নাম ও ছবি মুছে ফেলার অপরাজনীতি by সোহরাব হাসান

আগে ছবি ওঠানো-নামানো ও নাম মুছে ফেলার রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনীতিকদের একচেটিয়া সম্পত্তি থাকলেও ইদানীং এর সংক্রমণ প্রতিবেশী ভারতেও মহামারি রূপে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি ওরফে এনডিএ জোট ক্ষমতায় আসার পর ভারতের মনোরাজনৈতিক জগতে যে পরিবর্তন আনার চেষ্টা চলছে, তাকে স্বাভাবিক ঘটনা বলা যায় না। এর পেছনে ক্ষমতাসীন বিজেপি ও তাদের সহযোগী আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দর্শনই কাজ করেছে। কংগ্রেস যেহেতু সেক্যুলার রাজনীতির কথা বলে, সেহেতু তারা ভারতের রাজনৈতিক দর্শন ধারণ করে না—এটাই বিজেপি জোটের দাবি।
ক্ষমতায় আসার দেড় বছরের মাথায় নরেন্দ্র মোদি সরকার সরকারি ডাকটিকিট থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীর ছবি ও নাম ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কংগ্রেস সরকারের আমলে আধুনিক ভারতের নির্মাতা হিসেবে আরও কয়েকজনের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীর ছবিসংবলিত ডাকটিকিট ছাপে, যা এত দিন ব্যবহৃত হয়ে আসছিল। নরেন্দ্র মোদি সরকার বলছে, এখন থেকে ডাকটিকিটে ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীর নাম থাকবে না। নামের সঙ্গে পরিচয়ের পরিবর্তনও লক্ষণীয়। কংগ্রেস বলেছিল, এঁরা আধুনিক ভারতের নির্মাতা। বিজেপি বলছে, ভারত-নির্মাতা। আধুনিকতার ব্যাপারে তাদের আপত্তিটা অবোধগম্য নয়।
কংগ্রেস সরকার ২০০৮ সালে আধুনিক ভারতের নির্মাতা নামে যেসব নেতার নামে ডাকটিকিট ছেপেছিল, তাঁদের মধ্যে ইন্দিরা ও রাজীব ছাড়াও ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, বি আর আম্বেদকার, হোমি ভাবা, জে আর ডি টাটা, সত্যজিৎ রায় ও মাদার তেরেসা। নরেন্দ্র মোদি সরকার সেই তালিকায় অদলবদল এনে ইন্দিরা ও রাজীবের সঙ্গে সি ভি রমণ, হোমি ভাবা, জে আর ডি টাটা ও সত্যজিৎ রায়কেও বাদ দিয়েছে।
সত্যজিৎ রায়কে বাদ দেওয়া! যিনি ভারতের চলচ্চিত্রকে বিশ্বসভায় পরিচিত করিয়েছেন, অস্কারের লাইফটাইম অ্যাসিভমেন্ট পুরস্কার পেয়েছেন, বিজেপি সরকারের কাছে তাঁর কোনো গুরুত্বই নেই। অথচ এই সত্যজিৎ রায় অসুস্থ থাকাকালে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরা কলকাতায় এসে তাঁর হাতে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দিয়ে গিয়েছিলেন। মিতেরা সত্যজিৎ রায়কে চিনতেন, কিন্তু নরেন্দ্র মোদি চেনেন না। মোদির কাছে ভারতের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার হওয়াই যথেষ্ট নয়; তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে হিন্দুত্ববাদের মিশেল থাকতে হবে। সত্যজিৎ রায় বা সি ভি রমণের স্থলে তিনি বেছে নিয়েছেন ছত্রপতি শিবাজি, মহারানা প্রতাপ, বাল গঙ্গাধরকে। এটাই বিজেপির রাজনীতির সঙ্গে খাপ খায়। বিজেপি সরকারের নতুন তালিকায় আরও আছেন হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়; ১৯৪৭ সালে যিনি ভারত ভাগ না হলেও বাংলা ভাগ করতে হবে বলে গোঁ ধরেছিলেন।
দুই.
