আলু পোড়া র সুযোগ কে হারাতে চায়!

কারও ঘর যখন পুড়ছে তখন তা নেভানোর চেষ্টা না করে সুযোগ বুঝে সেখানে আলু পোড়া দিয়ে খাওয়ার লোভ আমাদের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে ভালোভাবেই শিকড় গেড়েছে। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনা ঘটিয়ে জঙ্গিরা যে আগুন লাগিয়েছে, সেখানে কেউ আলু পোড়া দিয়ে খেতে চাইবে না, তা কী করে হয়! যে ঘরে আগুন লাগিয়েছে জঙ্গিরা, তার মালিক জনগণ। এই আগুনে তারা যখন পুড়ছে, তখন সেখানে আলু পুড়িয়ে খাওয়ার লোভটি মনে হয় কেউ–ই সামলাতে পারছে না। বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষ ও দল, সরকারি দল অথবা ডান-বাম কে-ই বা বাদ থাকছে! গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার পর ঈদের দিনের এক শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের অভাবে দেশে একের পর এক জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটছে। সরকারের উচিত ব্যর্থতার দায় নিয়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া। খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের সমালোচনা করে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন লিখেছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের বাস মিস করে তিনি এখন যত তাড়াতাড়ি একটা নির্বাচন করা যায় তার জন্য ব্যস্ত। এখনো তিনি তাঁর পূর্বতন দাবি অনুযায়ী কেবল তথাকথিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিতে চান। সেই স্বপ্ন তিনি ছাড়েননি। গুলশান-শোলাকিয়ার ঘটনা তাঁর জন্য এক মোক্ষম সুযোগের সৃষ্টি করেছে।
তিনি তাই “ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া” দিতে চান। গুলশান বা শোলাকিয়ার ঘটনায় তিনি যতখানি না নিন্দা করেছেন, তার চেয়ে বেশি নিন্দা করেছেন সরকারকে। ঈদের দিন সমাগত অনুগতদের সামনে বক্তৃতায় তিনি শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদকে “স্বাস্থ্যবান” করার অভিযোগ এনেছেন এবং শেষে পরিষ্কার করে বলেই ফেলেছেন জঙ্গিরা তাঁর কাজ করে ফেলেছে। এখন সরকারের উচিত পদত্যাগ করে নির্বাচন দেওয়া। জঙ্গির দেওয়া আগুনে তিনি এই আলুই পোড়া দিতে চান। আমাদের দুর্ভাগ্য, এমন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে আমরা পড়েছি, যেখানে যেভাবেই হোক ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় গেলে যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকাই হচ্ছে মূল কথা। দেশের এই দুর্যোগের সময় বিএনপি বা এর প্রধান খালেদা জিয়া যদি রাশেদ খান মেননের কথা অনুযায়ী ঘর পোড়ার সুযোগে আলু পোড়া দেওয়ার স্বপ্ন দেখে থাকেন, তবে আমাদের মতো জনগণের অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জ্বালানো-পোড়ানোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর খুব আপত্তি আছে বলে মনে হয় না। আর বিএনপির অবরোধ আন্দোলনের সময় পেট্রলবোমা ও মানুষ পুড়িয়ে মারা তো এই সেদিনের ঘটনা। এখন জঙ্গিদের জ্বালানো আগুনে বিএনপি ক্ষমতায় যাওয়ার আলুপোড়া দিতে চাইবে, এটাই তো আমাদের রাজনীতি! খুব স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি বা খালেদা জিয়ার এখন আগ্রহ যেভাবেই হোক একটি নতুন নির্বাচন ও তার মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ নেওয়া।
