জন কেরির ঝটিকা সফর by জিয়াউদ্দিন চৌধুরী

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তাঁর নয় ঘণ্টার ঝটিকা সফর শেষ করে গেলেন সোমবার। সফরটি যে বহুদিনের পরিকল্পিত ছিল, এটি ভাববার কোনো কারণ নেই। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কোনো দেশে সফর করার অনেক আগে থেকে দুই দেশের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলে, অনেক দিন আগে থেকে সফরের এজেন্ডা তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে তা হয়েছে এমন কথা খুব একটা শোনা যায়নি। তবে এটা হঠাৎ করেও যে হয়েছে, তা-ও নয়। কারণ, এ সফরের বেশ কিছুদিন আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী কার্যকলাপ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছিল। কিছুদিন আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক সংবাদ সম্মেলনে আইএস জঙ্গিগোষ্ঠীর মোকাবিলা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৃঢ়সংকল্পের কথা বলতে গিয়ে জঙ্গিগোষ্ঠী পৃথিবীর যেসব দেশে প্রসার লাভ করেছে, তাতে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করেন। তিনি এ-ও বলেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশের সঙ্গে একযোগে কাজ করবে। সুতরাং এটা খুবই পরিষ্কার যে জন কেরির হঠাৎ বাংলাদেশ সফরের একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, যা বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী কার্যকলাপের সঙ্গে বৈদেশিক যোগাযোগের বিষয় সম্পর্কে আলোচনা এবং এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক করা (যা তঁার সফর শেষে মন্তব্যে উঠে এসেছে)। এ আলোচনা যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় আরও জরুরি হয়ে পড়ে যখন বাংলাদেশের সরকারি মহল থেকে প্রায়ই সব সন্ত্রাসী কাজকে বিরোধী দল-অনুপ্রাণিত বা গৃহজাত জঙ্গি দ্বারা সংঘটিত বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছিল। সফর শেষে জন কেরি তাঁর সফরকে সফল বলে মন্তব্য করে বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে প্রধানমন্ত্রী এবং আরও সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর আলোচনা সার্থক হয়েছে।
তিনি তাঁর আলোচনায় অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বললেও তাঁর মন্তব্যে সন্ত্রাস দমনের ওপরই বেশি জোর দিয়েছেন। এ ধরনের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সফরকে বিদেশি সফরকারীরা সাধারণত সফল বলে থাকেন, বিশেষভাবে সফরকারী যখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলোচনার সারাংশ। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস দমনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত এবং দুই দেশ এ ব্যাপারে তাদের আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর কাজের সমন্বয় করতে আগ্রহী। কেরির মন্তব্য আমাদের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক তিনটি কারণে। প্রথমত, সরকারি উচ্চমহলে এবং বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এ ধরনের সহযোগিতার কথা সন্ত্রাস দমনে সরকারের দৃঢ়তা ও স্থির প্রতিজ্ঞার পরিচায়ক; দ্বিতীয়ত, এটি পরোক্ষভাবে দেশে সাম্প্রতিক এবং অতীতে সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে বৈদেশিক যোগাযোগের সম্ভাবনা স্বীকার, তৃতীয়ত, সন্ত্রাস দমনে বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার অনুভব। তবে আমরা শুধু কেরির আশাব্যঞ্জক মন্তব্যের ওপর ভরসা করেই থাকতে পারি না। কেরির সফর সফল হবে যদি আমাদের সরকার শুধু কেরির সন্তুষ্টির জন্য নয়, আমাদের দেশের মঙ্গলের জন্যও জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস ঠেকাতে সরকারি কাজকর্মে এ ধরনের প্রত্যয় ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করে। আমার এ সংশয়ের কারণ ওই একই দিনে দেওয়া আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একই পুরোনো মন্তব্য যে বাংলাদেশে কোনো বিদেশি জঙ্গিগোষ্ঠী-অনুপ্রাণিত শক্তি নেই, যা আছে তা গৃহজাত। সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের বক্তব্য শুধু বিদেশিদের নয়,
