শূন্য পদ ও যোগ্য প্রার্থী আছেন, নেই প্রাধিকার by আলী ইমাম মজুমদার

৩৪তম বিসিএস পরীক্ষার বিভিন্ন পর্যায় ঘটনাবহুল। পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও কম হয়নি। সর্বশেষ খবর হয় সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) দুজন সদস্য কর্তৃক অনৈতিক সুবিধা দেওয়ার। তবে বিষয়টি এখনো প্রমাণের অপেক্ষায়। তাই আলোচনা ভিন্ন প্রসঙ্গে। এ বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ থেকে ফলাফল চূড়ান্ত করতে পিএসসি সময় নিয়েছে আড়াই বছর। গত ২৯ আগস্ট তারা তা সম্পন্ন করল। এখনো মেডিকেল টেস্ট ও পুলিশি তদন্ত সম্পন্ন হয়নি। তাই সুপারিশ পাওয়া সৌভাগ্যবানদের নিয়োগ পেতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। একটি বাংলা দৈনিকের প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বিজ্ঞাপিত পদ ২ হাজার ৫২-এর স্থলে তারা সুপারিশ করেছে ২ হাজার ১৫৯ জনকে। এমন হতেই পারে। দীর্ঘ সময়ে ক্যাডারে শূন্যপদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পরবর্তী পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশের সময়ও থাকে অনিশ্চিত। তাই নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয় নিয়মানুসারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শূন্যপদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়টি পিএসসিকে জানিয়ে অতিরিক্তসংখ্যক ক্যাডার নিয়োগের প্রস্তাব করতে পারে। এতে এটাও জানা গেল, ৪০৪টি পদ শূন্য রয়ে গেছে। প্রস্তাবিত সংবাদে পিএসসির বরাত দিয়ে বলা হয়, প্রাধিকার কোটার প্রার্থীদের না পাওয়ায় কিছু পদে সুপারিশ করা যায়নি।
আলোচনার বিষয় ৪০৪টি শূন্যপদ নিয়ে। এর ২৮৮টি সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের। পররাষ্ট্র, নিরীক্ষা ও হিসাব, কর এবং তথ্য ক্যাডারেও পদ শূন্য রয়েছে যথাক্রমে ২, ১, ১ ও ১টি। তেমনভাবে প্রফেশনাল ও টেকনিক্যাল ক্যাডারে শূন্য রয়েছে বেশ কিছু পদ। অথচ চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ প্রার্থীর সংখ্যা ৮ হাজার ৭৬৩। অনুমান করা অসংগত হবে না যে বিশেষ দু-একটি টেকনিক্যাল পদ ব্যতীত অন্য ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ার মতো যোগ্য প্রার্থী উত্তীর্ণদের মধ্যে রয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁদের নেই প্রাধিকার। একসময় প্রাধিকার কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী না থাকলে মেধাতালিকা থেকে পূরণ করা হতো। পরে সিদ্ধান্ত হয়, প্রাধিকার কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী না থাকলে সেই পদ শূন্য থাকবে। সিদ্ধান্তটি কমিশনের নয়, সরকারের।
