সিটি নির্বাচনের জয়–পরাজয় by রোবায়েত ফেরদৌস

সিটি করপোরেশন নির্বাচনের বহু অনিয়মের একটি চিত্র
সদ্য সমাপ্ত সিটি নির্বাচনের তামামি করতে হলে এবারের নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করা জরুরি। কেমন ছিল এবারের নির্বাচন, মনোনয়ন, ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং অবশ্যই ফলাফল। আমি এর কিছু বৈশিষ্ট্য খোঁজার চেষ্টা করেছি, কিছু বিশ্লেষণ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
ক.... এবারের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করেছে, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির বাইরে কোনো তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের বিন্দুমাত্র সুযোগ এখন ও নিকট ভবিষ্যতে নেই। এই দুই দলের বাইরে বাকি সব মেয়র প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদেও আওয়ামী লীগ ব্যাপকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে।
খ.... নির্বাচনে জাল ভোট, কারচুপি ও গণসিল পড়েছে; ব্যালট বাক্স ভাঙচুর ও ব্যালট পেপার ছিঁড়ে ফেলার ঘটনা ঘটেছে; পিটুনি, ছুরিকাঘাত, টাকা বিলির ঘটনা খবরের কাগজে এসেছে। ককটেল বিস্ফোরণসহ বেশ কিছু গোলাগুলি-সংঘর্ষ-সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে; অনেক ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোট দিতে না পারায় ক্ষোভ ও আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। বিরোধী পক্ষের এজেন্টদের আগের রাত কিংবা কাউকে কাউকে তারও আগে থেকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে, সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থক ও পুলিশের উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ডে তাঁরা ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন। নির্বাচনের দিন তাঁদের অনেককেই কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতের নির্বাচনের জন্য এগুলো নিশ্চয়ই ভালো দৃষ্টান্ত হয়ে রইবে না।
গ.... যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ, এএইচআরসি, টিআইবি, ব্রতীসহ বিভিন্ন দেশ, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থা নির্বাচনের অনিয়ম, যেমন: ভোট জালিয়াতি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করেছে। তাদের ভাষায়, ‘নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ’, ‘নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হয়নি’, ‘অনিয়ম, সহিংসতা হয়েছে’। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্বাচনী অনিয়মের তদন্ত দাবি করেছে। বিদেশি গণমাধ্যম রয়টার্স, এএফপি, বিবিসিসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম পুনরায় রাজনৈতিক অস্থিরতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে।
ঘ.... ঢাকার প্রার্থীদের নির্বাচন-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ছিল এ রকম: ‘খেলতে গেলে ফাউল হয়’, ‘ভোট ডাকাতি’, ‘তামাশার নির্বাচন’, ‘এটি বাতিল করে আবার নির্বাচন দিন’, ‘সাড়ে ১২টার পর নির্বাচন বলা যায় না’, ‘প্রহসন হয়েছে’, ‘ভোটের অধিকার খর্ব হয়েছে’ ইত্যাদি। আর নির্বাচনী অনিয়মের অভিযোগে চট্টগ্রামের মেয়র প্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর, যিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাও বটে, কেবল নির্বাচন বর্জন নয়, রাজনীতি বর্জনেরও ঘোষণা দেন। বিএনপির রাজনীতির জন্য এ ঘোষণা যে ভালো ফল বয়ে আনবে না, তা নিঃসংশয়ে বলা যায়।
ঙ.... তিন সিটিতে বাতিল হয়েছে এক লাখেরও বেশি ভোট! বিস্ময়কর বৈকি! উপস্থিতি কম, তবু ৪৫ শতাংশ ভোট পড়েছে—এটাও প্রশ্নের উদ্রেক করে; বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থীদের মাত্র চার ঘণ্টায় এত ভোট প্রাপ্তিও নানা সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। রানার্সআপ হয়েছেন বিএনপির এমন তিন প্রার্থীই নিজেদের ভোট প্রাপ্তির পরিসংখ্যান দেখে অবাক হয়েছেন। আগের সামরিক শাসকদের মতো টেবিল-মেড ফলাফলের চর্চা আবার আমরা শুরু করলাম কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে।
চ.... এবারের নির্বাচনে সরকার-সমর্থকেরা সাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছেন, পুলিশের সামনেই এলোপাতাড়ি কিল-ঘুষি-লাথি মেরেছেন; তাঁদের ক্যামেরা-মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়েছে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে কেন্দ্রছাড়া করা হয়েছে; ঢাকা ও চট্টগ্রামে অন্তত আটজন সাংবাদিকের ওপর শারীরিক আক্রমণ হয়েছে; তাঁদের মোবাইল ফোন, পরিচয়পত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছে; কোথাও আবার সাংবাদিকদের আটকে রাখা হয়েছে; ভয় দেখিয়ে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছে কমপক্ষে ২০ জন সাংবাদিককে; একজন অনলাইন সাংবাদিক গুলিবিদ্ধও হয়েছেন; পুলিশও কিছু কেন্দ্রে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দিয়েছে। এভাবে কোনো নির্বাচনে এত সাংবাদিক লাঞ্ছনার ঘটনা বিরল। গণমাধ্যম গণতন্ত্রের সহায়ক, কোনো সরকার একে প্রতিপক্ষ ভাবলে তা হবে গণতন্ত্র, জনগণের তথ্য জানা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি।