জঙ্গিবাদের ছড়িয়ে পড়া আগুন আদৌ তাঁদের মাথাব্যথার কোনো বিষয় নয়। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার পর আমরা তাই জঙ্গিবাদের বিপদ নিয়ে তাঁর মুখে তেমন কিছু শুনলাম না। খালেদা জিয়া স্বীকার করতে পারলেন না যে জঙ্গিবাদ তাঁদের শাসন আমলেও চরম আকার নিয়েছিল, বাংলা ভাই বা জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা তাঁদের ভুল ছিল। বর্তমান সরকারের সেই ভুল করা ঠিক হবে না। তাঁদের ভুল থেকে বর্তমান সরকার যেন শিক্ষা নেয় এবং সরকার ব্যর্থ হলে এই আগুনে আমাদের সবার পুড়তে হবে। তিনি নির্বাচনই চাইলেন। তাঁর নির্বাচনের দাবি তাই রাশেদ খান মেননের কথায় ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া দেওয়ারই চেষ্টা। এখন রাশেদ খান মেননের কাছে কিছু পাল্টা প্রশ্ন তুলতে চাই, বিএনপি না হয় ঘর পোড়ার সুযোগে আলু পোড়া দিতে চাইছে, কিন্তু তিনি, বর্তমান সরকারি দল বা জোটও কি তা-ই করছে না? জঙ্গিদের এই জ্বালানো আগুন যেন সরকারি দল ও তাদের নেতাদের বিএনপিকে আরও একহাত নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। গুলশান ও শোলাকিয়ার ঘটনার পর সরকারি দল ও জোটের সবাই তো দেখি বিএনপিকে গালাগালি দিতে নেমে পড়েছেন। এখন সরাসরিই দায়ী করা শুরু হয়েছে বিএনপিকে। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে দমনে সরকারের যতটা মরিয়া ভাব, জঙ্গি দমনে তো তা চোখে পড়ে না। জঙ্গিদের বিচারে সরকারের অনুমতির জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা কেন?
দেশে জঙ্গিবাদের বিকাশের পেছনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মন্তব্য অনুযায়ী বিভাজনের রাজনীতি বা দুর্বল গণতন্ত্রের দায়কে মানতে রাজি হননি রাশেদ খান মেনন। তাঁর কাছে জানতে চাই, বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার পেছনে দেশের বিভক্ত রাজনীতি বা গণতন্ত্রের দুর্বলতার যদি কোনো ভূমিকা না-ই থাকে, তবে তো বাংলাদেশের জঙ্গি তৎপরতাকে বিশুদ্ধ আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদের অংশ হিসেবেই দেখতে হবে। সরকার তবে কেন এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র বাতিল করে দিয়ে হোমগ্রোন হোমগ্রোন বলে জিকির করে যাচ্ছে?
ফ্রান্স বা বেলজিয়ামে কেন জঙ্গি হামলা হচ্ছে, সে প্রশ্নও তুলেছেন রাশেদ খান মেনন। বলেছেন, সেখানে তো বিভক্ত রাজনীতি নেই, গণতন্ত্রের অবস্থাও দুর্বল নয়। এ ধরনের সরল যুক্তির উত্তরে বলা যায়, ওই সব দেশে হামলাকারীরা বিদেশি বংশোদ্ভূত ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি হিসেবেই ওই দেশগুলোর স্বার্থে আঘাত হেনেছে। আমাদের দেশের মতো দেশি জঙ্গিরা নিজের দেশের স্বার্থের ওপর আঘাত হানছে না। যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দুনিয়া আন্তর্জাতিকভাবে ফিলিস্তিন, ইরাক বা সিরিয়া নিয়ে যে রাজনীতি করেছে, এসব হামলা কার্যত তারই প্রতিক্রিয়া। এর সঙ্গে সেই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সম্পর্ক নেই। আর এ ধরনের হামলার পেছনে বিরোধী দলকে দায়ী করার সংস্কৃতিও সেখানে নেই। সেসব দেশে সরকার বা বিরোধী দল কেউই ঘরপোড়ার মধ্যে আলুপোড়ার সুযোগ নেয় না। আর রাশেদ খান মেননের কথা অনুযায়ী, বিএনপি বা তার সহযোগী জামায়াত যদি দেশের এই চরম বিপদের মধ্যে বা যখন ঘর পুড়ছে তখন আলু পোড়ার মতো জঘন্য কাজে জড়িয়ে পড়ে, তবে তো এর জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকেই দায়ী করতে হচ্ছে। এর পেছনে বিভক্তির রাজনীতি বা দুর্বল গণতন্ত্র যা–ই থাক না কেন। আসলে ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়ার সুযোগ কেউই হারাতে চায় না। প্রশ্ন হচ্ছে সবাই আলু পোড়ানোর সুযোগ নিলে আগুন নেভাবে কে? জনগণকে মনে হয় পুড়তেই হবে!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.