পৌরাণিক কাহিনির পুনরাবৃত্তি যেন না হয় by এম সাখাওয়াত হোসেন

খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৭০০ বছর আগে গ্রিক পৌরাণিক কাহিনির অনেকগুলোর লেখক হেসিওড তাঁর লেখায় প্যান্ডোরার কাহিনি লিখেছিলেন। ওই পৌরাণিক কাহিনিমতে, প্যান্ডোরাই প্রথম নারী, যাঁকে দেবতাদের দেবতা জিউস তৈরি করেছিলেন। হেসিওডের বর্ণনায় পাওয়া যায়, দ্বিতীয় স্তরের দেবতা প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করেন। জিউস, সর্বশক্তিমান গ্রিক দেবতা, ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিতে প্যান্ডোরাকে প্রমিথিউসের ভাই ইপিসেথিসকে প্রদান করেন। সঙ্গে উপহার দেন একটি পাত্র, যা প্যান্ডোরার বাক্স বা ‘প্যান্ডোরার বক্স’ নামে পরিচিত। প্যান্ডোরা জানতেন না ওই বাক্স বা পাত্রে কী আছে! প্যান্ডোরা পাত্রের মুখটি খুললেন। বের হয়ে এল সব ধরনের রোগ, মৃত্যু আর সব ধরনের পৃথিবী বিনষ্টকারী শয়তান। খালি পাত্রের তলানিতে পড়ে রইল আশা, যদি কোনো দিন ওই শয়তান আর ধ্বংসকারীগুলো ফিরে আসে আর মুখ পুনরায় বন্ধ করা যায়।
এই পৌরাণিক কাহিনির সেই ঘটনা আজও উপমা হিসেবে আমরা ব্যবহার করি। এর মানে হলো দেখতে সহজ-সরল বিষয়, কিন্তু যা নাড়া দিলে সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কারণে অনেক ক্ষতি হতে পারে বা অনেককেই বিব্রত করতে পারে, এমনকি সমাজের ওপরও প্রভাব পড়তে পারে। আমরা ব্যক্তি হিসেবে অথবা রাষ্ট্রের কোনো পক্ষ হিসেবে অজান্তে সহজ-সরল বিষয় মনে করে এমন বিষয়ে নাড়া দিই, যা রাষ্ট্রের, তথা সমাজে নানা ধরনের বিব্রতকর, এমনকি জটিল সমস্যায় ফেলে দিতে পারে।
প্যান্ডোরার বাক্স খোলার মতো নানা ঘটনা আমাদের চারপাশে ঘটে থাকে, তবে তা যদি সরকারি, আধা সরকারি অথবা সরকার-সমর্থিত কোনো সংগঠন দ্বারা হয়, তা হিতে বিপরীত হতে পারে। ইদানীং বাংলাদেশের প্রধান ও অন্যতম দৈনিক ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার যে মামলার পর মামলা হচ্ছে এবং যে কারণে হচ্ছে, তাতে সরকার ও সরকারের মূল দলের কতখানি উপকার হবে, আমার মতো ক্ষুদ্র বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে ধারণা করা সম্ভব নয়। তবে যে প্রেক্ষাপটে এসব মামলা হচ্ছে, সে প্রেক্ষাপটের বিশ্লেষণে বলা যায়, আমাদের দেশে ভুল করার পর অথবা কোনো অন্যায় আচরণ করার পর ভুল স্বীকার করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বিরল। ক্ষমা বা দুঃখ প্রকাশ করে ভুল স্বীকার করার জন্য মানসিক ও নৈতিক সাহসের প্রয়োজন। এমন ঘটনা আমাদের দেশের ক্ষমতাবান বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কমই শোনা বা দেখা গিয়েছে। যেভাবেই হোক, মাহ্ফুজ আনাম অকপটে স্বীকার করে সেই সৎ সাহস দেখিয়েছেন।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সমাজের বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছেন, যাঁদের অনেকের কর্মময় জীবনের জানা-অজানা অনেক ভুলের জন্য প্রতিষ্ঠান এবং দেশের বহু আইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের দেশের মানুষ দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টিকে যথেষ্ট ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেন। এ উপমহাদেশেরই বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনীতিবিদ দুঃখ প্রকাশ করে জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন, এমন নজির রয়েছে এবং জনগণও যে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছেন, তারও নজির রয়েছে।
এমন ঘটনার নজির ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসেও রয়েছে। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, যিনি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিজয় এনে দিয়েছিলেন, তাঁর দল এবং তাঁর ভরাডুবি হয়েছিল। এর প্রেক্ষাপট ছিল ভারতে লম্বা সময়ের জন্য জরুরি অবস্থায় শাসন আর নিপীড়ন, ব্যাপক দুর্নীতি ও অপশাসন। ইন্দিরা গান্ধী বুঝতে পেরেছিলেন, জনগণের কাছে তাঁর কৃতকর্ম ও ভুল পদক্ষেপের জন্য ক্ষমা না চাইলে তাঁর ও তাঁর দল কংগ্রেসের রাজনীতি নির্বাসিত হতে পারে। তিনি পাঁচটি বছর তাঁর অপশাসনের জন্য জনগণের কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিলেন। ১৯৮২ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটের মাধ্যমে জনগণ তাঁকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছিলেন। এখান থেকেও আমাদের রাজনৈতিক দল, নেতা ও প্রভাবশালীরা শিক্ষা গ্রহণ করেননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে জনগণ আশা করেছিলেন, দল হিসেবে বিএনপি ক্ষমা প্রার্থনা করবে, যা আজ পর্যন্ত করেনি। শুধু বিএনপিই কেন, কেউই করেনি।