উল্লেখ্য, বর্তমানে কোটাপদ্ধতির নৈতিকতাই প্রশ্নবিদ্ধ। সেখানে উপযুক্ত প্রার্থী না থাকলে পদ শূন্য রাখার যৌক্তিকতা কি কেউ দিতে পারবেন? শূন্য রাখার এ পরিণতি কী? আলোচিত সংবাদ সূত্রমতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় ৩০৬টি প্রতিষ্ঠানে ১৫ হাজার ২৪৬টি শিক্ষকের পদ রয়েছে। এর মধ্যে শূন্যপদের সংখ্যা ৩ হাজার ৪৯৮। ৩৪তম বিসিএসে ৮৩৫ পদে সুপারিশ করেছে পিএসসি। সবাই নিয়োগ পেলেও শূন্য থাকবে ২ হাজার ৬৬৩টি পদ। এক বিসিএস থেকে পরবর্তীটির ফলাফল প্রকাশ করতে যে সময় লাগে, তাতে এক-দেড় হাজার শিক্ষক অবসরে যান। তাই এ ধরনের নিয়োগনীতির ফলে শিক্ষকশূন্যতা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। আর এ শূন্যতা ঢাকাসহ অন্য মহানগরগুলোয় লক্ষণীয় হবে না। মফস্বলের কলেজগুলোয় কোনো কোনো বিষয়ে শিক্ষকই নেই।
শূন্য পদগুলো ফেলে রেখে মেধাবীদের বঞ্চিত করা হলো। সংশ্লিষ্ট সংস্থা ভুগছে জনবলসংকটে। মূলত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও অবদান রাখল সিদ্ধান্তটি এ কোটাব্যবস্থার পক্ষে কী যুক্তি আছে, তাও খোলাসা করে বলা হচ্ছে না। বেসামরিক সব চাকরির (অধস্তন বিচার বিভাগসহ) ৫৫ শতাংশ পদ প্রাধিকার কোটার আওতায়। আমাদের সংবিধানে সবার জন্য চাকরির সমান সুযোগের বিধান রয়েছে। অবশ্য ব্যতিক্রম রয়েছে শুধু পশ্চাৎপদ এলাকা বা জনগোষ্ঠীর জন্য। কিন্তু সমষ্টিগতভাবে যাঁরা সমাজের অন্য সবার মতো, তাঁদের জন্য এ ধরনের সংরক্ষণ চাকরিগুলোয় মেধাবীদের প্রবেশাধিকার কার্যত সীমিত করে ফেলেছে। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় শাসকদের সহায়তার জন্য একটি দক্ষ প্রথম শ্রেণির সিভিল সার্ভিস দরকার। সেটা তৈরি করতে হলে মেধাকে প্রাধান্য দিয়েই নিয়োগনীতি করতে হয়। ১৯৭৩ সালের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেস রি-অর্গানাইজেশন কমিটি এবং ১৯৭৭ সালের বেতন ও চাকরি কমিশন এ নীতিকেই সমর্থন করে নিয়োগ পর্যায়ে কোটাপ্রথার বিরোধিতা করেছে। দুটোর মতেই একটি উঁচু মানের সিভিল সার্ভিস দেশের জন্য আবশ্যক। আর কোটাপদ্ধতিতে নিয়োগ সে ধরনের সিভিল সার্ভিস গড়ার প্রচেষ্টাকে ভন্ডুল করে দেবে। পাঁচ বছর কাজ করে ২০০০ সালে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। কমিশনের মতে, কোটাপদ্ধতি সংবিধানস্বীকৃত চাকরিতে সবার সমান অধিকারের চেতনার পরিপন্থী। কেউ কেউ এমনটাও বলে থাকেন, বর্তমান কোটাপদ্ধতিটি বজায় রাখার যৌক্তিক ভিত্তির চেয়ে আবেগের ভূমিকাই বেশি। তা ছাড়া, চাহিদারও অতিরিক্ত কোটা সংরক্ষণের ফলে উত্তীর্ণ হওয়া প্রার্থীও জুটছে না কোনো কোনো ক্যাডারে। ফলে, বিভিন্ন দিক দিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন রাষ্ট্রের বেসামরিক প্রশাসনের বিভিন্ন অঙ্গ। তুলনামূলকভাবে কম মেধাবীদের অব্যাহতভাবে নিয়োগ রাষ্ট্রব্যবস্থার বিভিন্ন পর্যায়ে নেতিবাচক দিকটি ক্রমান্বয়ে জোরদার করছে।
এটা সত্যি, উপমহাদেশে সরকারি চাকরিতে নিয়োগকালে কোটাপদ্ধতির প্রয়োগ নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে সেটা ছিল অনগ্রসর শ্রেণি বা অঞ্চলের জন্য। