অ্যালার্জির চিকিৎসা by অধ্যাপক ডা: জি এম ফারুক

অ্যালার্জি। বাংলায় যার প্রতিশব্দ অপছন্দ। ক্লিমেনস ফন পির্কে (১৮৭৪-১৯২৯) নামে একজন অস্ট্রিয়ার শিশুচিকিৎসক ১৯০৬ সালে এই অ্যালার্জি শব্দটি প্রথম প্রয়োগ করেন। শব্দটি গ্রিক। গ্রিক ভাষায় ‘অ্যালো’ মানে ভিন্ন এবং ‘আরজন’ মানে ক্রিয়া। তাই অ্যালার্জির মানে দাঁড়ায় ভিন্নধরনের ক্রিয়া। অর্থাৎ এমন একটা ক্রিয়া, যা সাধারণ থেকে ভিন্ন। যেসব জিনিস থেকে এ ধরনের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হয় (ফুলের রেণু বা সাবানে ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ) এগুলোকে বলা হয় অ্যালার্জিন। এ ধরনের অ্যালার্জিনের সংখ্যা অগণিত। এমন কথাও বলা যায়, পৃথিবীর যেকোনো জিনিস থেকেই অ্যালার্জি হওয়া সম্ভব। তবে খুব পরিচিত অ্যালার্জিন হলো বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য (পনির, গরুর দুধ, ময়দা, ডিম প্রভৃতি) ধুলো, ফুলের রেণু, কিছু ওষুধ ও রাসায়নিক পদার্থ। সংবেদনশীল (অ্যালার্জিক) মানুষের ওপর অ্যালার্জিনের প্রতিক্রিয়া তখনই হয়, যখন শরীরের সাথে বস্তুটির প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটে। এ প্রত্যক্ষ যোগাযোগ চার প্রকারে হতে পারে- ১. নিঃশ্বাসের মাধ্যমে, যেমন- ফুলের রেণু; ২. কোনো কিছু খেলে, যেমন- গরুর দুধ; ৩. সুচ প্রয়োগ, যেমন- টিকা; ৪. স্পর্শের মাধ্যমে, যেমন- কসমেটিক বা কৃত্রিম রঙ।
এসব ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। যেমন- নিঃশ্বাসের সাথে অ্যালার্জিন গ্রহণ করলে শ্বাসকষ্ট হয়। অ্যালার্জিনটি খাবার হলে বমনেচ্ছা, বমি, পেট খারাপ বা পেটের অসুখ হয়। অ্যালার্জিনটি কসমেটিক কিংবা কৃত্রিম রঙ হলে চর্মের সংস্পর্শে তা ফুসকুড়ি, চুলকানি বা পানিভরা ফোসকা সৃষ্টি করবে।
অ্যালার্জির প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যে পরীক্ষা করা হয় তার নাম প্রাউসনিৎস-কুস্টনার বিক্রিয়া। হাইনৎস কুস্টনার (১৮৯৭-১৯৩১) এর আবিষ্কারক। তিনি ছিলেন একজন জার্মান স্ত্রীরোগবিশারদ। তার প্রচণ্ড অ্যালার্জি ছিল রান্না করা মাছে। রান্না করা মাছ খেলেই তার গা চুলকাত। হাঁচি, কাশি ও বমি হতো। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর এসব প্রতিক্রিয়া বন্ধ হতো।
কুস্টনারের এ প্রতিক্রিয়ার গবেষণায় এগিয়ে এলেন তৎকালীন জার্মান জীবাণুতত্ত্ববিদ কার্ল ভিলহেলম প্রাউসনিৎস (১৯৬১-১৯৩৩)। তিনি কুস্টনারের রক্ত থেকে কিছু সিরাম (রক্তের পানীয় অংশ) তার নিজের রক্তের সাথে মিশিয়ে দেন ইনজেকশনের মাধ্যমে। তারপর রান্না করা মাছের নির্যাসের ইনজেকশন দেন তার শরীরের একই জায়গায়, যেখানে রক্তের সিরামের ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল। ইনজেকশনের পরপরই তিনি হতবাক হয়ে দেখলেন, কুস্টনারে দেহের প্রতিক্রিয়াগুলো তার শরীরেও স্পষ্ট প্রতীয়মান। প্রাউসনিৎসের এ পরীক্ষাটির দ্বারা তার রিয়াজিন তত্ত্ব প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ তার মতে, সংবেদনশীল মানুষের রক্তে একধরনের বিশেষ পদার্থ আছে, যার নাম রিয়াজিন (রিএজেন্ট থেকে রিয়াজিন)। এই রিয়াজিন ও অ্যালার্জিনের বিক্রিয়ার ফলেই শরীরে নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়। স্বাভাবিক মানুষের রক্তে সাধারণত এই রিয়াজিন থাকে না। বর্তমানে এই রিয়াজিনকে বলা হয় ‘ইম্যুনোগ্লোবুলিন-ই অ্যান্টিবডিজ’। এখানে অ্যান্টিবডি হচ্ছে ওইসব রাসায়নিক পদার্থ, যা অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে