গণতন্ত্র দিবস পালিত: সুশীল সমাজকে জায়গা করে দেয়ার আহ্বান

বিশ্বজুড়ে পালিত হলো গণতন্ত্র দিবস। এ দিবস উপলক্ষে সারা বিশ্বে পালিত হয় বিভিন্ন কর্মসূচি। এ বছরের মূল প্রতিপাদ্য ‘স্পেস ফর সিভিল সোসাইটি’ বা ‘সুশীল সমাজকে জায়গা করে দিন’। বিবিসি বাংলার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, এমন সময়ে এই দিনটি পালন করা হয়েছে যখন বাংলাদেশে গত পৌনে দু’বছর ধরে দেশটির বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দল সরকার প্রক্রিয়ার বাইরে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রওনক জাহান বিবিসিকে বলছেন, ‘এটাকে ঠিক তত ভাল গণতন্ত্র বলে মনে করা হচ্ছে না। অনেকদিন ধরে মান নিয়ে প্রশ্ন চলছিল। কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ কোন নির্বাচন যতদিন হচ্ছিল না, ততদিন নিম্নমানের হলেও এটাকে লোকে গণতন্ত্র বলেই দেখতো। কিন্তু ২০১৪’র পর থেকে যখন নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্ন আরম্ভ হলো এবং একটা একতরফা নির্বাচন হয়ে গেল তারপর থেকেই গণতান্ত্রিক যে অবস্থান সেটা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল নানা প্রশ্ন করে চলেছে’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বিবিসিকে বলেছেন- এখনকার অবস্থায় গণতন্ত্র নির্বাসিত বলেই আমি মনে করি। কারণ হলো, গত বছরের ৫ই জানুয়ারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, কোন ভোট না পেয়েও নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য হয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী এর ব্যাখ্যা কি হবে, এটা তার সাংবিধানিক ব্যাখ্যা কর্তারা দিক।  কিন্তু গণতন্ত্র- এ কথা বলতেও কষ্ট হয় আমার। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আইনের শাসন যে প্রতিষ্ঠানগুলোর নিশ্চিত করার কথা, মনে হচ্ছে সেগুলোতে বড় ধরনের রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণ করা হয়েছে। যার ফলে মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি আমি মনে করছি দুর্বলতার দিকে যাচ্ছে।  বিশিষ্ট সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, আমি মনে করি না যে, গণতন্ত্র ও নির্বাচন দুটি সমান। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে না- এটা আমি গ্রহণ করছি না এ অর্থে- আমি মনে করি গণতান্ত্রিক বোধ বাংলাদেশের মানুষের আছে। সরকার মানুষের প্রয়োজনের অংশগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। গণতন্ত্র মানে এই নয় যে, এখানে যথেচ্ছাচার হবে। ওদিকে বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী রবার্ট ওয়াটকিন্স তার এক নিবন্ধে লিখেছেন, নাগরিক সমাজের প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ, যা তাদের পরিচয়ের মধ্যেই গ্রথিত রয়েছে। এসব সংগঠন কোন একক ও স্বতন্ত্র সত্তার প্রতিনিধিত্ব করে না; বরং তা অনেক কণ্ঠের সমাবেশ, যা মতানৈক্যের সময় অভিন্ন প্রশ্নে সবাইকে এক জায়গায় মিলিত করে জাতিগত, ভাষাগত, ধর্মীয় এমনকি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের পক্ষে মত দেয়। নাগরিক সমাজ জনগণের ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে,  যেখানে লোকজন বিভিন্ন মত, আলোচনা ও সংস্কারের কথা বলে, যা হতে পারে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সৃজনশীলতা ও সমাধানের উৎস। নাগরিক সমাজের প্রবণতাই হচ্ছে মাঝে মধ্যে বিদ্যমান অবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা, যা আরও উদার ও অংশীদারিত্বমূলক সমাজের দিকে ধাবিত হতে পারে। যার জন্য সমাজে শুধু ভিন্নমত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সহনশীলতাই নয়; অর্থবহ, ইতিবাচক সংলাপ ও বিতর্কের জন্য উদারতারও প্রয়োজন। শক্তিশালী নাগরিক সমাজ যুগপৎভাবে একটি কার্যকর ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত এবং এর পরিণতি। জাতিসংঘ মনে করে, নাগরিক সমাজকে কোন রকম বাধা-বিঘ্ন ছাড়া বিকশিত হতে দিলেই উন্নয়ন ও গণতন্ত্র সবচেয়ে ভালোভাবে কার্যকর হয়। নাগরিক সমাজ, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগের বিষয়টি সত্যিকার অর্থে সবচেয়ে ভালোভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে বাংলাদেশে। গতিশীল ও শক্তিশালী নাগরিক সমাজের কারণে বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ছাত্র, কর্মী ও বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নিয়ে গড়ে ওঠা ভাষা আন্দোলন, যা চূড়ান্ত পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তি রচনা করেছে, তার মধ্যেই এর উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। সেটি ছিল জনগণের আকাঙ্ক্ষা, পরিবর্তনের পূর্বাভাস ও সুনিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের সত্যিকারের বহিঃপ্রকাশ। ক্ষুদ্রঋণ এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় বেসরকারি সাহায্য সংস্থার জন্মস্থান হওয়ার মধ্য দিয়ে নাগরিক সমাজ স্বাধীনতার পর অব্যাহতভাবে বিকশিত হয়েছে। আজ বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ তার দেশজ দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছে, যা দেশে দুই হাজারের বেশি জাতীয় নাগরিক সমাজ ও  বেসরকারি সংস্থা এবং এরচেয়ে বেশি সংখ্যায় সমাজভিত্তিক গোষ্ঠীকে নিয়ে সবার জন্য আরও উন্নত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে। যখন বৈচিত্র্যময় ও বহুমতের কণ্ঠস্বরগুলো একটি অবাধ ও মুক্ত গণতন্ত্রে চলমান থাকে, তখন অভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সরকারের সেরা সহযোগী হিসেবে কাজ করে নাগরিক সমাজ। বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশের অবস্থানে প্রবেশ করেছে, সে সময়টাতে দেশের সেরা ঐতিহ্যগুলোকে মনে করাটা সংগত। একই সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ যখন  দেশের জনগণকে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে বলে উদ্বিগ্ন, তখন সুস্থ মত ও চিন্তার চর্চা বিকাশের ধারা বজায় রাখতে যথাযথ পরিবেশ যাতে নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে আমাদের সবাইকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.