একজন পর্যবেক্ষকের চোখে মিয়ানমার নির্বাচন by তাসকিন ফাহমিনা

ই​য়াঙ্গুনে এনএলডির নেতা–কর্মীদের উল্লাস
মিয়ানমারে ২০১০ সাল থেকে চলে আসা বেসামরিক সরকারের আড়ালে সামরিক সরকারের সরব উপস্থিতি, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর ক্রমাগত দমন-নিপীড়ন-নিধন, এমনকি এদের নাগরিক অধিকার ও ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া, সর্বোপরি জান্তা-সমর্থিত সরকারের অধীনে মিয়ানমারের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু হবে কি না—এই বিষয়গুলো নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ার রিপোর্টগুলো যখন পর্যবেক্ষণ করছিলাম, ঠিক তেমনি সময়ে এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনসের (এনফ্রেল) কাছ থেকে ৮ নভেম্বরের মিয়ানমার নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আমন্ত্রণ আসে। এর আগে আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে নেপাল ও ফিলিপাইনের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা থাকলেও এই নির্বাচন একজন মানবাধিকারকর্মী হিসেবে আমার কাছে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৩১ অক্টোবর ইয়াঙ্গুনে এসে পৌঁছালাম। ঝকঝকে রাস্তাঘাট আর আলো-ঝলমলে ইয়াঙ্গুনে এরই মধ্যে এনফ্রেলের বিভিন্ন দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা এসে জমায়েত হয়েছেন। প্রথম দুই দিন চলল নির্বাচন পর্যবেক্ষণের বিভিন্ন নিয়মকানুন ও দিকনির্দেশনা-বিষয়ক আলোচনা। এনফ্রেলের পাশাপাশি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও কার্টার সেন্টারের আন্তর্জাতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরাও ইতিমধ্যে মিয়ানমারে এসেছেন। আমার নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অঞ্চলটি ছিল তানিনতারি রিজিয়ন। কম্বোডিয়া থেকে আসা একজন নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও ইয়াঙ্গুনের একজন দোভাষীসহ মিয়ানমারের দক্ষিণ-পূর্বে থাইল্যান্ডের বর্ডারের কাছে অবস্থিত তানিনতারির রাজধানী দাউইতে ৩ নভেম্বর ইয়াঙ্গুন থেকে প্লেনে করে পৌঁছে গেলাম এক ঘণ্টার মধ্যেই।
২.
বিভাগীয় ও জেলা নির্বাচন কমিশন, অং সান সু চির দল এনএলডি, জান্তা-সমর্থিত সরকারি দল ইউএসডিপি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কারেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ, মানবাধিকারকর্মী, নিরাপত্তা বাহিনীসহ দেশি ও অন্যান্য বিদেশি পর্যবেক্ষক-নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলাম এই নির্বাচন নিয়ে। বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলের অভিযোগ ছিল ভুয়া ভোটার রেজিস্ট্রেশনসহ মৃত ব্যক্তিদের নাম ভোটার লিস্টে থাকা নিয়ে এবং ত্রুটিপূর্ণ অগ্রিম ভোট ব্যবস্থা নিয়ে। গত ২৯ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমারে অগ্রিম ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এই অগ্রিম ভোট আর্মি, সরকারি কর্মচারী, অসুস্থ ব্যক্তি, হাজতি কিংবা যাঁরা নির্বাচনের দিন নিজ এলাকায় যেতে পারবেন না, তাঁদের জন্য করা হলেও এতে অনেক কারচুপির অভিযোগ ছিল। আমরা অগ্রিম ভোট দেখতে ৬ নভেম্বর দাউই হাসপাতালে গেলাম। সেখানে একটি পুরুষ ওয়ার্ডে বিভিন্ন অসুস্থ ব্যক্তি, তাঁদের আত্মীয়স্বজন, পোলিং এজেন্ট ও পর্যবেক্ষকদের সামনে কোনো রকম গোপনীয়তা ছাড়াই তিনজন অসুস্থ ব্যক্তি ও তাঁদের তিনজন আত্মীয়ের ভোট দিতে দেখা যায়। সেখানে কোনো ব্যালট বাক্সও ছিল না, তাঁদের ভোট বিভিন্ন খামে ভরে নিয়ে যান নির্বাচন কমিশন থেকে আসা প্রতিনিধি। অগ্রিম ভোটিং কখন, কোথায় হচ্ছে এ সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেনি বিভাগীয় নির্বাচন কমিশন। ফলে বারবার আমরা ছুটে গিয়েছি বিভিন্ন জায়গায় খবর নিতে। তবে দাউই জেলখানায় আসামিদের অগ্রিম ভোটের ব্যবস্থা ছিল, যা আমরা পর্যবেক্ষণের সুযোগ পেয়েছিলাম।
৩.