শরীরে সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ যখনই কোনো বহিরাগত প্রোটিন দেহে প্রবেশ করে, তখনই আমাদের শরীর তাকে শত্রু বলে চিহ্নিত করে এবং এর বিরুদ্ধে রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করতে শুরু করে। যেসব পদার্থ প্রোটিনের বিরুদ্ধে রাসায়নিক তৈরি করতে শরীরকে বাধ্য করে, তাদের বলা হয় অ্যান্টিজেন (গ্রিক অ্যান্টিজেন অর্থ আমি সৃষ্টি করি)। বস্তুত সব অ্যালার্জিনই হলো অ্যান্টিজেন। এসব অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে শরীর যেসব রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে তাকে বলা হয় ‘অ্যান্টিবডি’। এই অ্যান্টিবডিও প্রোটিন অণু, যা রক্তের সাথে মিশে থাকে।
আমরা জানি, মানুষের ১০০ কিউবিক সেন্টিমিটার রক্তে প্রায় সাত গ্রাম প্রোটিন থাকে, যার মধ্যে প্রধানত তিন প্রকার প্রোটিন থাকে। মোট প্রোটিনের ৬০ শতাংশ হলো অ্যালবুমিন, ৩৫ শতাংশ গ্লোবিউলিন (কারণ তারা গোলাকৃতি) এবং বাকি ৫ শতাংশ হলো ফাইব্রিনোজেন, যার সাহায্যে রক্ত জমাট বাঁধে। আমাদের শরীরের সব অ্যান্টিবডি থাকে রক্তের গ্লোবিউলিন অংশে। আর অনাক্রম্য ইমিউন বিক্রিয়ায় (অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি বিক্রিয়া) সাহায্য করে বলে তাদের বলা হয় ইম্যুনোগ্লোবিউলিন। যেসব গ্লোবিউলিন এই অনাক্রম্য বিক্রিয়ায় জড়িত থাকে না তাদের বলা হয় নন-ইমিউন গ্লোবিউলিন। তাদের কাজ হলো বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ রক্তে বয়ে নিয়ে যাওয়া। গঠনপ্রণালীর ভিত্তিতে পাঁচটি বিভিন্ন শ্রেণীর প্রধান ইম্যুনোগ্লোবিউলিন শনাক্ত করা হয়েছে এবং নামে পরিবর্তে বিভিন্ন ইংরেজি অক্ষরের তাদের প্রকাশ করা হয়। এই পাঁচটি প্রধান ইম্যুনোগ্লোবিউলিন হলো ওমস, ওমঅ, ওমএ, ওমঊ, ওমউ এদের মধ্যে ওমঊ অ্যালার্জি বিক্রিয়ায় জড়িত (ওম মানে ইম্যুনোগ্লোবিউলিন)।
এখানে, মনে রাখা দরকার, রোগ সৃষ্টিকারী সব জীবাণুতেই প্রোটিন রয়েছে। দেহের অনাক্রম্য ব্যবস্থা ইমিউন সিস্টেম এসব বিপজ্জনক প্রোটিনকে সহজেই শনাক্ত করে তার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য অ্যান্টিবডি সৃষ্টি করতে আরম্ভ করে। সব অ্যান্টিবডিই যে সবরকম অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে লড়তে পারে তা কিন্তু নয়। বরং প্রত্যেক অ্যান্টিবডিই সুনির্দিষ্ট এবং কোনো একটি বিশিষ্ট অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধেই লড়তে পারে।
আমাদের শরীরে নিরীহ প্রোটিনের জন্য যে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয় সেগুলো ইম্যুনোগ্লোবিউলিনের ওমব শ্রেণীর। তারা অবস্থান করে বিশেষ ধরনের এক কোষের ওপর, যার নাম মাস্ট সেল। এগুলো প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় চামড়ায়, শ্বাসনালী এবং খাদ্যনালীতে। এদের মধ্যে বহু রাসায়নিক পদার্থ থাকে যাদের প্রধান হলো ‘হিস্টামিন’। যখন কোনো নিরীহ প্রোটিন অথবা অ্যালার্জিন দেহে প্রবেশ করে, যেমন- ফুলের পরাগ, তখন তারা ওই মাস্ট সেলে পৌঁছে যায়, যার উপর ইতোমধ্যে ওই অ্যালার্জিনের প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি বসে আছে। তখন তাদের মধ্যে শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ, যার ফলে কোষটি ফেটে যায় এবং নিঃসরিত হয় হিস্টামিন। এ হিস্টামিন অল্প পরিমাণে দেহের পক্ষে উপকারী হলেও, এক সাথে অধিক পরিমাণ নিঃসারিত হলে হিস্টামিন বিপদের সৃষ্টি করে এবং অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। যেমন