বিজেপি সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে কংগ্রেস। দলের কেন্দ্রীয় নেতা আনন্দ শর্মা বলেছেন, ‘আমরা ইন্দিরা ও রাজীবের প্রতি সরকারের এই উদ্যোগ ও মনোভাবের তীব্র নিন্দা জানাই।’ দিল্লিতে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে কংগ্রেস নেতা শোভা ওঝা সস্তা রাজনীতি না করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। কংগ্রেসের মুখপাত্র রণদীপ সিং সূর্যওয়ালার দাবি, নরেন্দ্র মোদি ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়েই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তবে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ সরকারের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, দুই ধরনের ডাকটিকিট ছাপানো হয়। একটি কোনো স্থানের বা ব্যক্তির প্রতি সম্মান দেখিয়ে স্মারক, আরেকটি হলো নির্দিষ্ট বা দৈনন্দিন ব্যবহারের ডাকটিকিট। ইন্দিরা গান্ধীর ওপর চারবার ও রাজীব গান্ধীর ওপর দুবার স্মারক ডাকটিকিট ছাপানো হয়েছে। তাই আর ছাপানো যাবে না। কিন্তু সাম্প্রদায়িক নেতা বাল গঙ্গাধর ও শ্যামা প্রসাদের নামে ডাকটিকিট ছাপতে কোনো বাধা নেই। এরপর হয়তো বিজেপি সরকার বাল ঠাকরের নামেও ডাকটিকিট ছাপবে এবং সেটি ভারতের জনগণকে ব্যবহার করতে বাধ্য করবে।
ডাকটিকিটের সঙ্গে চিঠির খামের বিষয়টিও সামনে এসেছে। সরকার ইন্দিরা গান্ধীর ছবিসংবলিত খামের পরিবর্তে যোগব্যায়ামের ছবিযুক্ত খাম ছাড়ার চিন্তাভাবনা করছে মোদি সরকার। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতে যোগব্যায়াম চলে আসছে। কিন্তু বিজেপি নেতারা এটিকে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা হিসেবে ব্যবহার করছেন। এমনকি আন্তর্জাতিক যোগব্যায়াম বা ইয়োগা দিবস পালনেরও ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
বিজেপি নেতারা বলছেন, জাতীয় নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দীন দয়াল উপাধ্যায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, সর্দার বল্লভ ভাই, ছত্রপতি শিবাজি, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ভগবৎ সিং, বাল গঙ্গাধর, জয়প্রকাশ নারায়ণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাম মনোহর লোহিয়া, বিবেকানন্দ, মাদার তেরেসা ও মহারানা প্রতাপের স্মরণে নির্দিষ্ট ডাকটিকিট প্রকাশ করা হবে। বিজেপির দাবি, স্বাধীনতাসংগ্রাম ও ভারত নির্মাণে যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁদের সবাইকে সম্মান জানানো উচিত। একটি পরিবারে এটি সীমিত রাখা যায় না। নির্বাচনের আগে মোদি ভারতকে কংগ্রেসমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। নির্বাচনের পর সরকার ভারতকে সেকু৵লারমুক্ত করার কাজটি জোরেশোরে শুরু করেছে।
স্বাধীনতার বহু বছর পর বিজেপি গঠিত হলেও দলের নেতারা এখন স্বাধীনতাসংগ্রামে ভাগ বসাতে চাইছেন। বিজেপি নেতারা বলছেন, স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় বিজেপি না থাকুক, আরএসএস ও হিন্দু মহাসভা ছিল। তাহলে কংগ্রেস স্বাধীনতার একমাত্র হকদার হবে কেন? এই যুক্তিতেই মোদি সরকার ইতিহাসের পরিত্যক্ত পাতা থেকে হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস নেতাদের খুঁজে বের করছে।
তিন.
বিজেপি সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর কেন্দ্রীয়ভাবে এবং বিভিন্ন রাজ্যে ছবি ওঠা-নামা এবং নাম পরিবর্তনের মহড়া চলছে। নাম বদলের এই পাঠ তারা বাংলাদেশ থেকে নিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। উপমহাদেশের সব দেশেই এখন রাজনৈতিক অবক্ষয় চলছে। ক্ষমতাসীনেরা সামনে তাকানোর কথা বলে দেশকে পেছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। হিন্দুত্ববাদ, তথা ধর্মীয় জাগরণের বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসাকে বিজেপি সরকার নৈতিক দায়িত্ব মনে করছে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোয় পাঠ্যবই পরিবর্তনসহ সবকিছু গৈরিকীকরণ চলছে। অটল বিহারি বাজপেয়ি ক্ষমতায় থাকতেও হিন্দুত্ববাদের প্রসার ঘটানো হয়েছিল। তবে তিনি রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিপুল ভোটে বিজয়ী নরেন্দ্র মোদি নব ভারত নির্মাণের যে হিন্দুত্ববাদী পথ নিয়েছেন, তা কেবল ভারত নয়, উপমহাদেশের জন্যই বিপজ্জনক।
কেবল ডাকটিকিট বা চিঠির খাম নয়, বিজেপি সরকার জাদুঘরসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনায় হাত দিয়েছে বিজেপি সরকার। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতিমন্ত্রী মহেশ শর্মা বলেছেন, এসব জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য যাতে আরও বেশি কার্যকরভাবে জনগণের কাছে পৌঁছায়, সে জন্য ঐতিহাসিক নিদর্শনের পাশাপাশি সমসাময়িক উপাদানগুলো সন্নিবেশিত করা হবে। বিজেপি সরকার নেহরু স্মৃতি জাদুঘর ও লাইব্রেরি, ত্রিমূর্তি ভাবনসহ ৩৯টি প্রতিষ্ঠানকে নতুন করে সাজাতে চাইছে। নেহরু স্মৃতি জাদুঘরে নাকি কেবল একটি পরিবারের কীর্তি তুলে ধরা হয়েছে।
কংগ্রেস বলেছে, সরকারের এই পরিকল্পনা একরকম ‘শয়তানি’। সরকার মানুষের মৌলিক চেতনা ও চরিত্র ‘দুর্বল ও নিষ্প্রভ’ করে দিচ্ছে। দলের মুখপাত্র রণদীপ সিং বলেছেন, ‘আমাদের জাতি গঠনে আরএসএস ও বিজেপির কোনো ভূমিকা নেই। এখন তারা আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রামের গৌরবময় ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বিকৃত করার শয়তানি শুরু করেছে।’ নেহরু স্মৃতি জাদুঘর ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের সংগ্রামের স্মারক; এটি ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের প্রতীকও বটে। আর স্বাধীনতার পর সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের গড়ে ওঠার প্রতীক হিসেবেও দাঁড়িয়ে আছে এই নেহরু স্মৃতি জাদুঘর। আরএসএস, বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও দেশের অন্যতম সেরা সন্তান পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে খাটো করার চেষ্টা করলেও সফল হবেন না, মানুষ সেটা গ্রহণ করবে না।
চার.