এরই মাঝে কথা হলো হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই ভোটের অধিকার নেই। কারণ, তাঁদের ভারত-পাকিস্তান থেকে আসা সংকর জাতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যদিও তাঁদের পূর্বপুরুষেরা কয়েক শ বছর আগে মিয়ানমারে এসেছিলেন।
মিয়ানমার নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। মোট প্রার্থীর মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ ছিলেন নারী। তানিনতারি রিজিয়নে ১৭৮ প্রার্থীর মধ্যে নারী ছিলেন মোটে ১৪ জন। কেন নারী প্রার্থীর সংখ্যা এত কম? এই প্রশ্ন নারী অধিকারকর্মী নেইয় নেইয় অ্যায়েকে করা হলে তিনি বলেন, এখানে নারীদের পুরুষের অধীন মনে করা হয়। তাঁদের ঘর সামলানো, শিশু প্রতিপালন করা—এসব প্রধান কাজ বলে মনে করা হয়। বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত পুরুষেরাই নেন। নেইয় নেইয় অ্যায়ে বলেন, তানিনতারি রিজিয়নের অনেক নারী থাইল্যান্ডে পাচারের শিকার হন। ১৪–১৫ বছর বয়সেই অনেক মেয়েশিশুর বিয়ে হয়ে যায়। গ্রামাঞ্চলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিয়েতে রেজিস্ট্রেশন হয় না। ধর্ষণ ও পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন অনেক নারী। তিনি আরও জানান, নির্বাচনে কীভাবে ভোট দিতে হবে, তার প্রশিক্ষণ তাঁদের সংস্থা নারী ভোটারদের দিয়েছেন।
কথা হলো, মাঠে কর্মরত নারী কৃষকদের সঙ্গে। কি সু পিং জানান, তাঁদের কিছু জমি সরকারি দল ইউএসডিপির সঙ্গে সম্পর্কিত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখল করে নিয়েছেন। তিনি জানান, তিনি তাঁর অধিকার রক্ষা ও পরিবর্তনের লক্ষ্যে ভোট দিতে যাবেন।
৪.
৮ নভেম্বর নির্বাচনের দিন ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে বাতও ভোটকেন্দ্রে এসে পৌঁছালাম। সকাল ছয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ভোটের সময়। কিন্তু ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে শ খানেক নারী-পুরুষ কেন্দ্রের সামনে ভোট দেওয়ার জন্য লাইন করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমরা ভোটকেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম ভোট নেওয়ার যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে এবং ঠিক সকাল ছয়টা থেকে ভোটের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। নির্বাচনের দিন আমরা দাউই, লাংলং ও তাইএছাং—এই তিনটি টাউনশিপের ২৪টি ভোটকেন্দ্র ঘুরে ঘুরে দেখেছি। সবখানেই উপচে পড়া মানুষের ভিড়। চারদিকে একটা উৎসবের আমেজ। মুখে পান নিয়ে লুঙ্গি পরা ভোটাররা শান্তিপূর্ণভাবে সারিবদ্ধ হয়ে ভোট দেওয়ার জন্য তাতানো রোদ উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তবে এরই মাঝে কেউ কেউ তাঁদের নাম ভোটার লিস্টে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। কথা হচ্ছিল সংখ্যালঘু কারেন সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বিমর্ষ ও নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর নাম ভোটার লিস্টে ছিল না!
৫.
কয়েকটি ভোটকেন্দ্রে ভোট গণনা পর্ব দেখে যখন হোটেলে ফিরলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ১০টা ছুঁই ছুঁই করছে। পরদিন সকালে নির্বাচন কমিশন অফিসে যাব বলে হোটেলের লবিতে এসে পৌঁছাতেই এক অপরিচিত নারী আমার কাছে ছুটে এসে বললেন, ‘আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে আপনারা এসেছিলেন বলে নির্বাচন সুষ্ঠু হলো, ব্যাপক কারচুপি করতে পারল না! আমি আপনাদের জন্য অন্তর থেকে প্রার্থনা করি।’
যেতে যেতে মনে হচ্ছিল মানুষের ন্যায়সংগত সংগ্রামকে চাপা দিয়ে রাখা যায় না। মিয়ানমারের জনগণ ভোটের মাধ্যমেই এর জবাব দিয়েছে। মিয়ানমারের ত্রুটিপূর্ণ সংবিধান সংশোধন করে, ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল করা হবে এবং রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকার রক্ষাসহ অন্যান্য জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংগ্রামও ভবিষ্যতে স্বীকৃতি পাবে বলে বিশ্বাস করি। মিয়ানমারের জন্য রইল শুভকামনা।
তাসকিন ফাহমিনা: অধিকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানবাধিকারকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.