নিঃশ্বাসের সাথে অ্যালার্জিন শরীরে ঢুকলে যে অ্যালার্জি দেখা দেয় তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো হাঁপানি এবং হে ফিভার। হাঁপানি হলো শ্বাসকষ্ট, যা হতে পারে ফুলের রেণু, প্রাণীর লোম বা ধূলিকণা প্রভৃতি নিঃশ্বাসের সাথে ঢুকে গেলে। বাড়ির মধ্যেই রয়েছে এসব পরিচিত অ্যালার্জিন- যেমন ধূলিকণা, যা চোখে দেখা যায় না অথচ প্রচুর থাকে বিছানায়, কার্পেটে ও পর্দায়। যখনই পরিষ্কার করার জন্য পর্দা বা কম্বল ঝাড়া হয়। তখনই বাড়ির মধ্যে থাকা কোনো সংবেদনশীল মানুষের হাঁপানি শুরু হয়ে যায়।
আবার যেকোনো খাদ্যদ্রব্য থেকেও অ্যালার্জি হতে পারে, যেমন, দুধ, ময়দা, ডিম, স্ট্রবেরি, চিংড়ি, কাঁকড়া, বাদাম, প্রভৃতি। এসব খাবার খেলে সংবেদনশীল মানুষের বমি, বমি ভাব এবং পেটের অসুখ ছাড়াও এর ফলে জিভ বা ঠোঁটও ফুলে যেতে পারে। আর অ্যালার্জিন যদি রক্তপ্রবাহের সাথে মিশে যায় তাহলে গায়ে ফুসকুড়ি বা চুলকানি, কিংবা একজিমা দেখা দিতে পারে। স্পর্শের দ্বারা অ্যালার্জিন শরীরে গেলে চামড়ায় চুলকানি, প্রদাহ বা আমবাত হতে পারে। এখানে মনে রাখা দরকার যে, অ্যালার্জি, অ্যাজমা, একজিমা, তারা তিন সহোদর হিসেবে পরিচিত।
অ্যালার্জির ভালো চিকিৎসা হচ্ছে অ্যালার্জিনকে এড়িয়ে চলা। অ্যালার্জিক খাবার না খাওয়া। কিন্তু বিশেষ অসুবিধা হলো তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। আমাদের চারপাশে বহুবিধ জিনিস আছে এবং তাদের যেকোনো একটার ফলেই অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা দিতে পারে। চার দিকে অসংখ্য রকমের ফুল আছে। কোনো কোনো ফুলের পরাগ থেকে যেকোনো লোকের অ্যালার্জি দেখা দিতে পারে। আবার খাবারে অ্যালার্জি। কিন্তু কোন খাবারে অ্যালার্জি? সব খাবারে সবার অ্যালার্জি থাকে না। কোনো খাবারে কারো অ্যালার্জি আছে কি না তা পরীক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট খাদ্যের লঘু দ্রবণ জিভের তলায় কয়েক ফোঁটা দিয়ে দেখা হয় জিভ বা ঠোঁটের কোনো স্ফীত হলো কি না।
অন্যান্য চিকিৎসাপদ্ধতির মতো হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাপদ্ধতিতেও অ্যালার্জির ভালো ভালো ওষুধ রয়েছে। যেমন ধুলোজনিত অ্যালার্জিতে আর্সেনিক অ্যালবাম, ব্রোমিয়াম, হিপার সালফ ভালো কাজ করে। ফুলের রেণুতে যাদের অ্যালার্জি তাদের জন্য অ্যালিয়াম সেপা, অ্যামোন কার্ব, ন্যাট্রাম সালফ ইত্যাদি ওষুধ। দুধে যাদের অ্যালার্জি তাদের জন্য রয়েছে ক্যালকেরিয়া কার্ব, চায়না, ন্যাট্রাম কার্ব ইত্যাদি। ডিমে যাদের অ্যালার্জি তাদের জন্য পালসেটিলা, চিনিনাম আর্স, ফেরাম মেট ইত্যাদি। গোশতে অ্যালার্জি থাকলে আর্সেনিক অ্যালবাম, কেলি কার্ব, চায়না ইত্যাদি। আপেলে যাদের অ্যালার্জি তাদের জন্য মার্ক কর, বেলেডোনা, আর্সেনিক ইত্যাদি। মাছে অ্যালার্জি থাকলে প্লাম্বাম, কার্বো অ্যালিমিলিস, পালসেটিলা ইত্যাদি। তেমনিভাবে অ্যালার্জিক অ্যাজমার জন্য ব্যবহৃত হয়, আর্সেনিক অ্যাল্ব, আর্সেনিক আয়োড, ন্যাট্রাম সালফ, নাক্স ভম ইত্যাদি। এসব শুধু উদাহরণ। যারা এসব ওষুধ ব্যবহার করবেন তাদেরকে রোগীর বিস্তারিত চিত্র অনুযায়ী ওষুধ বাছাই করতে হবে। মোট কথা অ্যালার্জিতে হোমিওপ্যাথি ওষুধের ফলপ্রদ ব্যবহার রয়েছে।
লেখক : নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হোমিওপ্যাথিক মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ
রোড-১১, বাড়ি-৩৮, নিকুঞ্জ-২, খিলক্ষেত, ঢাকা। মোবাইল : ০১৭১২৮১৭১৪৪, ০১৫৫৬৬৩১৯৬৫।

No comments

Powered by Blogger.