দেশের জনসাধারণ এবং সর্বোপরি দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও বিভ্রান্ত করবে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, যা আজ বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে শুধু একক ব্যক্তিত্ব বা একক গোষ্ঠীর দ্বারা নয়, অন্তত আটটি গোষ্ঠী কাজ করছে বিভিন্ন দেশে। গোষ্ঠীগুলো পুরোপুরি সমন্বিত না হলেও তারা মোটামুটি একই আদর্শে অনুপ্রাণিত এবং তারা চায়, তাদের অনুসারী বৃদ্ধি পাক। আজ বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা যদি তাদের অনুপ্রেরণা ও আদর্শ কোনো বিদেশি উগ্রবাদী গোষ্ঠীর কাছ থেকে পায় বা তাদের কাছ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বরং আমরা আশ্চর্য হই এ দেখে যে বাংলাদেশে আইএস-অনুপ্রাণিত কার্যকলাপের বহুল প্রমাণাদির পরও আমাদের কারও কারও কাছে দেশে কোনো বিদেশি সন্ত্রাসীর হাত আছে বলে মনে হয় না। তাঁরা অনবরত তাঁদের একপেশে দৃষ্টি দিয়ে দেশের সন্ত্রাসী তৎপরতাকে রাজনৈতিক কুকর্ম বলে আখ্যায়িত করছেন। দেশে যখন একের পর এক সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ড হচ্ছে, যখন এ ধরনের কর্মকাণ্ডে বিদেশি জঙ্গিশক্তির সম্পৃক্ততার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে, তখন এ ধরনের মন্তব্য শুধু জনসাধারণকেই কুয়াশাচ্ছন্ন করে না, বিদেশে বাংলাদেশকে বিব্রত করছে। ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে জন কেরিকে যখন ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশে বিদেশি সন্ত্রাসীদের অস্তিত্ব বা তাদের অনুপ্রেরণা সম্পর্কে মাথা গুঁজে বসে আছে কি না, তিনি উত্তরে বলেন, তা তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকার দেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ এবং এতে বিদেশি সম্পৃক্ততা সম্পর্কে খুবই সচেতন। আমার বিশ্বাস, কেরি এ আশ্বাস পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও সরকারি ওপর মহল থেকে।
আমি এ-ও আশা করছি যে সত্যিই আমাদের সরকার সন্ত্রাস এবং এতে বিদেশি প্রভাবের ব্যাপারে মাথা গুঁজে বসে নেই। সন্ত্রাস বা জঙ্গি কর্মকাণ্ড দমন করতে যেসব প্রক্রিয়ার দরকার, তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে জঙ্গিবাদের উৎপত্তির কারণ এবং এর ইন্ধনদাতাদের খুঁজে বের করা। পরবর্তী পদক্ষেপের মধ্যে প্রধান হচ্ছে জঙ্গিবাদকে একটি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কুকর্ম মনে না করে দেশের স্থায়িত্বের প্রতি হুমকি বলে গণ্য করা। তবে এ ব্যাপারে আরও দরকার একটি মানসিকতার, যে মানসিকতা দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকে দেশের ও দশের স্বার্থে। আর এ হুমকি ঠেকাতে দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে সংঘবদ্ধ করা। আজ বাংলাদেশ বা বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় যে জঙ্গিবাদ ও সহিংস উগ্রবাদ চলছে, তাকে শুধু দেশীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে দেখলে চলবে না। এটা দেখতে হবে চলমান বিশ্ব পরিস্থিতি আর অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে। এটা দমন করতে আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রয়োজন। যেমন প্রয়োজন জঙ্গি দমনে নতুন প্রযুক্তি এবং এ ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা ও তাদের প্রজ্ঞা। জানি না জন কেরি শেষ কথা কী বলে গেছেন। তবে আমি আশা করি, তিনি জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যের হাত এগিয়ে দিয়েছেন। সহযোগিতা শুধু কথায় নয়, কাজেও হতে হবে। এটা হতে পারে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দমনে নতুন প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ ও তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে, যা যুক্তরাষ্ট্র দিতে পারে। আমি আশা করব, আমরা এ সুযোগ নেব।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী: রাজনৈতিক ভাষ্যকার।

No comments

Powered by Blogger.