মায়ের পেটে শিশু গুলিবিদ্ধ: শিশুটির সুস্থতার জন্য মাকে বড় প্রয়োজন

ঢাকা মেডিকেলে ‘বেবি অব নাজমা’
মাগুরায় মায়ের পেটের ভেতর গুলিবিদ্ধ শিশুটির ক্ষতস্থানে গতকাল বুধবার অস্ত্রোপচার করেছেন চিকিৎসকেরা। সময়ের আগে কম ওজন নিয়ে জন্মানো শিশুটি ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলেছেন, এখন শিশুটির সুস্থ হয়ে উঠতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তার মাকে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কানিজ হাসিনার অধীনে ভর্তি গুলিবিদ্ধ শিশুটির নাম হাসপাতালের খাতায় এখনো বেবি অব নাজমা বেগম (নাজমা বেগমের বাচ্চা)।
কানিজ হাসিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘শরীরের ভেতরের ফুসফুস, হৃদ্যন্ত্র অক্ষত থাকলেও শিশুটি সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছে। শিশুটিকে আংশিক অবশ করে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তবে স্বস্তির খবর হলো, সময়মতোই ও সাড়া দিয়েছে। অবশ ভাবটা কেটে যাওয়ার পরই কান্নাকাটি করেছে।’
শিশুটির সুস্থতার জন্য তার মাকে ঢাকায় আনার পরামর্শ দিয়েছেন কানিজ হাসিনা। তিনি বলেন, শিশুটি অপরিণত অবস্থায় জন্মেছে। ওর শরীরে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কম। সাত দিনের এই শিশুটির মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়াতে ওর মাকে দ্রুত ঢাকায় আনা দরকার। ওর পরিবারের সদস্যদেরও বিষয়টি জানানো হয়েছে। কিন্তু তাঁরা বলছেন, শিশুটির মাকে ঢাকায় এনে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য তাঁদের নেই।
অস্ত্রোপচারের পর শিশুটির ফুফু শিখা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটুখানি মেয়ে, আঠারোটা সেলাই লাগিছে। আল্লাহ জানে কী হবি। দেখেন না মুখ-চোখ কেমন হয়ি আছে।’
শিশুটিকে গতকাল কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। চিকিৎসকেরা বলেছেন, ক্ষতস্থানটিতে অস্ত্রোপচার করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না তাঁদের।
মাগুরা শহরের দোয়ারপাড় কারিগরপাড়ায় গত বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হন অন্তঃসত্ত্বা নাজমা বেগম (৩৫)। গুলি মায়ের পেটে শিশুর শরীরও এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেলে। গুলি ও বোমায় আহত নাজমার চাচাশ্বশুর মমিন ভূঁইয়া পরদিন মারা যান।
গতকাল সকালে মাগুরা সদর হাসপাতালের স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ মা নাজমা খাতুন যন্ত্রণায় শুতে পারছেন না। তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
নাজমা বলেন, ‘আমার মামণি পৃথিবীর আলো দেখার আগেই বুক পেতে আমার জীবন বাঁচাল। জন্মের পর ওর মুখটাও আমি দেখতে পারলাম না। যারা আমার মণির কচি বুক ঝাঁজরা করল, আপনারা তাদের ধরে ফাঁসি দেন।’ বললেন, ‘আমার মণিকে ঢাকায় নিয়ে গেছে, তা-ও আমি পরে শুনছি। আমারে কেউ বলেনি। আমারে নিয়েও যায়নি। জানি না আমার সোনামণি কেমন আছে!’
মাগুরা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক শফিউর রহমান বলেন, মা ও নবজাতক দুজনের অবস্থাই সংকটাপন্ন ছিল। দুজনকেই ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল।
গুলিবিদ্ধ শিশুটির বাবা বাচ্চু ভূঁইয়া ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। বাচ্চু ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নাই। এসপি সাহেব আমাকে বলেছেন, বাচ্চাটাকে এখানে রেখে মেরে ফেলবেন? পরে তিনি বাচ্চাকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু বাচ্চার মাকে কেন নেওয়া হয়নি, তা আমি জানি না।’
মাগুরায় সদর হাসপাতালে মা নাজমা বেগম
এ ব্যাপারে মাগুরার পুলিশ সুপার (এসপি) এ কে এম এহ্সান উল্লাহ বলেন, ‘আমি শিশুটিকে ঢাকায় পাঠিয়েছি। তবে মায়ের অবস্থা ভালো বলে তাঁকে পাঠানো হয়নি।’
ঢাকা ও মাগুরার চিকিৎসকেরা বলছেন, মা ও শিশু দুজনই দুজনকে রক্ষা করেছে। তাঁরা মনে করছেন, পেটে শিশুটি থাকায় মা কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। মায়ের পেটের মাংসপেশির ভেতর গুলিটি আটকে ছিল। কিন্তু তার আগে গুলিটি মায়ের পেটে থাকা শিশুটির পিঠ দিয়ে ঢুকে বুকের ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। এরপর সেটি আবার গলার নিচ দিয়ে ঢুকে ডান চোখের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এ কারণে গুলিটি দুবর্লভাবে মায়ের মাংসপেশিতে আঘাত করেছে। গুলিটি শিশুটির শরীর ভেদ করায় সেটি আর মায়ের খাদ্যনালি ও নাড়িভুঁড়িতে বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারেনি। শিশুটি এক অর্থে মায়ের জীবন বাঁচিয়েছে। অন্যদিকে শিশুটি মায়ের পেটের ভেতর পানিতে ভাসছিল। সে কারণে মায়ের পেট ভেদ করে গুলিটি যখন ঢোকে, তখন এর গতি কিছুটা কমে গিয়েছিল। এ ছাড়া শিশুটি মায়ের পেটে স্বাভাবিক অবস্থানে থাকার কারণে গুলিটি পিঠের ও বুকের ওপরের অংশে লাগে। হাড় বা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রক্ষা পায়।
ছাত্রলীগের দুই পক্ষের গোলাগুলির ঘটনার পরদিন নিহত মমিন ভূঁইয়ার ছেলে রুবেল ভূঁইয়া ১৬ জনকে আসামি করে মাগুরা সদর থানায় মামলা করেন। মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সেন সুমনকে (৩২) প্রধান আসামি করা হয়। সেন সুমন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ রেজাউল ইসলামের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। এ ছাড়া আজিব্বর শেখ, মুহম্মদ আলীসহ মামলার অন্য আসামিরা সবাই ছাত্রলীগের সাবেক নেতা-কর্মী। সংগঠনের পদ-পদবিতে না থাকলেও এঁরা বিভিন্ন সময়ে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে থাকেন। পুলিশ মামলার এজাহারভুক্ত আসামি সুমন ও সুবহানকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু গতকাল এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত অন্য আসামিদের কাউকেই গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
জানতে চাইলে এসপি এ কে এম এহ্সান উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তারের সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।

No comments

Powered by Blogger.