ছ.... নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ভোট গ্রহণ অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর হয়েছে—এমন দাবি করায় এবং ব্যাপক ভোটার উপস্থিতি হওয়ায় কমিশনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে অনিয়মের অসংখ্য অভিযোগ—ভোটের আগে ও পরে—করা হলেও কমিশন একটি অভিযোগও আমলে নেয়নি এবং তার সুরাহা করেনি। এতে কমিশনের ওপর সরকারের চাপ ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রকাশ ও প্রকট হয়ে বেরিয়ে এসেছে। পুলিশ, প্রশাসন কারও ওপরই কমিশনের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। অথচ সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্যতম প্রধান শর্ত স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন; কিন্তু কমিশনের অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা এতটাই প্রকট যে কেবল কমিশনের ওপর নয়, বরং নির্বাচনের ওপরই মানুষের আস্থা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
জ.... নির্বাচনে দায়িত্ব পালনরত পুলিশ, আনসার ও প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। জাল ভোটের সহযোগী হিসেবে পুলিশ, পোলিং ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের খবর গণমাধ্যমে ছবিসহ প্রচারিত হয়েছে; অনেক ক্ষেত্রেই নির্বাচনী কর্মকর্তাদের অসহায়, নিষ্ক্রিয় ও নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। প্রশাসনের দলীয়করণ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, এটা তার নিকৃষ্ট নমুনা।
ঝ.... বিএনপি দল গোছাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে; তাদের সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত মনে হয়েছে; বহুমাত্রিক চাপ উপেক্ষা করেও যে কেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট বা নজরদারির দায়িত্ব পালন করা যায়, সে রকম সাহস তারা দেখাতে পারেনি। ভোট শুরুর চার ঘণ্টা পর নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা সাধারণ কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে; তাঁরা বরং আরও বেশি করে তাঁদের মনোবল হারিয়েছেন এবং সামনের নির্বাচনে এই প্রভাব আরও সুদূরপ্রসারী হবে। মাঝপথে বর্জন ভালো সিদ্ধান্ত হয়নি; ভোট গ্রহণ শেষে এটি করা যেত, এতে অনেকের ভোট প্রদানের প্রত্যাশা বঞ্চিত হয়েছে, প্রত্যাখ্যান ও প্রতিবাদের আরও অনেক উপায় আছে, তা ব্যবহার করা যেত।
ঞ.... ভোটের ফলাফল ৩-০ হওয়ায় আওয়ামী লীগেও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে; কেউ কেউ বলছেন, ফলাফল ২-১ হলে ভালো হতো; দুটি মহানগরে দলের সঠিক অবস্থান ও দুর্বলতা জানা যেত এবং সে অনুযায়ী দলকে সাজানো যেত। অন্তত একটি মেয়র পদ পেলে বিএনপি ভোটের কারচুপির অভিযোগ জোরালোভাবে তুলতে পারত না। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না—বিএনপির এ প্রচার তুলতে পারত না এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন দাবির গ্রহণযোগ্যতা কমে যেত। একটি ভালো নির্বাচন উপহার দিতে পারলে সরকারের ইমেজ বাড়ত, এ রকম জোরজবরদস্তির আদৌ দরকার ছিল কি না, সেই আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি ক্ষমতাসীন দলকে হতে হবে।
ট.... বলা হচ্ছে খারাপ নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু যাঁরা এ প্রক্রিয়ায় মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা ভালো; যেমন আনিসুল হক ও সাঈদ খোকন সজ্জন হিসেবে পরিচিত। এখন দেখার অপেক্ষা নির্বাচনের আগে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি তাঁরা কতটা পূরণ করতে পারবেন। তবে অনেক দুষ্ট কাউন্সিলর কিন্তু এই ফাঁকে নির্বাচিত হয়ে পড়েছেন, মেয়রদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এসব কাউন্সিলরের সঙ্গে আলাপ করে; এ জন্য বাড়তি সতর্কতা জরুরি। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের সঙ্গে নির্বাচিত কাউন্সিলর কীভাবে জড়িত হয়েছেন, তা আমরা জানি।
মোটা দাগে বলা যায়, যেমনটি আশা করা হয়েছিল, তিন সিটির নির্বাচন সেই অর্থে অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ হয়নি; সিটি নির্বাচনে ভোটের খেলায় তাই গণতন্ত্র হেরে গেছে; কেউ কেউ বলছেন, তিন সিটিতেই আওয়ামী লীগ জিতেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের একতরফা জয় এবং বিএনপির একতরফা বর্জনে প্রতারিত হয়েছে জনগণ আর পরাজিত হয়েছে গণতন্ত্র। যাঁরা বিজয়ী হয়েছেন, তাঁদের মহিমাও খাটো হয়েছে। এতে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
রোবায়েত ফেরদৌস: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
robaet.ferdous@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.