‘সিলেটের মানুষ দেয় বেশি, পায় কম’

সিলেট শহরে যেতেই দেখা যাবে অসংখ্য মার্কেট–হোটেল। বড় বড় ভবন। কিন্তু কোনো শিল্পকারখানা চোখে পড়বে না। প্রশ্ন জাগবে, তাহলে সিলেটবাসী কি শিল্প স্থাপনে অনাগ্রহী? তাঁরা কি শুধুই ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা লন্ডনযাত্রায় উৎসাহী? সিলেট তিন-তিনজন ‘সফল’ অর্থমন্ত্রী উপহার দেওয়া সত্ত্বেও শিল্পায়নে এলাকাটি পিছিয়ে আছে। কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর জানতেই সোমবার সন্ধ্যায় স্থানীয় এক হোটেলে সিলেটের শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করি। সেদিন ছিল একটি ব্যবসায়ী সংগঠনের ইফতার পার্টি। এ কারণে প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাকে সেখানে পেয়ে যাই। আলোচনায় ছিলেন সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতি মাসুদ আহমেদ চৌধুরী, সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক মো. লায়েছ উদ্দিন, মুকির হোসেন চৌধুরী, এমদাদ হোসেন, এ টি এম শোয়েব, বশিরুল হক, সিলেট সিএনজি পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিরুজ্জামান চৌধুরী দুলু, তৌফিক মজিদ লায়েক প্রমুখ। প্রশ্নের জবাবে ব্যবসায়ী নেতারা বললেন, সিলেটের ব্যবসায়ীরা শিল্পকারখানা করতে চান না, এ কথা ঠিক নয়।
শিল্প প্রতিষ্ঠায় তাঁদের যথেষ্ট আগ্রহ আছে। কিন্তু একটি অঞ্চলকে শিল্পায়িত করতে যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন, তার কিছুই এখানে নেই। জানতে চাই, কী রকম? তাঁরা বললেন, সিলেট দেশের এক প্রান্তে অবস্থিত। রাজধানী ও সমুদ্রবন্দর থেকে অনেক দূরে। তদুপরি যোগাযোগব্যবস্থা নাজুক।  পাল্টা প্রশ্ন করি, সিলেট ও ঢাকার মধ্যে বাস ও ট্রেন সার্ভিস আছে। আছে বিমান সার্ভিসও। এই সুবিধা তো অনেক স্থানে নেই। একজন ব্যবসায়ী নেতা জানান, বর্তমানে ঢাকা-সিলেট সড়কটি খুবই বেহাল। যানজট লেগে থাকে। সড়কটি অপ্রশস্ত হওয়ায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এ কারণেই আমরা ঢাকা-সিলেট সড়কটি চার লেন করার দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু সরকার সেটি দুই লেনের বেশি করতে রাজি হলো না। অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক চার লেন করা হলো। অথচ সড়কপথে সিলেট অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন। আমরা কী দোষ করলাম? আমি বলি, অবশ্যই আপনারা কোনো দোষ করেননি। ভবিষ্যতে হয়তো সিলেট-ঢাকা সড়ক চার লেন হবে। তাঁরা বললেন, যখন সেটি হবে তখন আর চার লেনে কাজ হবে না। ছয় লেন দরকার হবে।
অন্যান্য অঞ্চলের মতো সিলেটের ব্যবসায়ীরাও মনে করেন, সরকারের কর্তাব্যক্তিদের সব মনোযোগ ঢাকায়। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলো কীভাবে চলছে; দেখার কেউ নেই। একজন ব্যবসায়ী নেতা বললেন, সিলেট-চট্টগ্রাম সড়কটি সোজাসুজি নয়। অনেক ঘুরে আসতে হয়। সিলেট-চট্টগ্রাম হাইওয়ে ও সরাসরি ট্রেন সার্ভিস হওয়া প্রয়োজন। তাঁর কথায় যুক্তি আছে। শিল্পের কাঁচামাল কিংবা উৎপাদিত পণ্যটি সহজে আনা–নেওয়া করতে না পারলে উদ্যোক্তারা সেখানে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করবেন কেন? ব্যবসায়ীদের মতে, কেবল ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গেই সিলেটের যোগাযোগব্যবস্থা ভঙ্গুর নয়। সিলেটের সঙ্গে এ অঞ্চলের অন্যান্য জেলা যথাক্রমে মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের সড়কগুলো আরও শোচনীয়। অনেক সড়কই ভাঙাচোরা ও খানাখন্দে ভরা। একজন জানালেন, সিলেট–ভোলাগঞ্জ–কোম্পানীগঞ্জ সড়ক দিয়ে দেশের ৯০ শতাংশ পাথর পরিবহন করা হয়। সেই সড়কটির অবস্থা এতই শোচনীয় যে ৩০ কিলোমিটার যেতে ১০–১৫ ঘণ্টা লেগে যায়। ব্যবসায়ী নেতারা শিল্পের জন্য জমিসংকটের কথাও বললেন।
