জাপা দুই টুকরো

ভেঙে গেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি।  নেতৃত্ব নিয়ে  দ্বন্দ্বের জেরে দলটি কার্যত দুই ভাগ হয়ে গেলো। এরশাদের পরবর্তী উত্তরসূরি করে জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান ঘোষণার পরের দিন এরশাদের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে পাল্টা ঘোষণা এসেছে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে। তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে দলের একাংশের পক্ষ থেকে। আর এ ঘোষণার পর রওশনের অনুসারী নেতারা বলছেন, দলের চেয়ারম্যান সক্রিয় না থাকায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দলীয় সংসদ সদস্য ও প্রেসিডিয়ামের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। যদিও গতকাল রাতে এরশাদ জানিয়েছেন, দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা সম্পূর্ণ অবৈধ। তারা যে বৈঠক করেছে এটিও অবৈধ।
গত ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ঘিরে জাতীয় পার্টিতে প্রথম ভাঙন দেখা দেয়। নির্বাচনের সময় দলটির সিনিয়র  প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে এরশাদকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন। পরে এরশাদও পাল্টা বহিষ্কারের ঘোষণা দেন। পরে জাফরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি ২০ দলীয় জোটে যোগ দেয়। এ ভাঙনের পরও দলে দুটি ধারা তৈরি হয়। মন্ত্রী-এমপি হওয়া নেতারা বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের অংশে এবং ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতারা এরশাদের পক্ষ নেন। দুই পক্ষের মতবিরোধের বিষয়টি বার বারই প্রকাশ্যে আসে তাদের বক্তব্য ও পাল্টা বক্তব্যে। সর্বশেষ রোববার পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদ রংপুরে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ছোট ভাই জিএম কাদেরকে পরবর্তী উত্তরসূরি ঘোষণা দিয়ে তাকে কো- চেয়ারম্যান করেন। এছাড়া, জিএম কাদেরের নেতৃত্বে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিরও কথা জানান এরশাদ। মূলত এ ঘোষণার পরই দলের নতুন মেরূকরণের ইঙ্গিত মেলে। বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় রওশন এরশাদের অনুসারী নেতাকর্মীদের মধ্যে। এ নিয়ে রোববার রাত থেকে তাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। গতকাল দিনভর চলে দৌড়ঝাঁপ। রাতে রাজধানীর গুলশানস্থ রওশন এরশাদের বাসভবনে এক জরুরি বৈঠক বসে। এতে দলীয় এমপি ও কয়েকজন সিনিয়র নেতা অংশ নেন। বৈঠক শেষে সভায় সর্বসম্মতভাবে রওশন এরশাদকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার কথা জানান মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। তবে তিনি সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেননি। বলেন, আমরা প্রেসিডিয়াম ও এমপিরা মিলে যৌথসভা করেছি। সেখান থেকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া, জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করা দলের গঠনতন্ত্র বহির্ভূত বলেও উল্লেখ করেন তিনি। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা, বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশিদ, ফখরুল ইমাম, এসএম ফয়সাল চিশতী, দেলোয়ার হোসেন খান, তাজ রহমান, নুর-ই-হাসনা লিলি চৌধুরী, হাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন, সংসদ সদস্য শওকত চৌধুরী, মো. নোমান ও খুরশিদ আরা হক প্রমুখ। দলের চেয়ারম্যান থাকতে আরেকজনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা যায় কিনা, জানতে চাইলে কাজী ফিরোজ রশিদ মানবজমিনকে বলেন, দলের চেয়ারম্যান নিষ্ক্রিয় থাকলে যায়। তাহলে কি দলের চেয়ারম্যান নিষ্ক্রিয়? এমন প্রশ্নের জবাবে পাশ থেকে তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, হ্যাঁ উনি (এরশাদ) নিষ্ক্রিয়। এখন থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ।
এবিষয়ে জিএম কাদের রাতে রংপুর থেকে টেলিফোনে মানবজমিনকে বলেন, প্রথম কথা হলো তারা চেয়ারম্যানের অনুমতি ছাড়া কোনো বৈঠক ডাকতে পারে না। এটা গঠনতন্ত্রবহির্ভূত। তাছাড়া চেয়ারম্যান মারা না যাওয়া পর্যন্ত কেউ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হতে পারেন না। জিএম কাদের বলেন, আমার কাছে মনে হয় রওশন এরশাদ এর সঙ্গে জড়িত নন। তিনি জড়িত থাকার কথাও না।
প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়ানোর পর ২০১৩ সালের ৩রা ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে নির্বাচন থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন জাপা চেয়ারম্যান। এরপর থেকে জাপা নেতারা বিভিন্ন নাটকের আশ্রয় নিলেও বরাবরই নির্বাচন থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথা জানিয়েছিলেন এরশাদ। ওই বছরের ১২ই ডিসেম্বর অসুস্থততার কথা বলে এরশাদকে নিয়ে যাওয়া হয় সিএমএইচে। সেখানে এরশাদকে সাইড লাইনে বসিয়ে রেখে নির্বাচনে থেকে যায় রওশন এরশাদ অনুসারী জাতীয় পার্টি। এরশাদকে ছাড়াই শপথ নেন দলের এমপিরা। এরপর এরশাদকে আড়ালে রেখে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন জাপার তিন এমপি। অবশ্য এরশাদের ভাগ্যে জুটে মন্ত্রী পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। ২০১৪ সালের ১২ই জানুয়ারি বিশেষ দূতের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বারিধারার বাসভবনে ফিরেন এরশাদ। বিশেষ দূতের দায়িত্ব নেয়ার দুই বছর পার হতে চললেও এখন পর্যন্ত ওই পদটির কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি তার। তবে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের স্বার্থে এরশাদ বরাবরই বলে আসছেন, বিশেষ দূতের পদটি ও মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হবে। যদিও তার কার্যকর কোনো ভূমিকা নেয়া হয়নি।
জিএম কাদেরের জন্য চ্যালেঞ্জ সম্মেলন: এদিকে আগামী এপ্রিল মাসেই সম্মেলন করার নির্দেশ দিয়েছেন এইচ এম এরশাদ। কিন্তু এটি জিএম কাদেরের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করছেন নেতারা। কারণ, গত দুই বছরে জাতীয় পার্টির ৭৬টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে মাত্র ৩০টিতে কাউন্সিল হয়েছে। বাকিগুলোতে জাপার সংগঠন নেই। নিয়মানুযায়ী সকল জেলা কাউন্সিল সম্পন্ন করেই জাতীয় কাউন্সিল করতে হবে। সে হিসেবে আগামী ৩ মাসের মধ্যে বাকি ৪৬টি জেলার কাউন্সিল করা জিএম কাদেরের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন জাপা নেতারা।
জাপার সংদীয় বৈঠক আজ:
এদিকে আজ জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার কার্যালয়ে জাতীয় পার্টির সংসদীয় দলের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। সার্বিক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে বলেও দলীয় সূত্র জানিয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.