শহীদদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা by কামাল আহমেদ

১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি কেমন ছিল, তা আজকের তরুণদের জানার কথা নয়। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে পা রেখেছেন, কিংবা গত কয়েক বছরে সেখানকার লেখাপড়ার পাট চুকিয়েছেন, তাঁদের অনেকেরই সেই ইতিহাস জানার প্রয়োজন পড়েনি। প্রয়োজন পড়বেই বা কেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের শেষ যেবার নির্বাচন হয়েছিল, সে বছরে যাঁদের জন্ম হয়েছে, তাঁদেরও এখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে পেশাজীবন শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। এই সময়ের প্রজন্ম যে ছাত্ররাজনীতি দেখেছে, তা হলো হল দখলের, টেন্ডারবাজি-লাইসেন্সবাজি বা তদবিরবাজি করে লাখ–কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়ার রাজনীতি। ওই রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কিংবা মৌলিক অধিকার আদায়ের প্রশ্ন অবান্তর।
ক্ষমতার হিসাব-নিকাশে সাবেক সামরিক শাসক আর গণতন্ত্রের সৈনিকদের মাখামাখি দেখতে দেখতে একধরনের অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গেছে। এখন আর তাই ৮৩-র আন্দোলনের ছাত্রনেতাদের অনেককে পতিত স্বৈরাচার এরশাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের ছবি দেখে কেউ ছি ছি করে না। এই আড়াই যুগের ছাত্রনেতাদের দু-একজন তো নিজেরাই অনুমোদন বাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বসেছেন। একালের ছাত্রনেতাদের তাই সমৃদ্ধিবাদী বললে খুব একটা ভুল হবে বলে মনে হয় না। এঁরা নিজেদের সমৃদ্ধিতেই দেশের সমৃদ্ধির সুখ উপভোগ করেন। এঁদের কাছে সর্বজনীন শিক্ষার অধিকার প্রশ্নে সংগ্রামের এখন আর তেমন গুরুত্ব নেই।
৮৩-র ১৪ ফেব্রুয়ারির ছাত্র আন্দোলনের ধারাবাহিকতার পরিণতি ঘটে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে। সেই গণ-অভ্যুত্থানের মূল উদ্দেশ্য ছিল কার্যকর গণতন্ত্রে ফিরে আসা। অথচ গণতন্ত্রচর্চার এক অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ভোটের অধিকার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনেও কোনো না কোনোভাবে হরণ করা হয়েছে বা লঙ্ঘিত হচ্ছে। ওই আন্দোলনের চেতনায় ছিল স্বৈরতন্ত্রের অবসান। সামরিক স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটলেও আমাদের রাজনীতিতে স্বৈরতান্ত্রিক ধ্যানধারণা বহাল আছে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো বাস্তবে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। আর যে বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল, সেই শিক্ষাব্যবস্থায় এখন বৈষম্য আরও বেড়েছে। আর যে স্বৈরাচারী সেনাপতি ‘বিশ্ব বেহায়া’র খেতাব পেয়েছিলেন, তিনি এখনো ক্ষমতার ভাগীদার হিসাবে সুখ ভোগ করে চলেছেন।
ক্ষমতালিপ্সু সেনাপতি বলতে এই ভূখণ্ডে যদি কেউ জন্মে থাকেন, তিনি হলেন জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ক্ষমতার দর-কষাকষিতে এখন যাঁরা তাঁকে সকালে এক কথা বলে বিকেলে তার উল্টোটা বলতে শুনে বিস্মিত হন, তাঁরা সম্ভবত ভুলে যান যে এই ব্যক্তিই একটি নির্বাচনের ছয় মাসের মধ্যেই সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর এক অবিশ্বাস্য নজির স্থাপন করেছিলেন ১৯৮২-র মার্চ মাসে। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তিনি তাঁর স্বৈরাচারী শাসন চালিয়ে গেছেন ৯০-এর ডিসেম্বর অবধি। তবে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি কখনোই অবদমিত থাকেনি। তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের পরদিন থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনে বারবার উচ্চারিত হয়েছে স্বৈরাচার অবসানের আওয়াজ। জেনারেল এরশাদ তখন যে শুধু গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন তা নয়, তিনি একই সঙ্গে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বৈষম্যমূলক এক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে আর্থিক সামর্থ্যই ছিল কে কী ধরনের শিক্ষার সুযোগ পাবে, তার নির্ধারক। মজিদ খানের সেই গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে ছাত্রসংগঠনগুলো তখন এক হয়ে গড়ে তোলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
