ফুটবলের কারিগর ওয়াজেদ গাজীর খোঁজ রাখে না কেউ

স্মৃতিশক্তি অনেকটাই লোপ পেয়েছে। প্রশ্ন করলে কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন। অভাব তার আজ নিত্যসঙ্গী। ওষুধ কেনার পয়সাও তার নেই। তিনি আর কেউ নন। ফুটবলাঙ্গনের ‘ওস্তাদ’ খ্যাত ওয়াজেদ গাজী। কারও কাছে ‘ওস্তাদ’, আবার কারও কাছে ‘গাজী ভাই’ নামেই পরিচিত। এই দুই নামের আড়ালে তার ‘ওয়াজেদ’ নামটাই যেন হারিয়ে গেছে। মাসতিনেক আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে আরামবাগ ক্লাবে পড়েছিলেন। দু’দিন পর এক ফুটবলার ওয়াজেদ গাজীর নাতিকে ফোন করে তার নানার অবস্থা জানান। পরে ক্লাব থেকে মাইক্রোবাস ভাড়া করে ওস্তাদকে পাঠিয়ে দেয়া হয় যশোরে তার বড় ছেলে হাসান গাজী দুলুর কাছে। দিনদশেক পর দুলু বাবাকে দিয়ে আসেন একমাত্র বোনের বাসায়। তারপর থেকে মেয়ের বাসাতেই আশ্রয় হয়েছে বাংলাদেশে অসংখ্য ফুটবলার তৈরির কারিগর ওয়াজেদ গাজীর। গত বছর স্ত্রীকে হারিয়ে এমনিতেই মুষড়ে পড়েছিলেন। তারও আগে নিজের অসুস্থতাকালীন সময়ে পণ্ডিত পুকুরের হালদা রোডের বাড়িটি বিক্রি করতে হয়। কপর্দকশূন্য ওয়াজেদ গাজীর খোঁজ নেয়ার আজ আর কেউ নেই। ফুটবলার, কোচ ওয়াজেদ গাজী খেলার মাঠকে ভালোবেসে সারা জীবন ক্লাব পাড়াতেই কাটিয়ে দিয়েছেন।
২০১২ সালের শুরুতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে দিনপনেরো পর আবার মাঠে ঠিকই ফিরে এসেছিলেন। ২০১৩ সালে বিজেএমসি কিংস কাপ খেলতে ভুটান সফর করেন। শত বারণ সত্ত্বেও অসুস্থ গাজীকে দলের বাইরে রাখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ২৩০০ মিটার উচ্চতার থিম্পুতে গিয়ে ঠিকই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পাঁচতলা টিম হোটেলের সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করায় আবার হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। ৮৫ বছর পার করেও ওয়াজেদ গাজী স্বপ্ন দেখেন মাঠে ফেরার। মাঠেই যেন তার মৃত্যু হয়- সেই কামনা করেন। আদি নিবাস সাতক্ষীরার ধলবাড়ীয়া। ১৯৬৩ সালে যশোরে বাড়ি করেন। দুই ছেলে ও এক মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে ছিল তার সংসার। ছেলেমেয়েরা সবাই বিবাহিত। বছরখানেক আগে সহধর্মিণীকে হারিয়েছেন ওয়াজেদ গাজী। তার বাবা সোলেমান গাজী কলকাতার বিখ্যাত জোসেফ কোম্পানিতে চাকরি করেতেন। পশ্চিমবাংলার চব্বিশ পরগনার বারাসাতে জন্ম তার। শৈশবে কলকাতায় ছিলেন। সেখানে থাকাকালীন ওয়াজেদ গাজী চাকরি করতেন ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডে। এ বোর্ডের হয়ে অফিস লীগেও খেলতেন সেখানে। পরে ঢাকায় এসে চাকরি পান বিজি প্রেসে। সেই চাকরির সামান্য বেতনে মা-ভাইবোন, স্ত্রী ও তিন সন্তানের ভরন-পোষণ করেছেন। বর্ণাঢ্য জীবনের পরিক্রমা শেষে পেছনে তাকালে ওয়াজেদ গাজীর সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে একটি নাম তিনি রমণী সরকার। ১৯৫৮ সালে তার কাছেই হাতেখড়ি হয়।
১৯৫৮ সালে স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে কলকাতা লীগে অভিষেক হয় ছোট্ট এক কিশোরের। কলকাতা স্পোর্টিং ইউনিয়নের হয়ে জুনিয়র ফুটবলারদের প্রশিক্ষণ দিতেন রমণী সরকার। গাজী তার নিজের ওস্তাদকে কৃতজ্ঞভরা চিত্তে স্মরণ করে বলেন, ‘উনার বদৌলতেই তো ফুটবলার হয়েছি।’ ১৯৬৩ সালে কলকাতা মোহামেডানে খেলেছিলেন। তারপর ফিরে আসেন দেশে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিজি প্রেসে প্রথম নাম লেখান। তারপর ওয়ান্ডারার্স, ইপিআইডিসি (পরে বিজেএমসি), মোহামেডানে খেলে ’৭৬-এ ফিরে আসেন ওয়ান্ডারার্সে। পাঁচবার ছিলেন ঢাকা লীগ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য। তবে ’৭৭ সালে ঢাকার মাঠ ছাড়লেও যশোর জেলা দলের হয়ে খেলেছেন আশির দশকের শেষ অবধি। ১৯৭৮ সালে কোচ হিসেবে আত্মপ্রকাশ হয় তার। তখন যশোর ক্যান্টনমেন্টের বিভিন্ন ইউনিট টিমকে অনুশীলন করান। রহমতগঞ্জের মোহাম্মদ আমিন ওয়াজেদ গাজীর জীবনের বাঁক বদলে দেন। রহমতগঞ্জের কোচের দায়িত্ব নিয়ে ’৮৩ পর্যন্ত কাটিয়ে দেন। পরের দু’মৌসুম ছিলেন আরামবাগে। ১৯৮৬ থেকে ’৮৮ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার কোচ ছিলেন। ১৯৮৭ সালে জাতীয় দলের কোচও হয়েছিলেন স্বল্প সময়ের জন্য। পরের বছর তার ঠিকানা হয় ফরাশগঞ্জে।
১৯৯০ সালে আরামবাগে ফিরেন। ’৯৬ থেকে ২০০২ পর্যন্ত ছিলেন আরামবাগের কোচ। দীর্ঘ কোচিং ক্যারিয়ারের প্রায় অর্ধেকটাই আরামবাগে কাটানোর পর ২০০৩ সালে যোগ দেন শেখ রাসেলে। তারপর ব্রাদার্স, বিজেএমসি হয়ে আবারও আরামবাগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ওস্তাদ ওয়াজেদ গাজী। ৬০ বছর কাটিয়েছেন ক্লাব পাড়ায়। প্রত্যেক বছরেই দলগুলো তাকে কোচিং করানোর প্রস্তাব দিত। তিনি কখনোই কারও মুখাপেক্ষী হতেন না। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) তাকে মূল্যায়ন না করলেও ক্রীড়া সাংবাদিক সংস্থা তাকে সেরা কোচের পুরস্কার দিয়েছিল। এক ক্লাবের কোচ হয়েও ওয়াজেদ গাজী কখনোই বসে থাকতেন না। সময় পেলেই ছুটে যেতেন বিভিন্ন ক্লাবের অনুশীলনে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগের খেলাও মাঠে গিয়ে দেখতেন। জাতীয় দলের কোচদের অনুশীলন দেখতেন দূর থেকে দাঁড়িয়ে। চেষ্টা করতেন কোচিংয়ের নতুন নতুন পদ্ধতি শেখার। ফুটবল জীবনে অনেক নামকরা খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলেছেন। তাদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করেছেন। কোচিংয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই ওয়াজেদ গাজীর। এএফসির ‘এ’, ‘বি’ কিংবা ‘সি’ লাইসেন্স কোর্স সম্পর্কে জানা ছিল না তার। জানতেও চাননি কখনও।
জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের সাবেক কোচ আনোয়ার হোসেনকেই দীক্ষাগুরু মানতেন তিনি। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে ওস্তাদ বলেন, ‘ভারতের সুকুমার সমাজপতি, পিনাক ব্যানার্জি, অরুণ ঘোষ, চুনী গোস্বামী, বাংলাদেশের গোলাম সারোয়ার টিপু, কায়কোবাদের সঙ্গে খেলেছি এবং শেখার চেষ্টা করেছি। বলতে দ্বিধা নেই, পদ্ধতিগত কোনো সমস্যায় পড়লে টিপুর কাছে (গোলাম সরোয়ার) সাহয্য চাইতাম। দিল্লি এশিয়াডের আগে ১৯৮২ সালে স্মিথ নামে এক জার্মান ফুটবল কোচের প্রশিক্ষণ কৌশল আমার এখনও চোখে লেগে আছে।’ কোচিংয়ে আমার বীজমন্ত্র ছিল ফিটনেস উইথ দ্য বল।’ তার কথা, ‘প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলের সিনিয়র সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করতাম। সেখান থেকে বড়জোর ম্যানেজার হতে পারতাম। কিন্তু কে চিনত আমাকে? আজ আমাকে সবাই চেনেন। জীবনে অনেক ফুটবলার তৈরি করেছি। একসময় কোচদের তেমন কেনা সুযোগ-সুবিধা ছিল না। অনুশীলনের জন্য দশটা বলও পেতাম না। এখন তো অনেক সুযোগ পাচ্ছেন কোচরা।’ আশিষ ভদ্র, কায়সার হামিদ, অলক, ইমতিয়াজ সুলতান জনি, আলফাজদের মতো সাবেক তারকা খেলোয়াড়রাও কোচ হিসেবে তাকে পেয়েছেন। তৈরি করেছেন শত শত ফুটবলার। কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে পাননি কোনো স্বীকৃতি। এখন পাচ্ছেন না তিনবেলা ভালো-মন্দ খাবার। অসুখে জোটে না ওষুধ।

No comments

Powered by Blogger.