চট্টগ্রামে মা-মেয়েকে গলা কেটে হত্যা

মাকে হত্যা করা হয়েছে ২৮টি কোপ দিয়ে। এলোপাতাড়ি ছুরি চালানো হয়েছে শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। তারই কন্যাসন্তানকে হত্যা করা হয়েছে জবাই করে। দুজনকে হত্যার সময় প্রতিবেশীরা শুনলো না কোন চিৎকারের আওয়াজ!  চট্টগ্রামে এমনি এক নৃশংস ঘটনায় খুন হয়েছেন একই পরিবারের মা ও শিশু। এ সময় পরিবারের কেউ বাড়িতে ছিলেন না। ওই মহিলার স্বামী ও শিশুর পিতা পেশায় একজন মাংস বিক্রেতা। বাড়ির পাশেই তার সেই মাংসের দোকান। ঘটনার সময় সন্ত্রাসীরা ১০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে গেছে বলে দাবি করা হয়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় নগরীর সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়া এলাকার মোবাস্বের হোসেনের ৬ তলা ভবনের চতুর্থ তলায় ঘটে এ ঘটনা।
তবে কি কারণে তাদের হত্যা করা হয়েছে সে বিষয়ে পরিবার থেকে নিশ্চিত করে কিছুই বলা হচ্ছে না। স্থানীয় সূত্র ধারণা করছে, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের কেউ এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এ তালিকায় পুলিশ নিহত মহিলার স্বামীকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছে।
ডাকাতি কিংবা পরকীয়া- এ দুই কারণে ঘটনাটি ঘটেছে কিনা তাও যাচাই করা হচ্ছে। একই সঙ্গে পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ রয়েছে কিনা সে বিষয়ে যাচাই-বাছাই করার কথা জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
গতকাল ঘটনার পরপরই সকাল সাড়ে ১০টায় দক্ষিণ নালাপাড়া এলাকার মোবাস্বের হোসেনের ৬ তলা ভবনের চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা যায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। নিহত মায়ের নাম নাসিমা আক্তার (২৮)। আর মেয়ের নাম রিয়া আক্তার। তার বয়স ৮ বছর। সে স্থানীয় পূর্ব মাদারবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী ছিল।
মেয়েটির আরও দুই ভাই রয়েছে। ঘটনার সময় তারা স্কুলে ছিল। তাদের পিতা শাহ আলম ওই এলাকায় মাংস বিক্রি করেন। তার একটি দোকানও রয়েছে বাড়ির পাশের ওই গলিতে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঘটনাটি ঘটে সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে। তবে সাড়ে ৯টায় হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দুটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। প্রথমে মেয়েটির মাকে হত্যা করা হয়েছে। লাশ উদ্ধারের পর নিহত নাসিমার শরীরে এলোপাতাড়ি কোপের দাগ দেখা যায়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিঠ, বুক, কোমর থেকে পা পর্যন্ত ইচ্ছেমতো ২৮টির বেশি আঘাত করা হয়েছে। 
বাসার খাবারের ঘর থেকে মায়ের লাশ উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। আর মেয়ে রিয়ার লাশ পাওয়া যায় বাথরুমে। তাকে জবাই করা হয়েছে। পৈশাচিক কায়দায় হত্যার পর বাড়ির আলমারি ভেঙে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা ও ১০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে নিয়ে চলে যায় সন্ত্রাসীরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহিলার স্বামী শাহ আলম মানবজমিনকে বলেন, আমি সত্যি বলছি কিছুই জানি না। কারা মারলো, কেন মারলো তাও বুঝতে পারছি না। ডাকাতরা আমার সব স্বর্ণালংকার নিয়ে গেছে। যাওয়ার সময় স্ত্রী ও মেয়েকে খুন করেছে।