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে, প্রথমে ভারতীয়দের জন্য সংরক্ষণ করা হয় কোটা। তেমনি মুসলমানরা অনগ্রসর ছিল হিন্দুদের চেয়ে। তারাও একপর্যায়ে এ কোটার সুফলের আওতায় আসে। অবিভক্ত পাকিস্তানে তুলনামূলক অনগ্রসর পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য ছিল কোটাব্যবস্থা। পূর্ব পাকিস্তানেও অনগ্রসর, তফসিলি জাতি ও উপজাতীয়দের জন্য কিছু কোটা ছিল। তবে মেধাবীদের ছিল ব্যাপক প্রাধান্য। মেধাকে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগই ছিল না সে সময়ে। এখনই কোটাব্যবস্থা একেবারে তুলে দেওয়ার সময় এসেছে, এমনটাও বলা যাবে না। তবে মেধা কোটাকে ব্যাপক প্রাধান্য দিয়ে প্রাধিকার কোটার পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। পিএসসি তার বিভিন্ন সময়কার বার্ষিক প্রতিবেদনে বর্তমানে চালু কোটাব্যবস্থার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্যাপক সংস্কারের সুপারিশ করেছে। একটি মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিসের পক্ষে বরাবর ছিল পিএসসির অবস্থান। সে অবস্থান সময়ান্তরে এখন কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়েছে। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে অনড়-অচল আছে দীর্ঘকাল। কোনো দলের সরকারই এতে হাত দিতে চায় না। অনস্বীকার্য, এর একটি রাজনৈতিক দিক আছে। তবে সে রাজনৈতিক দিককে বিবেচনায় রেখেও এখানে বড় ধরনের সংস্কার সম্ভব।
এরপর থাকছে শূন্যপদ থাকলেও প্রাধিকার কোটায় উত্তীর্ণ প্রার্থী পাওয়া না গেলে তা শূন্য রাখার সরকারি বিধান। এর কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকতে পারে না। বরং মনে হচ্ছে, ভাগের চিড়া চিবিয়ে ফেলে দেব, তবু খেতে দেব না অন্যকে। কিন্তু বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না, এ ভাগটাই অন্যায্য। যেটুকু অব্যবহৃত থাকে, তা বিনা বাক্যে মেধা কোটায় দিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা পিএসসিরই থাকার কথা। ৩৩তম বিসিএসে সরকারের নির্দেশে তা করা হয়েছেও। আগেও হয়েছে বেশ কিছু সময়ে। এতে তো কোটাব্যবস্থায় হাতও পড়ে না। তাহলে শঙ্কা আর ভয় কিসের। পরের বছর আরও বেশিসংখ্যক পদ খালি হবে এসব ক্যাডারে। তখন প্রাধিকার কোটায় আরও বেশি প্রার্থী পাওয়া যাবে, এমনটা কোন বিশে­ষণ থেকে বিবেচনা করা হচ্ছে, তা বোধগম্য নয়।
শূন্যপদগুলো ফেলে রেখে মেধাবীদের বঞ্চিত করা হলো। সংশ্লিষ্ট সংস্থা ভুগছে জনবলসংকটে। মূলত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ। শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধিতেও অবদান রাখল সিদ্ধান্তটি। কোনো কোনো প্রার্থীর কর্মজীবনের মোড় ঘুরে গেল। বয়ঃসীমা উত্তীর্ণ হওয়ায় তাঁরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের উপযুক্ততা হারিয়ে ফেললেন। সরকারি সিদ্ধান্ত মানতে গিয়ে পিএসসি এমনটা করেছে। তবে তথ্যাদি দিয়ে সরকারের নজরে বিষয়টি আনলে ইতিবাচক কিছু ঘটতেও পারত। আড়াই বছর সময় নিয়েও সুবিচার নিশ্চিত করা গেল না ৩৪তম বিসিএসের বেশ কিছু প্রার্থীর প্রতি। চার শতাধিক শূন্য পদের এ মেধাতালিকা থেকে পূরণ করার কোনো উদ্যোগই পিএসসি নেয়নি। সরকারি সিদ্ধান্তের আলোকে তারা হয়তো বা সঠিক। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত ও পিএসসির কার্যক্রম যান্ত্রিক ও নির্দয়।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.