৮২-র ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস পালনকে কেন্দ্র করে তখন গড়ে ওঠে ওই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তারপর ১৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষাভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষিত হয়। সেদিনের সেই কর্মসূচিতে ঢাকা শহরের ছাত্রছাত্রীদের যে বিপুল অংশগ্রহণ ছিল, তাতে মিছিলের প্রথম ভাগ যখন হাইকোর্টের মাজার গেটে, তখনো কলাভবনের বটতলায় তার পেছনের অংশ। কিন্তু স্বৈরাচারী শাসকেরা যেমন নিষ্ঠুর হন, ঠিক তেমনই ছিলেন জেনারেল এরশাদ। হঠাৎ করেই মিছিলের ওপর চালানো হয় গুলি। গুলির পাশাপাশি কাঁদানে গ্যাস, লাঠিপেটা ও ধরপাকড়। শহীদ হন জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালি সাহাসহ অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অভিযান চালিয়ে শহীদদের লাশ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলে। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে ফেলে রাতভর হলে হলে চালানো হয় অভিযান। ছাত্র আন্দোলন দমনের অভিযান কতটা কঠোর হতে পারে, তার এক নজির স্থাপিত হয় ১৪ ফেব্রুয়ারি। শহরের আরেক প্রান্তে অসংগঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতারা পরিস্থিতি আলোচনার জন্য মিলিত হন প্রবীণ রাজনীতিক ড. কামাল হোসেনের বাসায়। সেখান থেকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ জাতীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। শেখ হাসিনাকে নেওয়া হয়েছিল মিন্টো রোডে বিরোধীদলীয় নেতার জন্য নির্ধারিত ভবনটিতে, যেটি আগেই রূপান্তরিত হয়েছিল একটি সেনাক্যাম্পে। কাউকে কাউকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় অজ্ঞাত জায়গায়। কিন্তু ওই সব হত্যা, গ্রেপ্তার, নিপীড়ন কোনো কিছুই গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে দমাতে পারেনি। বছর না ঘুরতেই আবার সংগঠিত হতে থাকে আন্দোলন। পরের বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস।
এখন ১৪ ফেব্রুয়ারি আমরা ঘটা করে পালন করি ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা দিবস ইউরোপে চালু ছিল অনেক আগে থেকেই। খ্রিষ্টান যাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের স্মরণে এই দিবস খ্রিষ্টধর্মপ্রধান দেশগুলোয় বহুদিন ধরে পালিত হয়ে আসছে। আর ভ্যালেন্টাইনকে প্রেমিকের প্রতীক ধরে নিয়ে ভালোবাসা দিবস পালনের চল প্রথম চালু হয় ইংল্যান্ডে। তাও কোনো কোনো বর্ণনামতে ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ১৯৮৩-র স্বৈরাচারবিরোধী ছাত্র-গণ-আন্দোলনের দিন অবধি আমাদের দেশে এর কোনো চল ছিল না। কাগজে-কলমে আমাদের দেশে এই দিনটি পালনের কথা প্রথম লেখা হয় আরও কয়েক বছর পর। দিনটিকে ঘিরে পাশ্চাত্যে বাণিজ্যেরও অনেক প্রসার ঘটেছে (বিশেষ করে চকলেট, কার্ড, ফুল, অলংকার ও পর্যটন বাণিজ্য)। বিশ্বায়নের কালে ভালোবাসা-বিষয়ক বাণিজ্যের স্রোত হয়তো স্বাভাবিকভাবেই কোনো একদিন আমাদের এই বদ্বীপে এসে ঠেকত। সে কারণে আমি বাংলাদেশে এই দিনটি আমদানির জন্য সাংবাদিক শফিক রেহমান বা তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেকালের সাপ্তাহিক যায়যায়দিনকে দোষ দেওয়ার পক্ষপাতী নই। দোষ যদি কিছু থেকে থাকে সেটা আমাদের। আমাদের রাজনৈতিক বিবেচনাবোধের।