আপনার সঙ্গে স্ত্রীর কোন বিরোধ ছিল কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে কান্না জড়ানো কণ্ঠে তিনি বলেন, মৃত্যুর কিছু সময় আগে নাসিমার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তখন সে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর কথা বলে। আমি ৯টায় বাসা থেকে বের হয়ে যাই। এর পরপরই ঘটনাটা ঘটলো।
নিহত নাসিমা আক্তারের বাড়িতে খণ্ডকালীন গৃহকর্মী হয়ে কাজ করেন জামেলা আক্তার। তিনি প্রথম মহিলার ভাই আলালকে খবর দেন। গতকাল এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, প্রতিদিন এসে আমি দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকি। কিন্তু আজকে (গতকাল) এসে দেখি দরজা খোলা। পরে ভেতরে ঢুকেই দেখি দুজনের লাশ। রক্ত ভেসে যাচ্ছে মেঝেতে।
জামেলা বলেন, ঘটনাটি আমি প্রথমে নাসিমার ভাইকে জানাই। এরপর খবর পেয়ে পুলিশ আসে। আরেকটু আগে এলে হয়তো সন্ত্রাসীরা এ ঘটনা ঘটাতে পারতো না।
এদিকে নৃশংস ঘটনাটি নিয়ে স্থানীয়দের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে নানা মত। কেউ কেউ বলছেন, ওই বাড়িতে প্রায় সময় লোকজনের আনাগোনা লেগেই থাকতো। কিছুদিন আগে এ নিয়ে বাড়ির মালিক মোবাস্বের হোসেন শাহ আলমকে সতর্ক করে দেন বখাটে লোকজনের আনাগোনার অভিযোগে।
মাংস বিক্রেতা শাহ আলমের সঙ্গে তার স্ত্রীর পারিবারিক কলহের কথা জানান ওই বাড়ির এক বাসিন্দা। বলেন, শাহ আলমের কথা শুনে বোঝা যেত সে তার স্ত্রীকে সন্দেহ করে। তা ছাড়া মাংস বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকায় প্রায়ই বাড়িতে থাকতো না সে। এ নিয়ে অনেক ঝগড়াঝাঁটির কথা জানেন আশপাশের লোকজন।
তবে পুলিশ ঘটনার পরপরই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রকি (২২) নামের বাসার টিউটরকে হেফাজতে নিয়েছে। এ ছাড়া ড্রইংরুম থেকে একটি রক্তমাখা ছুরিও উদ্ধার করা হয়েছে। পাওয়া গেছে দুটি গামছা। শাহ আলমের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার পূর্বধুর গ্রামে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ আলমের পুত্র নগরীর মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র রিয়াদ হোসেন (১০) মানবজমিনকে বলেন, সকালে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় কোন আলামত দেখিনি। পুলিশ আমাকে জিজ্ঞেস করেছে তোমাদের বাসায় কারা বেশি আসতো। আমি স্যার (গৃহশিক্ষক) রকি, কমল দাশ (আরেক মাংস বিক্রেতা) ও আইয়ুব চাচার (পূর্ব পরিচিত, পেশায় গাড়িচালক) নাম বলেছি। তাদের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক ভাল ছিল।
রিয়াদ আরও বলে, মায়ের জন্য খুব খারাপ লাগছে। সেই সঙ্গে বোনটার জন্যও। ঝগড়াঝাঁটি যা হতো তা আসলে বাবার সঙ্গে মায়ের তেমন কিছু নয়। সব আবার ঠিকঠাক হয়ে যেত।
ঘটনার পরপরই কথা হয় নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার বনজ কুমার মজুমদারের সঙ্গে। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ডাকাতি করার কথা বলছে বাড়ির মালিক। কিন্তু আমরা ভাবছি অন্যকিছু। এত অল্প সময়ে ৩০ মিনিটের মধ্যে কিভাবে দুজনকে জবাই করা হলো নিশ্চয় আগে থেকে প্ল্যান ছিল। খুনিরা পূর্ব পরিচিত।
তিনি আরও বলেন, নিহত মহিলার স্বামী শাহ আলমকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদের তালিকায় রেখেছি। তবে খুনটা একজন করেনি। এর সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন অংশ নিয়েছে। প্রথমে মাকে, পরে মেয়েকে কৌশলে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় রাসেল ও জাহাঙ্গীর নামের শাহ আলমের পূর্ব পরিচিত দুই বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে তিনি জানান।

No comments

Powered by Blogger.