আমাদের দেশে ভুল করার পর অথবা কোনো অন্যায় আচরণ করার পর ভুল স্বীকার করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার ঘটনা অত্যন্ত বিরল। ক্ষমা বা দুঃখ প্রকাশ করে ভুল স্বীকার করার জন্য মানসিক ও নৈতিক সাহসের প্রয়োজন এক-এগারো বলে পরিচিত জরুরি অবস্থার সময়ের সেই ঘটনা এখন এত দূর গড়িয়েছে এবং শুধু একটিই নয়, দু-একটি বাদে সব পত্রিকাতেই একই ধরনের খবর ছাপা হয়েছিল। মাহ্ফুজ আনামের বক্তব্য থেকে জানা যায়, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে খবর জোগান দেওয়া হয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কোনো বিষয়ে তথ্য প্রদান করলে বা প্রতিবেদন তৈরি করলে, তার কিছু তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন হয়। এসব তথ্য-উপাত্ত জোগাড় করার পদ্ধতিও রয়েছে। এগুলো বেশির ভাগই জোগাড় করা হয় নিজস্ব পদ্ধতিতে এবং যার বিরুদ্ধে বা কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে মূল তথ্য বেশির ভাগ সময়ই গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক নিয়োজিত অথবা অনেকে অনেক ধরনের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে বা অন্য কোনো কারণে প্রদান করে থাকে। এর বিনিময়ে নানা ধরনের সুবিধা বা প্রলোভন অথবা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে থাকে। এসবই বিশ্বব্যাপী গোয়েন্দা তৎপরতার স্বীকৃত পদ্ধতি।
এসব পদ্ধতি অনেকের কাছে অনৈতিক মনে হলেও বিশ্বব্যাপী গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য সংগ্রহের প্রধান ও কার্যকর পদ্ধতিই হলো হিউম্যান ইন্টেলিজেন্স। বিশ্বব্যাপী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অন্যতম সোর্স হলো ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’। এক-এগারোতেও এ দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এর ব্যতিক্রমে তথ্য সংগ্রহ করেছে বলে মনে হয় না। এ কারণেই প্রারম্ভে প্যান্ডোরার বাক্সের প্রসঙ্গ টেনেছিলাম।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, যাঁকে কেন্দ্র করে ওই সময়ে এ ধরনের খবর পরিবেশন করা হয়েছিল, ওই সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা ও বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি বা তাঁর তরফ থেকে কোনো ধরনের ব্যবস্থার কথাও শোনা যায়নি। তা ছাড়া, তিনি আগেও ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্তও প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর কাছে এসব তথ্য অজানা থাকার কথা নয়, তথাপি তিনি উদারতা দেখিয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ওই সময়ের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত, তিনি জানেন কারা, তাঁর বিরুদ্ধে কী করেছেন। তথাপি তিনি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখেছেন। ক্ষমা করায় তাঁর উচ্চতা আরও বেড়েছে বৈ কমেনি।
ডেইলি স্টার-এর সম্পাদকের বিরুদ্ধে এ ধরনের মামলা নিয়ে দেশে-বিদেশে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে, যা গণতন্ত্রের অন্যতম অঙ্গ গণমাধ্যমকে কতখানি প্রভাবিত করবে, তা দেখার বিষয় হবে। যেহেতু মামলাগুলো বিজ্ঞ আদালত গ্রহণ করেছেন, কোথাও কোথাও সমনও জারি করা হয়েছে, কাজেই দেশের সাধারণ মানুষও অপেক্ষা করবে বিচারের এবং বিচারের পরিণতির। আমরা আশা করি, দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের বিকাশ হোক এবং এর ভিত মজবুত হোক, যাতে আমাদের অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে কখনোই পড়তে না হয়। অগণতান্ত্রিক পরিবেশে সমাজ, রাষ্ট্র ও সুস্থধারার রাজনীতি বিকশিত হতে পারে না।
এম সাখাওয়াত হোসেন: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক৷
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.