দেড় বছর আগে নরেন্দ্র মোদি নতুন ভারত নির্মাণের যে স্বপ্ন দেশবাসীকে দেখিয়েছিলেন, সেটি কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে? প্রথম বছরটিতে তিনি জনপ্রিয়তা মোটামুটি ধরে রাখতে পারলেও দ্বিতীয় বছরে এসেই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। তাঁর ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগানও খুব সাড়া জাগাতে পারেনি। কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল দুর্নীতি, অনুন্নয়ন ও বেকারত্ব নিয়ে। কিন্তু গত এক বছরে খুব কম ক্ষেত্রেই বিজেপি সাফল্য দেখাতে পেরেছে। মন্ত্রীরাও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। গত দেড় বছরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকেরা। একমাত্র মহারাষ্ট্রেই গত এক বছরের ১ হাজর ৩০৬ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন, যা আগের এক বছরের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সম্প্রতি এক সমাবেশে বলেছেন, ‘কৃষকেরা এখন নরেন্দ্র মোদিকে গালাগাল দিতে শুরু করেছেন।’ অন্যদিকে উচ্চ বেতন-ভাতার দাবিতে শ্রমিকেরা আন্দোলন করেছেন। মোদি সরকারের আমলে শিক্ষা ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে বরাদ্দ কমেছে। শিক্ষা খাতে আগের সরকারের আমলে বরাদ্দ ছিল ৮২ হাজার ৭৭১ কোটি রুপি, মোদি সরকার নামিয়ে এনেছে ৬৯ হাজার ৭৪ কোটিতে। নৈতিক শিক্ষা, ইতিহাস সংশোধনের নামে হিন্দুত্ববাদের পুনর্জাগরণ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন জওহরলাল ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক জয়া হাসান।
পাঁচ.
বহু বছর আগে কবি আবদুল হাসান লিখেছিলেন—
দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি,
দেবদারু কেটে নিচ্ছে নরম কুঠার তাও রাজনীতি,
গোলাপ ফুটছে তাও রাজনীতি, গোলাপ ঝরছে তাও রাজনীতি!
মানুষ জন্মাচ্ছে তাও রাজনীতি, মানুষ মরছে তাও রাজনীতি!
এখন দালান ওঠা আর দালান ভাঙা রাজনীতি নয়। রাজনীতি হলো ছবি ওঠানো। ছবি নামানো। ছবি সরানো। বাংলাদেশে ছবি নামানোর রাজনীতি শুরু হয়েছিল ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার করার পর। ছবিই–বা বলি কেন, একসময় তাঁর নাম নেওয়াও ছিল অপরাধ। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা হলো, যারা বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল, তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।
তাই বাংলাদেশ ও ভারতের যাঁরাই ছবি-ডাকটিকিট-খাম-জাদুঘর নিয়ে রাজনীতি করছেন, তাঁদের আয়নায় একবার নিজেদের মুখ দেখতে বলব। ‘অন্যের চক্ষে ধূলি নিক্ষেপ করিয়া’ নিজের মহিমা বাড়ানো যায় না। ইতিহাসে যাঁর যেটুকু অবদান আছে, স্বীকার করুন। ইতিহাস যাঁরা গড়েন, ইতিহাস নিয়ে তাঁদের টানাটানি করতে হয় না। এই সরল সত্য ভারত ও বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা মনে রাখবেন আশা করি।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.