‘প্রিভেন্ট’ প্রোগ্রাম বাতিল করতে সরকারের প্রতি আহবান by তাইছির মাহমুদ

উগ্রপন্থা ও সন্ত্রাস দমনের নামে ব্রিটিশ সরকারের গৃহিত প্রকল্প ‘প্রিভেন্ট’কে প্রত্যাখ্যান করেছে শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্বকারী দেশের সর্ববৃহৎ সংগঠন ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব টিচার্স (এনইউটি)। শিক্ষকদেরকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে এসে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করিয়ে ছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে ‘সন্দেহ ও বিভ্রান্তি’ সৃষ্টির সংস্কৃতি তৈরি করা হচ্ছে -এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন শিক্ষকরা।  গত ২৮ মার্চ সোমবার ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে একটি প্রস্তাবের উপর আলোচনা শেষে শিক্ষকরা বিপুল ভোটে প্রিভেন্ট প্রকল্প বাতিল করার পক্ষে ভোট দেন। ২০১৫ সালের সামার থেকে প্রিভেন্ট প্রকল্পের আওতায় আনা হয় শিক্ষকদেরকে। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে কোনো ধরণের সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকার সন্দেহ হলে কিংবা উগ্র আচরণ লক্ষ্য করলে পুলিশের কাছে তা রিপোর্ট করতে বাধ্য করা হয় শিক্ষকদের। কিন্তু পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা হয়েছে- এমন ৯০ শতাংশ অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হওয়ায় স্কুলের অভ্যন্তরে প্রিভেন্ট প্রকল্প ব্যর্থ হচ্ছে বলে মনে করছেন শিক্ষক নেতারা।  প্রিভেন্ট প্রকল্পের আওতায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কট্টরপন্থা থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব শিক্ষকদের রয়েছে, কিন্তু এই ক্ষেত্রে প্রিভেন্ট প্রকল্প কার্যকর হচ্ছেনা বরং উলটো ফলাফল আনছে বলে অভিযোগ করছেন খোদ শিক্ষকরা। বার্ষিক সম্মেলনে নর্থ ইয়র্কশায়ার এলাকা থেকে শিক্ষকদের প্রতিনিধি হিশাবে যোগ দিয়ে গ্যারি কেই নামের একজন শিক্ষক বলেন, অনেক শিক্ষককে প্রিভেন্ট প্রকল্পের আওতায় যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে সেগুলো ‘অপরিমার্জিত  ও একচোখা দৃষ্টিভঙ্গি’তে ঠাসা। তিনি বলেন, প্রশিক্ষণে নিয়ে শিক্ষকদেরকে এ-থ্রি সাইজের একটি কাগজ ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে যার একপাশে ‘আইসিস’ আর অন্যপাশে ‘ইডিএল’ জাতীয় শব্দগুলো লিখে শিক্ষকদের বলা হচ্ছে, কোনো শিক্ষার্থীর মুখে এ ধরনের শব্দের উচ্চারন শুনলে প্রাথমিকভাবে তাকে চরমপন্থী মনোভাবের বলে ধরে নিতে হবে। অথচ এই ধরণের টার্ম দিয়ে আধুনিক বিশ্বের উগ্রবাদী রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন গ্যারি কেই। স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদেরকে প্রিভেন্ট প্রকল্প থেকে পরিত্রাণ দিয়ে তাদেরকে ‘‘পাবলিক সেক্টরের সিক্রেট সার্ভিস’’ এ পরিণত করার প্রক্রিয়া বন্ধ করার আহবান জানান তিনি। সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে চেস্টারফিলড থেকে আসা প্রতিনিধি লিসা টানেল বলেন, প্রিভেন্ট প্রকল্পের আওতায় মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের ভারসাম্যহীনভাবে টার্গেট করা হচ্ছে এবং এর ফলে স্কুলগুলোর সাথে স্থানীয় কমিউনিটিগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক বিনষ্ট হচ্ছে। প্রিভেন্ট প্রকল্পের আওতায় এক মুসলিম ছাত্রের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, বিমান বন্দরের সিকিউরিটি সাইনের বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই ছাত্র বিভিন্ন বিষয় উল্লেখ করে এক পর্যায়ে ‘টেরোরিজম’ শব্দটি উচ্চারণ করেছিলো, তাই ফ্রেঞ্চ ভাষার শিক্ষক ওই ছাত্রকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।   ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব টিচার্সের বার্ষিক সম্মেলনে প্রিভেন্ট প্রকল্প প্রত্যাখ্যানের প্রস্তাবটি উত্থাপন করে সংগঠণের কার্যকরি সদস্য অ্যালেক্স কেনি বলেন, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিহীন এবং কোনো ধরণের নিয়ম-নীতির মধ্যে পরিচালিত হয়না এমন সংগঠণ বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।  এনইউটি’র সাধারণ সম্পাদক ক্রিস্টিন ব্লওয়ার বলেন, চরমপন্থীরা  স্কুলের প্রাঙ্গণ থেকে নয় বরং ইন্টারনেটের স্যোশাল মিডিয়ায় টার্গেট করে লোক সংগ্রহ করে। তিনি বলেন, ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো আচরণ যদি সমস্যা সৃষ্টি করে, তা ঠিক করতে হলে সেই বিষয়ে বেশি বেশি আলোচনা করা যেতে পারে। এদিকে, সেন্ট্রাল লন্ডনের একটি স্কুলের জনৈক শিক্ষক রব প্রাইস এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘প্রিভেন্ট’ এর অপর নাম হচ্ছে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুপ্তচরবৃত্তি করা। বিষয়টিকে এভাবেই দেখা হয় এবং ভবিষ্যতেও এইভাবেই বিষয়টিকে দেখা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। প্রিভেন্ট কর্মসূচির আওতায় নিজের প্রশিক্ষণের বর্ণনা দিতে গিয়ে রব প্রাইস বলেন, বিষয়টি নিয়ে লুকোচুরি করা হচ্ছে। তিনি জানান, যে পুলিশ কর্মকর্তা তাঁদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, তিনি শিক্ষকদের নাম কোনো রেজিস্ট্রারে না রাখার চেষ্টা করছিলেন। এই ধরণের লুকোচুরিই প্রিভেন্ট নীতির গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে মন্তব্য করেন তিনি। মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে ভিত্তিহীন সব অভিযোগ দায়েরের কথা উল্লেখ করে রব প্রাইস বলেন, কোনো ছাত্র যদি মুখ ফসকে বা সরলভাবে কথা বলে এবং তাকে দেখতে একটি বিশেষ ধরণের দেখায়, তাহলে এই প্রিভেন্ট কর্মসূচির আওতায় তার বিষয়টি পুলিশকে রিপোর্ট করা হবে- এটাই স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। উল্লেখ্য, কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড সিকিউরিটি (সিটিএস) আইনের প্রিভেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় বৃটেনের মুসলিম কমিউনিটির ওপর বিভিন্নভাবে নজরদারী জোরদার করা হয়েছে। বিশেষকরে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন জটিল প্রশ্নের মুখোমুখী হচ্ছেন। স্কুলের কোনো শিক্ষার্থীর কথাবার্তা, চালচলন কিংবা আচরণ থেকে যদি সন্দেহ হয় যে, সে চরমপন্থী মনোভাব পোষণ করছে তাহলে তাকে সাথে সাথে পুলিশে সোপর্দ করা হবে। ইতোমধ্যে যাদের বিষয়ে পুলিশে অভিযোগ করা হয়েছে তাদের ৯০ শতাংশের বিরুদ্ধেই অভিযোগের স্বপক্ষে কোনো প্রমানাদি পায়নি পুলিশ। এই ৯০ শতাংশের মধ্যে ৮০ ভাগই মুসলমান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রিভেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় মুসলিম কমিউনিটিকে অধিকমাত্রায় টার্গেট করার কারণে তাদের মধ্যে মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে। আর এই বিচ্ছিন্নতার অনভূতিকে কাজে লাগিয়ে মূলত চরমপন্থীরা তাদের দলে লোক ভেড়ানোর সুযোগ পায়। তাই এই  প্রোগ্রাম অবিলম্বে বাতিল করা উচিত।

No comments

Powered by Blogger.