তানে এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে, যদিও ‘সৌদি’ সেনাবাহিনীর একটি বড় অংশ পাকিস্তানি। দেশটির সাংসদেরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন, তিনটি সৌদি কোম্পানি কেন আট মাস ধরে বেতন দিচ্ছে না, এমনকি তারা কর্মীদের খাবার দিতেও অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সৌদিতে বসবাসরত পাকিস্তানিরা স্বদেশিদের খাওয়াচ্ছে। সৌদি আরব এই সংকট মোকাবিলা করতে পারছে না। আরব নিউজ বলেছে, ৩১ হাজারেরও বেশি সৌদি ও অন্যান্য শ্রমিক বকেয়া মজুরি পরিশোধের দাবিতে শ্রম মন্ত্রণালয়ের কাছে আরজি জানিয়েছেন। একবার তো দেখা গেল, ভারতীয় কনস্যুলেট ও প্রবাসীরা শ্রমিকদের খাবার কিনে দিচ্ছেন, যাতে তাঁদের নাগরিকদের অভুক্ত থাকতে না হয়।
কথা হচ্ছে, সরকারের কাছে নির্মাণ কোম্পানিগুলোর পাওনার পরিমাণ হয়তো বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এ নিয়ে সৌদি আরবের সংবাদমাধ্যমে খোলাখুলি বিদেশিদের সম্পর্কে অহেতুক ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে। সৌদি গেজেটে সাদ আল-আরাবি লিখেছেন: ‘অনেক প্রবাসীই আমাদের ঘৃণা করে, আমাদের ওপর তারা ক্ষুব্ধ, কারণ আমরা ধনী দেশ। অনেকেই আবার এ কথা পর্যন্ত বলেন যে এত টাকাপয়সা আমাদের থাকা উচিত নয়। আর সে কারণেই সময়মতো মজুরি না পেয়ে তাঁদের অনেকেই সহিংস হয়ে উঠেছেন।’ তবে আমার মনে হয়, সৌদি আরবের অনেকেই জাবাত-আল-নুসরা (যাঁরা সম্প্রতি জাবাত ফতেহ্ আল-শামাল-নুসরাহ নাম ধারণ করেছেন) বা আল-কায়েদা ও আইএসকে টাকা দিচ্ছেন, যাঁরা সিরিয়ায় আগুনের গোলার মুখে আছেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ফিলিপাইন, ফ্রান্সসহ অনেক দূতাবাসই সৌদি সরকারের কাছে এ সমস্যাটি উত্থাপন করেছে। সৌদি সরকার যথারীতি বলেছে, তারা সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় বিপাকে পড়েছে, ফলে তারা কর্মীদের দেওয়া কথা রাখতে পারছে না। সৌদি সরকার অবশ্য কোম্পানিগুলোকে শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেছে।
এক কোম্পানির তরফে এই অসাধারণ বিবৃতিটি দেওয়া হয়েছে: ‘অনেকগুলো প্রকল্প বাতিল হয়ে যাওয়ায় কোম্পানি কিছুটা অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে।’ অন্যদিকে ইউনাইটেড সিম্যাক কনস্ট্রাকশন কোম্পানির কর্মীরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের অনেকেই দেড় বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন না। আবার তাঁদের নিজ দেশে যাওয়ার অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে না। তবে আরেকটি সমস্যাও আছে। সবাই মূলত বিন লাদেন ও ওগারের মতো বড় বড় কোম্পানি নিয়ে চিন্তিত। ফলে বড় কোম্পানি নিয়ে ডামাডোলের মধ্যে ছোট কোম্পানিগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, শিয়া হুতি, হিজবুল্লাহ এবং দামেস্ক ও ইরানের আলাওয়াইট সরকারের বিরুদ্ধে এই রাজতান্ত্রিক-একনায়কতন্ত্রের যুদ্ধ যেন শেষ হওয়ার নয়। সেখানে এক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। কথা হচ্ছে, সৌদি আরব কি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কৌশলী ও দীর্ঘমেয়াদি আল-ইয়ামামাহ্ অস্ত্র চুক্তি করেনি? যে চুক্তির আওতায় সে বহু বছর ধরে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে অস্ত্র কিনছে। তখন তো নগদ অর্থের সমস্যা হয়নি। আরবিতে ‘ইয়ামামাহ্’ শব্দের অর্থ কী? ‘ঘুঘু’? আসুন, আমরা এর বেশি আর না যাই।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য ইনডিপেনডেন্ট থেকে নেওয়া।
রবার্ট ফিস্ক: দ্য ইনডিপেনডেন্টের মধ্যপ্রাচ্য প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.