পর্যটন এলাকা বলে যত্রতত্র শিল্পকারখানা করা যায় না। সে জন্য সরকারের উচিত পর্যটন কেন্দ্রগুলো রক্ষা করে শিল্পের জন্য জমির বন্দোবস্ত করা। সরকার হবিগঞ্জের বাহুবলে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ঘোষণা করেছে। কিন্তু সেখানে শিল্প করার অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এখনো নেই। সেটি কবে হবে, সে বিষয়েও নিশ্চিত নন ব্যবসায়ীরা। সিলেটকে ঘিরে যে পর্যটনবলয় গড়ে উঠেছে তাতে পর্যটকদের আকর্ষণ করার উপায় কী? জবাবে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত একজন বললেন, সাম্প্রতিক কালে অনেকগুলো পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। আছে মনোমুগ্ধকর বেশ কিছু রিসোর্ট বা অবকাশ কেন্দ্র। এখন অনেকে কক্সবাজার-রাঙামাটি না গিয়ে সিলেটে আসেন। কিন্তু সমস্যা হলো যোগাযোগ। রাস্তায় নামলেই তাঁরা দুর্ভোগে পড়েন। এ ছাড়া পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। ফলে চুরি, ছিনতাই, চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটে। এ অবস্থায় একজন পর্যটক এত সব ঝক্কি-ঝামেলা করে কেন আসবেন? আমি জিজ্ঞেস করি, অভিযোগ আছে সিলেটের মানুষ কারখানা না বানিয়ে ভবন বানান।
প্রত্যুত্তরে সিলেট চেম্বারের এক পরিচালক বললেন, ভবন বানানোর কারণ আছে। এতে কোনো ঝুঁকি নেই। জমি ও ভবনের দাম কমে না। কিন্তু শিল্প করতে গেলে পদে পদে বাধা। গ্যাস–সংকটের কারণে সিলেট অঞ্চলে বহু ছোট ও মাঝারি কারখানা উৎপাদনে যেতে পারছে না। সরকার ২০০৯ সালে গ্যাস–সংযোগ দেওয়া বন্ধ করে দেয়। পরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক–ই–ইলাহীর নেতৃত্বে কমিটি করলেও সেটি খুব কাজে আসেনি। জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এই কমিটি সারা দেশে এক হাজার প্রতিষ্ঠানকে গ্যাস–সংযোগ দেওয়ার সুপারিশ করলেও কর্যকর হয়েছে খুবই কম।
সিলেটের ব্যবসায়ীদের দাবি, সরকার অবকাঠামোগত সমস্যা দূর করলে, গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করলে নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবেই। তাঁদের আক্ষেপ হলো, সিলেটে বিপুল পরিমাণ গ্যাস উৎপাদিত হলেও বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হয়নি। বিদ্যুৎ থাকলেও সঞ্চালন লাইন খারাপ। দিনে অন্তত দু–তিন ঘণ্টা লোডশেডিং থাকে। সিলেটে দুটো ওষুধ কারখানা আছে। আলাপ প্রসঙ্গে একটি কারখানার স্বত্বাধিকারী তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বললেন, এখানে কারখানা চালানোর দক্ষ লোক পাওয়া যায় না। ঢাকা ছেড়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ কর্মীরা আসতে চান না। কারখানার একটি যন্ত্র নষ্ট হলেও ঢাকায় নিয়ে যেতে হয়। এখানে মেরামতের সুযোগ নেই।
