জেলা পরিষদ নিয়ে কিছু সুপারিশ

স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আশা করা যায় ২০১৬ সালের মধ্যে দেশের সমতলভূমির ৬১টি জেলা পরিষদে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দায়িত্ব নিতে পারবেন। সরকার নির্বাচিত জেলা পরিষদ পুনর্গঠন করলে দেশের স্থানীয় সরকারের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটবে। জেলা পরিষদ উপমহাদেশের স্থানীয় শাসন ও উন্নয়নের ইতিহাসে ১৩০ বছরের উত্তরাধিকার বহন করে। জেলা প্রশাসন সৃষ্টির (১৭৭২) ১১০ বছর পর ১৮৮২ সালে লর্ড রিপনের ঐতিহাসিক রেজল্যুশনের মাধ্যমে তিন স্তরের গ্রামীণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন হয়। তাতে স্থানীয় ‘জেলা বোর্ড’ অত্যন্ত শক্তিশালী প্রশাসনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের প্রথম দশক পর্যন্ত ওই পদ্ধতি বজায় ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেলা পরিষদের সুরম্য ভবন, জনবল, প্রচুর নিজস্ব সম্পদ ও জাতীয় বাজেটের নিয়মিত বরাদ্দ সত্ত্বেও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি রহস্যজনক কারণে আড়ালে পড়ে যায়। ১৯৭৫ সালে জেলায় ‘গভর্নর’ নিয়োগ করে জেলা প্রশাসকসহ জেলার সামগ্রিক প্রশাসনকে তার অধীন করে একটি কাঠামো প্রতিষ্ঠার চিন্তা করা হয়। পরে বিএনপির শাসনামলে ‘জেলা উন্নয়ন সমন্বয়ক’ নামে একটি পদ সৃষ্টি করে প্রতিটি জেলায় রাজনীতিবিদদের মধ্য থেকে ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরশাদ আমলে পদটি বাতিল হয়; ১৯৮৮ সালের একটি নতুন আইনবলে সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়।
১৯৯০-এর পরে তা বাতিল হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের সরকার গঠিত হওয়ার পর ২০০০ সালে জেলা পরিষদ আইন পাস করা হয়। কিন্তু পাস হওয়ার ১১ বছর পরও ওই আইন কার্যকর করা হয়নি। পরে ২০১১ সাল আইনের ৮২(১) ধারার অধীনে জেলা পরিষদের প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে ওই আইন কার্যকর হয়। কথা ছিল প্রশাসক নিয়োগের ছয় মাসের মধ্যেই আইন অনুযায়ী জেলা পরিষদ নির্বাচন হবে, তা হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে ধারণা, সরকার ২০১৬ সালের মধ্যে জেলা পরিষদ নির্বাচন দিতে যাচ্ছে এবং স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠিত হতে যাচ্ছে। এ প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য। নির্বাচনী প্রক্রিয়া, পদ্ধতি ও তার ফলাফল কীরূপ হবে সে সম্পর্কে কোনো আগাম মন্তব্য না করেও বলতে চাই, জেলা পরিষদ নানা অনিশ্চয়তার স্তর পার হয়ে একটি স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো পেতে যাচ্ছে এ নির্বাচনের মাধ্যমে। তাই ব্যবস্থাটি আরও টেকসই ও গণতান্ত্রিক হোক, এ লক্ষ্যে ওই আইনের কিছু সংশোধনী সুপারিশ করা সংগত মনে করি। ইতিপূর্বে এ বিষয়ে প্রথম আলোয় (২৮-১১-২০১১ এবং ৪-০১-২০১২) আমার দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই লেখায় নতুন কিছু সুপারিশ যুক্ত করা হলো। প্রথমত, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশনসহ অন্য সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান আইন ও বিধিসমূহের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু আছে কি না, তা পর্যালোচনা করা দরকার এবং যে পটভূমিতে ২০০০ সালে জেলা পরিষদ আইন তৈরি হয় তার প্রেক্ষাপট অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং বিশেষত, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের কর্মধারার আলোকে জেলা পরিষদেও অনুরূপ বিষয়ের সংযোজন প্রয়োজন। পরিকল্পনা, বাজেট এবং উন্নয়ন সমন্বয়ের বিধানসমূহের আরও স্পষ্টকরণ প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, জেলা পর্যায়ে কর্মরত জেলা প্রশাসন, রেগুলেটরি ও উন্নয়ন বিভাগসমূহের সঙ্গে পরিষদের সম্পর্কের বিষয়ে আইনে বিস্তারিত কিছু দেখা যায় না। সংবিধান অনুযায়ী উন্নয়ন ও সেবার ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের দায়িত্ব ও ভূমিকা এ ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য।
তৃতীয়ত, জেলা পরিষদ আইন, ২০০০-এর ধারা ৩০ বলে জেলার সব জাতীয় সংসদ সদস্যগণ ‘জেলা পরিষদের উপদেষ্টা হইবেন এবং তাঁহারা পরিষদকে উহার কার্যাবলি সম্পাদনে পরামর্শ প্রদান করিবেন’ মর্মে যে ধারাটি আছে, তা উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের অভিজ্ঞতার আলোকে পুনরায় বিচার-বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে। চতুর্থত, জেলা পরিষদ আইনের ১৪ থেকে ১৮—এ পাঁচটি ধারা পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। দেশের সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নাগরিকেরা সরাসরি নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকেন। কিন্তু জেলা পরিষদ নির্বাচনে সাধারণ ভোটারের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। এ বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় বিশেষ ‘নির্বাচকমণ্ডলীর’ পরিবর্তে জেলার জনসংখ্যা, আকার ও ভোটার সংখ্যার ভিত্তিতে জেলায় জেলায় জেলা পরিষদের নির্বাচনী ওয়ার্ড সৃষ্টি করে জনগণের সরাসরি ভোটে জেলা পরিষদের সদস্যগণ নির্বাচিত হওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। নির্বাচিত সদস্য/সদস্যাদের মধ্য থেকে পরে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান বা একটি ‘নির্বাহী কাউন্সিল’ গঠিত হতে পারে। বাকি সদস্যরা নির্বাহী দায়িত্বের বাইরে বিধানিক সদস্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন। ভারতে অন্তত এভাবে জেলা পরিষদসমূহ পরিচালিত হয়। বিরাজিত আইন (জেলা পরিষদ আইন, ২০০০) সংবিধান ও দেশের প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তা ছাড়া, জেলা পরিষদকে ঘিরে জনমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরিভাবে এ আইনে প্রতিফলিত হয়নি। তাই জেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে এ আইনের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা এবং বাংলাদেশের অতীতের জেলা পরিষদের কর্মকাণ্ড, বর্তমান জেলার প্রশাসন ও উন্নয়নের সমস্যাসমূহের সবিস্তারে আলোচনা-পর্যালোচনা প্রয়োজন। তা ছাড়া, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় প্রভৃতি রাজ্যের জেলা পরিষদসমূহ কীভাবে কাজ করছে, তাও সঙ্গে সঙ্গে পর্যালোচনা করে দেখা যেতে পারে। এ সবকিছু বিবেচনা করে আইনের যথাযথ সংশোধনের পর নির্বাচন অনুষ্ঠান করাই সংগত। আশা করব, সরকার আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের নেতা-নেত্রী, অন্যান্য দল এবং নাগরিক সমাজের মতামত গ্রহণ করে জেলা পরিষদ আইন, ২০০০-এর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ: স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ।
tofail101@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.