‘না ভোট’ বেড়েছে যে কারণে

এমনটা আগে ছিল না ভারতবর্ষ কিংবা পশ্চিমবঙ্গে। যেকোনো নির্বাচনে প্রার্থী পছন্দ না হলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতেন না বা ভোট বর্জন করতেন। ফলে জানাও যেত না ওই সব প্রার্থীর প্রতি ভোটারদের সমর্থন কতটুকু বা অনীহা কতটুকু। কত শতাংশ ভোট ওই প্রার্থী পেলেন বা কত শতাংশ ভোটার ওই প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট দিলেন বা ভোট দিতে অনীহা প্রকাশ করলেন। তাই কারা প্রার্থীকে পছন্দ করছেন না তা জানার জন্য ভোটবাক্সে ‘না ভোট’ দেওয়ার একটি বিধান চালু করার জন্য ভারতে বহু দেনদরবার হয়েছে। দাবি উঠেছে অন্তত ভোট বাক্স বা ভোটযন্ত্রে ‘না ভোট’ দেওয়ার একটি বোতাম রাখা হোক। ভোটাররা জানাক কোন প্রার্থী তাদের পছন্দ বা অপছন্দের। অথবা কোনো প্রার্থীই তাদের পছন্দ নয়। অবশেষে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নির্বাচন কমিশনকে এক নির্দেশে জানিয়ে দেন ইলেকট্রনিক ভোটযন্ত্রে (ইভিএম) চালু করা হোক ‘না ভোট’ দেওয়ার একটি বোতাম।
সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশের পর নির্বাচন কমিশন ভোটযন্ত্রে এরপর চালু করে ‘না ভোট’ দেওয়ার একটি বোতাম। ভোটযন্ত্রে প্রার্থী তালিকার একেবারে শেষ প্রান্তে রাখা হয় ‘না ভোট’ বা নোটায় (None Of The Above) ভোট দেওয়ার বোতাম। এই নির্দেশের পর প্রথম ‘না ভোট’ দেওয়ার বিধান চালু করা হয় ২০১৪ সালে ভারতের লোকসভা নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে ‘না ভোট’ পড়ে ৫৯ লাখ ৯৭ হাজার ৫৪টি। ২০১৪ সালের সর্বশেষ এই লোকসভা নির্বাচনে ‘না ভোট’ বেশি পড়ে তামিলনাড়ুতে। এই সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৮২ হাজার ৬২টি। দ্বিতীয় স্থানে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। সেখানে ৫ লাখ ৬৮ হাজার ২৭৬টি ‘না ভোট’ পড়ে। আর এবার বিধানসভা নির্বাচনে তামিলনাড়ুতে ৫ লাখ ৬০ হাজার ৫৩৩টি, আসামে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৬৬টি, কেরালায় ১ লাখ ৭ হাজার ২৩৯টি ও পদুচেরিতে মাত্র ১৩ হাজার ২৪০টি ‘না ভোট’ পড়ে। পশ্চিমবঙ্গের এবারের বিধানসভা নির্বাচনে ‘না ভোট’ পড়ে ৮ লাখ ৩১ হাজার ৮৪৫টি।
ভোটের ফলাফল বের হওয়ার পর নির্বাচন কমিশন সূত্রে বলা হয়েছে, ২৯৪টি বিধানসভার আসনে এবার কমবেশি ‘না ভোট’ পড়েছে। বাঁকুড়া জেলার ছাতনা আসনে সবচেয়ে বেশি ‘না ভোট’ পড়েছে। এই সংখ্যা ৭ হাজার ৭০৯। আর সব থেকে কম ‘না ভোট’ পড়েছে হাওড়ার উত্তর আসনে। ১ হাজার ৭০টি। মুখ্যমন্ত্রী মমতার কলকাতার ভবানীপুর আসনেও ‘না ভোট’ পড়েছে ২ হাজার ৪৬১টি। এই কেন্দ্রে মমতার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কংগ্রেস নেত্রী দীপা দাসমুন্সি। আবার এই ‘না ভোট’ ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছে অন্তত ২৫ জন প্রার্থীর। কারণ, ওই সব আসনে জয়ী ও পরাজিত প্রার্থীদের ভোটের ব্যবধান ‘না ভোটে’র চেয়ে কম ছিল। ফলে রায়দিঘির তৃণমূল প্রার্থী অভিনেত্রী দেবশ্রী রায় এবং চন্দননগরের তৃণমূল প্রার্থী সংগীতশিল্পী ইন্দ্রনীল সেন জয়ী হতে পেরেছেন। ঠিক তেমনি জয়ী হয়েছেন বালুঘাটের বাম কংগ্রেস জোট প্রার্থী বিশ্বনাথ চৌধুরী এবং কুশমন্ডীর বাম কংগ্রেস জোট প্রার্থী নর্মদা রায়। আবার বাঁকুড়ার বড় জোড়ার পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী অভিনেতা সোহম চক্রবর্তী এবং পান্ডুয়ার তৃণমূল প্রার্থী ফুটবলার রহিম নবীও হেরেছেন। এখানে ‘না ভোটে’র যদি একটা অংশ তাঁরা পেতেন তবে জিততে পারতেন এবার তাঁরা। এভাবে এবার রাজ্যের অন্তত ২৫টি আসনে ফলাফল নির্ধারিত হয়েছে। অথচ এই ‘না ভোট’ দাতারা যদি জয়ী বা পরাজিত প্রার্থীর দিকে ঝুঁকতেন, তবে ফলাফল অন্য রকম হতো। পরাজিত প্রার্থীরা জিততে পারতেন। জয়ী প্রার্থীর ব্যবধান বাড়ত।
তাই এবারের ভোট থেকে একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে, মানুষের মধ্যে ‘না ভোট’ দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। কেন এই প্রবণতা বাড়ছে তা নিয়ে কথা হয় বেশ কজন ভোটারের সঙ্গে। তাঁরা বলেছেন, এখন ভোটের রাজনীতিতে অর্থের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। প্রার্থী মনোনয়নে দল এখন বিত্তবান প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দিচ্ছে। রাজনৈতিক যোগ্যতা না থাকলেও আর্থিক যোগ্যতা প্রার্থিতা নির্বাচনে তাঁদের যোগ্যতার মাপকাঠি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। ফলে যোগ্য ও ত্যাগী প্রার্থীরা আর ঠাঁই পাচ্ছেন না এখন ভোটের বাজারে। ঠাঁই পাচ্ছেন বিত্তশালী আর এলাকার ‘মাসলম্যানরা’। ফলে যোগ্য প্রার্থীদের যেমন ঠাঁই দিচ্ছেন না রাজনৈতিক দলের নেতারা, তেমনি অনেক মানুষও মনোনীত প্রার্থীদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ফলে বাড়ছে ‘না ভোট’ দেওয়ার প্রবণতা। অথচ এমনটা ছিল না এই রাজ্যের রাজনীতিতে। বিভিন্ন দল ঠাঁই দিত যোগ্য ও রাজনীতি নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করা ত্যাগী, দেশপ্রেমী ও নিঃস্বার্থ প্রার্থীদের। সমীক্ষায়ও দেখা গেছে, ভোটাররা চাইছেন ভালো মানুষ। যাঁরা দেশ ও সমাজের কাজ করেন। দেশ নিয়ে ভাবেন। উন্নয়নের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন। ধ্যানধারণা আবর্তিত হয় দেশপ্রেম নিয়ে। অর্থের প্রতি যাঁর মোহ কম, মোহ বেশি দেশপ্রেম আর দেশসেবার প্রতি। সেই সব প্রার্থী এলে হয়তো ‘না ভোট’ দেওয়ার প্রবণতা কমবে। বাড়বে রাজনীতির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার প্রবণতা।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.