সিলেটের ব্যবসায়ীরা মনে করেন, নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। ওখানে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের অংশে সড়কগুলো এত খারাপ যে পণ্য আনা-নেওয়া কঠিন। নাজুক যোগাযোগব্যবস্থা ও অপ্রতুল অবকাঠামোর কারণে অনেক স্থলবন্দর অকেজো পড়ে আছে। স্থলবন্দরে ওয়েব হাউস না থাকায় রোদ ও বৃষ্টিতে পণ্য নষ্ট হয়। এর বাইরে যেসব সমস্যার কথা তাঁরা বললেন, তার মধ্যে রয়েছে ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদের হার। এখনো ১২-১৪ শতাংশ হারে ঋণ নিতে হয়। তাঁদের মতে, সুদের হার একক ​িডজিটে আনা জরুরি। এটি অবশ্য সারা দেশেরই সমস্যা। ব্যবসায়ী নেতারা কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, ‘সিলেটের মানুষ দেয় বেশি, পায় কম।’ কীভাবে? তাঁরা বললেন, সিলেট অঞ্চলের মানুষই সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠান। তাঁরা কর-ভ্যাট বেশি দেন। কিন্তু সেই তুলনায় সরকারের উন্নয়নকাজ তেমন হচ্ছে না। বললাম, অর্থমন্ত্রী সিলেটের সন্তান। তাঁকে সমস্যাগুলো জানিয়েছেন কি না? তাঁরা বললেন, ‘হ্যাঁ, জানিয়েছি। একাধিকবার তাঁর সঙ্গে বসেছি। তিনিও সমস্যাগুলো জানেন। কিছু কিছু সমাধানের চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু আমলাতন্ত্র সহজে নড়ে না।’
সিলেটে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার তথা শিল্পায়নের জন্য সরকার কী করতে পারে? তাঁরা বললেন, ‘আমরা পুঁজি চাই না। চাই নীতি-সহায়তা। অবকাঠামোর উন্নয়ন ও গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চয়তা।’ তাঁদের দাবি, অবিলম্বে ঢাকা-সিলেট সড়ক চার লেন করতে হবে। সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে হবে। এখন মাত্র একটি বিমান বাইরে থেকে সরাসরি সিলেটে আসে। কিন্তু এখান থেকে কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট যায় না; ঢাকা হয়ে যায়। ব্যবসায়ী নেতাদের দাবি, সিলেট-চট্টগ্রাম সরাসরি রেল সার্ভিস চালু করতে হবে। যেমনটি হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে। চট্টগ্রাম-সিলেট বিমান সার্ভিস চালু করা দরকার। একই সঙ্গে তাঁরা সিলেট-গুয়াহাটি বিমান সার্ভিস চালুর দাবিও জানান। তাঁদের মতে, এটি চালু হলে কেবল সিলেটবাসী নন, সীমান্তবর্তী ভারতের নাগরিকেরাও লাভবান হবেন। গুয়াহাটি অনেক দূরের বলে তাঁরা সিলেট বিমানবন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী।
আলোচনায় আসে ঢাকা-সিলেট-গুয়াহাটি বাস সার্ভিসও। তাঁরা জানান, বর্তমানে সপ্তাহে এক দিন বাস চালু আছে। রাস্তাঘাটের বেহাল দশার কারণে মানুষ যেতে ভয় পায়। কয়েক বছর আগেও তামাবিল-শিলং কিংবা শিলং-গুয়াহাটি সড়কটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। কিন্তু এখন দুটো সড়কই মসৃণ ও প্রশস্ত। ভারত অসমতল পাহাড়ি এলাকায় যদি এ রকম রাস্তা করতে পারে, বাংলাদেশ পারবে না কেন? ব্যবসায়ী নেতারা সিলেটে শিল্পায়নের যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি প্রবাসীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দাবি করেন। তাঁরা মনে করেন, ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা সত্ত্বেও সীমান্তবর্তী এলাকায় শিল্পকারখানা গড়ে উঠলে উত্তর-পূর্ব ভারতে রপ্তানি অনেক বাড়বে। কেননা বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পণ্য নিলেও তার পরিবহন ব্যয় যা বাড়বে, এখানে উৎপাদিত পণ্য তার চেয়ে কম পড়বে। প্রাণ-আরএফএল সেই নজির স্থাপন করেছে। অন্যরা পারবে না কেন?
আগামীকাল: সিলেটে রাজনীতি আছে, রাজনীতি নেই
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.