অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর

উত্তর-পূর্ব ভারতের আসাম রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের হাতে তাঁকে তুলে দেয় কারা কর্তৃপক্ষ। অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে তাঁর দুই সহযোগী লক্ষ্মী প্রসাদ গোস্বামী ও বাবুল শর্মাকেও হস্তান্তর করা হয়।
দুই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশের কারণে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে এই তিনজনকে হস্তান্তর করা হয়। পরে সীমান্ত দিয়ে তাঁদের ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে তাঁরা ভারত সরকারের হেফাজতে আছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকের মাত্র পাঁচ দিন আগে অনুপ চেটিয়াকে ভারত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা হলো।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ঢাকায় ও ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে অনুপ চেটিয়াকে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়। সর্বশেষ গত ৭ মে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে অনুপ চেটিয়া এবং তাঁর দুই সহযোগীকে সর্বোচ্চ মানবিক বিবেচনায় ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। এর আগে গত এপ্রিল মাসে ভারতীয় হাইকমিশনের কর্মকর্তারা এই তিনজনের সঙ্গে কারাগারে দেখা করেন। তখন তাঁরা দেশে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
অনুপ চেটিয়া ১৯৯৭ সাল থেকে বাংলাদেশের কারাগারে বন্দী ছিলেন। হস্তান্তরের আগে তিনি কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন।
অতীতে বিভিন্ন সময় অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তর করতে বাংলাদেশের ওপর ভারতের চাপ ছিল। কিন্তু তিনি বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ২০০৩ সালের ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেন। এরপর তাঁর পক্ষে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা এ নিয়ে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করে। ওই আবেদনে অনুপ চেটিয়ার সাজা শেষ হলে তাঁকে তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানোর অনুমতি চাওয়া হয়।
মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার মহাসচিব সিগমা হুদা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অনুপ চেটিয়ার পক্ষে রিট আবেদন করেছিলেন। কয়েক বছর ধরে আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ নেই।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, অনুপ চেটিয়া দীর্ঘদিন কারাগারে আটক ছিলেন। তাঁর আটকাদেশ শেষ হয়েছে। তিনি ভারতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এ জন্য তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। গতকাল সকালে তিনি বাংলাদেশের সীমান্ত পার হয়েছেন।
এদিকে কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজি-প্রিজনস) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি সেল থেকে ভারতীয় দূতাবাসের দুই প্রতিনিধির কাছে উলফা নেতা অনুপ চেটিয়া ও তাঁর দুই সহযোগীকে হস্তান্তর করা হয়। ২০০৪ সালের পর থেকে তাঁরা মুক্ত কয়েদি (রিলিজ প্রিজনার) হিসেবে কারাগারে ছিলেন। এর আগেও বাংলাদেশ থেকে এ ধরনের বন্দীকে ভারতীয় দূতাবাস নিয়েছে।
১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসা থেকে ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) অন্যতম শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান এবং অবৈধভাবে বিদেশি মুদ্রা ও একটি স্যাটেলাইট ফোন রাখার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়। আদালত তিনটি মামলায় তাঁকে যথাক্রমে তিন, চার ও সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। একসঙ্গে তিন মামলার সাজা কার্যকর হওয়ায় সাত বছর পরই ২০০৪ সালে তাঁর সাজার মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু তারপর থেকে তিনি কারাগারে আটক ছিলেন।
এরপর অনুপ চেটিয়ার ভাগ্য দুই দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে। ভারতের চাওয়া মেনে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে গতকাল হস্তান্তর করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অফিস থেকে একটি টুইটে গতকাল জানানো হয়, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁকে দীপাবলির শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি জানান, অনুপ চেটিয়ার প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি ভারত সরকার খুব গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পন্ন করে। তবে পরে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরণ রিজিজু সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এটা এক বিরাট সাফল্য। এর ফলে অনেক মামলার সুরাহা হবে। ভারতের দাবি মেনে অনুপ চেটিয়ার প্রত্যর্পণের জন্য তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারকে ধন্যবাদ জানান। আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এই প্রত্যর্পণের ফলে সরকারের সঙ্গে উলফার আলোচনা প্রক্রিয়া গতি পাবে।
আর অনুপ চেটিয়ার ছেলে জুরম সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, খবরটি সত্য হলে তাঁরা আনন্দিত হবেন। অনেক বছর পরে বাবার সঙ্গে দেখা হবে ভেবে তাঁর ভালো লাগছে।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অনুপ চেটিয়ার প্রত্যর্পণের ফলে উলফার বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা শুধু পরেশ বড়ুয়ার অনুগামীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। অনুপ চেটিয়া ও পরেশ বড়ুয়া একসময় একই সংগঠনে ছিলেন। মতপার্থক্যে আলাদা হয়ে যান। কিন্তু বাংলাদেশের কড়া নজরদারির ফলে পরেশ বড়ুয়াও খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হলে আসাম তো বটেই, গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে তার একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
২০০৯ সালের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে উলফার চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া, চিত্রবন হাজারিকা, শশধর চৌধুরীসহ আটজন নেতাকে গ্রেপ্তার করে বিএসএফ। পরে এই নেতাদের সহযোগিতায় উলফার সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করে ভারত সরকার। তবে গত প্রায় দুই বছর এ আলোচনা বন্ধ আছে। অনুপ চেটিয়া যুক্ত হলে এ আলোচনা গতি পেতে পারে বলে আসাম ও ভারত সরকার মনে করছে।
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ১৯৭৯ সালে গঠিত হয় উলফা। এরপর দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সশস্ত্র তৎপরতা চালায় সংগঠনটি। অনুপ চেটিয়া উলফার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। তাঁর আসল নাম গোলাপ বড়ুয়া। আর সাংগঠনিক নাম অনুপ চেটিয়া।

No comments

Powered by Blogger.