সর্বসম্প্রতি এতে যুক্ত করার চেষ্টা হচ্ছে প্রেমিক বা প্রেমিকাকে নয়, ঢাকাকে ভালোবাসানোর এক অভিনব উদ্যোগ। ঢাকাকে ভালোবাসতে শহরকে আবর্জনামুক্ত করতে হবে এবং কর্তৃপক্ষ তার দায়িত্ব পালন করুক আর না করুক—নাগরিকেরা যেন তাঁদের দায়িত্বটুকু পালন করেন, সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে নতুন মেয়রদের একজনের এই উদ্যোগ। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকনের দুর্ভাগ্য যে তিনি চমক দেখাতে মুম্বাই থেকে বলিউডের নায়িকাদের উড়িয়ে আনতে চেয়েও শেষ পর্যন্ত তাঁকে ভগ্নহৃদয়ে দেশীয় তারকাদের নিয়েই তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। বলিউডের নায়িকা-গায়িকাদের প্রতি কেউ মোহাবিষ্ট থাকলে থাকতেই পারেন। কিন্তু প্রচারকৌশলে চমক যুক্ত করতে তাঁদের শরণাপন্ন হওয়ায় নিজেদের যে অন্তঃসারশূন্যতা প্রকাশ হয়ে পড়ল, তার কী হবে? ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে বহুদিন ধরেই ভাষার মাস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে বলে অনেকে এই মাসে হিন্দি ছবির নায়িকাদের নিয়ে মাতামাতির সমালোচনা করেছেন। আবার ছাত্র-তরুণদের অনেকে এই পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচির আনুষ্ঠানিকতার জন্য স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসকে বেছে নেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। আমি এই দ্বিতীয় গোষ্ঠীর যুক্তিগুলোকেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মনে করি। ১৪ ফেব্রুয়ারি যদি কোনো জঞ্জাল পরিষ্কার দূর করার প্রশ্ন ওঠে, সেটা হচ্ছে গণতন্ত্রের পথে বাধা সৃষ্টিকারী নানা আপদ অপসারণের শপথ নেওয়ার প্রশ্ন। দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর যে হুমকি, যাকে অনেকে ভয়ের সংস্কৃতি বলে অভিহিত করেন, তার অবসান ঘটানো। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে নির্বাচিত মেয়রের কাছ থেকে অবশ্য সেটা আশা করার কোনো কারণ নেই। আপাতত আমরা যা পারি, তা হলো আমাদের অক্ষমতার জন্য শহীদদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা।
ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির নবজাগরণ ঘটিয়ে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর দেশটির বহুল বিতর্কিত নেতা নরেন্দ্র মোদি স্বচ্ছ ভারত কর্মসূচি দিয়ে রাস্তায় ঝাড়ু নিয়ে নেমেছিলেন। স্বভাবতই তাঁর এই উদ্যোগে তাঁর ভক্তকুল ছাড়াও নামীদামি তারকারাও যোগ দিয়েছিলেন। রাজধানী নয়াদিল্লিসহ অনেক শহরেই পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছিল। ধারণা করি, সৃজনশীলতার অভাব এবং অনুকরণপ্রিয়তার স্বভাব থেকে আমরাও ঢাকায় একই ধরনের কর্মসূচির কথা ভেবেছি। দিল্লির মতো এখন নাকি ঢাকাতেও ব্যক্তিগত গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণে সপ্তাহের এক দিন জোড় সংখ্যার রেজিস্ট্রেশন এবং পরের দিন বেজোড় সংখ্যার নম্বরওয়ালা গাড়ি চলতে দেওয়ার নিয়ম চালুর কথা ভাবা হচ্ছে। ভালো জিনিস, ভালো নিয়ম, ভালো সংস্কৃতির অনুকরণে ক্ষতি নেই। কিন্তু আমরা আবার শুধু ভালোটুকু গ্রহণেই থেমে থাকি না। খারাপটাও নিই। সাধারণত খারাপটা বেশিই নিই। তাই আশঙ্কা হয় যে এ ক্ষেত্রেও তেমনটি না হয়। যাঁরা দিল্লির খবর রাখেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন যে দিল্লিতে এ মাসের শুরুর দিকে দিন দশেক পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা কর্মবিরতি করায় রাস্তায় রাস্তায় জঞ্জালের স্তূপ জমে গিয়েছিল। এর পেছনের কারণ কিন্তু রাজনীতি। মোদিজির ভারত জয়ের গৌরবকে কয়েক মাসের মধ্যেই ম্লান করে দিয়েছিলেন যে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, দিল্লির সেই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধের জেরেই দিল্লিবাসীর ওই ভোগান্তি। ভারতে এখন ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার চর্চা যে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে, সে কথাও এখন সবার জানা।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.