যন্ত্রণা যেখানে নিত্যসঙ্গী- সিলেট রুটে ট্রেন by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ

১৩ই মে ২০১৪। সিলেট থেকে রওনা দিয়ে ঢাকার পথে কালনী এক্সপ্রেস নামের ট্রেন। গন্তব্যের প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ট্রেনটি। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ভ্রমণে ক্লান্ত যাত্রীরা নেমে পড়ার প্রস্তুতিতে। হঠাৎ করেই আগুন ধরে যায় কালনী এক্সপ্রেসে। ট্রেনটি তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে যাত্রীদের মাঝে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যায় তিনটি বগি। ভাগ্য ভাল কোন হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। রেলে আগুন লাগার দুঃস্বপ্নটি ফিকে হওয়ার আগেই আবার দুর্ঘটনা ঘটে ঢাকা-সিলেট রুটে। দু’দিন পর দুর্ঘটনা ঘটে ফিরতি পথে। ১৫ই মে ঢাকা থেকে সিলেট আসছিল পারাবত এক্সপ্রেস। দুপুরে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি নরসিংদীর জিনারদী ও নরসিংদী স্টেশনের মধ্যবর্তী এলাকায় পৌঁছার পর লোকোমোটিভ (রেল ইঞ্জিন) থেকে অন্যান্য বগি আলাদা হয়ে যায়। আড়াই ঘণ্টার চেষ্টার পর ট্রেনটি চলতে শুরু করলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ও তালশহর স্টেশনের মাঝামাঝি এসে এবার বিকল হয়ে পড়ে ইঞ্জিনই। মেরামতে সময় লাগে আরও দেড় ঘণ্টা। ট্রেনটি যখন সিলেট পৌঁছে তখন গভীর রাত। সর্বশেষ প্রায় একই ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয় ঢাকা থেকে সিলেটগামী জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসও। গত ৩০শে আগস্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুকুন্দপুর স্টেশনে থামার মুহূর্তে ঝাঁকুনি খায় ট্রেনটি। এতে ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগির সংযোগস্থলের যন্ত্রাংশ ভেঙে যায়। পরে মোটা তার দিয়ে বেঁধে কোন রকমে ট্রেনটিকে পাশের স্টেশন হরষপুরে নিয়ে মেরামতকারীদের খবর দেয়া হয়।
ট্রেন ভ্রমণে এমন দুঃস্বপ্নের সঙ্গে আরও অনেক যন্ত্রণা নিত্যসঙ্গী সিলেটের যাত্রীদের। বগি সঙ্কট, সেবার দুরবস্থা, শিডিউল সঙ্কট, পথে পথে থমকে যাওয়া, লক্কড়-ঝক্কড় ট্রেনে বৃষ্টির হানা, ছারপোকার কামড়। আছে ছিনতাইকারী, পকেটমার আর অজ্ঞান পার্টির আতঙ্ক। সব মিলিয়ে ট্রেন মানেই বাড়তি এক দুর্ভাবনা সিলেটের যাত্রীদের কাছে। সিলেট থেকে সরাসরি ট্রেন সংযোগ রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে। ঢাকা-সিলেট রুটে আন্তনগর ট্রেন রয়েছে চারটি। জয়ন্তিকা, পারাবত, উপবন ও কালনী। প্রথম তিনটি অনেক আগে থেকে থাকলেও কালনীর বয়স খুব বেশি নয়। আলাদা মন্ত্রণালয় হিসেবে রেলের পথ চলা শুরুর সময় থেকে কালনীর যাত্রা। এছাড়া এ রুটে সুরমা নামে একটি মেইল ট্রেনও রয়েছে। এ ৫ ট্রেনে সব মিলিয়ে ৬৮টি বগি থাকার কথা থাকলে ট্রেনগুলো চলছে ৪৫টি বগি দিয়ে। এর মধ্যে জয়ন্তিকায় ১৩টি বগির মধ্যে এখন চলছে ১০টি, পারাবত এক সময় ২০টি বগি নিয়ে যাত্রা করলেও এখন এর বগির সংখ্যা ১২টি, উপবনের ১৩ বগির মধ্যে চলছে ১২টি, আর ১৩টি থেকে কালনীর বগি দাঁড়িয়েছে ৬-এ। সুরমা মেইলে ৯টি বগির মধ্য থেকে বাদ পড়েছে ৪টিই।
চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে আন্তনগর ট্রেন রয়েছে দু’টি। এগুলো হলো পাহাড়িকা ও উদয়ন। জালালাবাদ নামে একটি মেইল ট্রেনও রয়েছে এ রুটে। তিন ট্রেন মিলিয়ে এ রুটে ৩২টি বগি চলাচলের কথা, চলছে ৩০টি। এর মধ্যে পাহাড়িকা ও উদয়নে ১৩টি করে বগি চলার কথা দু’টো ট্রেনেই একটি করে বগি কম রয়েছে। জালালাবাদ এক্সপ্রেসে ৬টি বগির ৬টিই চলছে।
শাখা ট্রেনের মধ্যে সিলেট-আখাউড়া রুটে একটি করে ট্রেন ও ডেমু ট্রেন রয়েছে। কুশিয়ারা নামের ট্রেনটিতে ৬টি বগির ৬টিই চলছে। আর ডেমু ট্রেন চলছে দুটি ট্রেনের একটি সেট নিয়ে। সিলেট ছাতক রুটে একটি ট্রেন চললেও জনবল সঙ্কটের কারণে বন্ধ রয়েছে খাজাঞ্চি ও আফজলাবাদ স্টেশন। জনবল সঙ্কট ও নানা কারণে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে তিনটি শাখা ট্রেন। কুলাউড়া-শাহবাজপুর, শায়েস্তাগঞ্জ-হবিগঞ্জ, শায়েস্তাগঞ্জ-বাল্লা রুটে চলাচলকারী শাখা ট্রেনগুলো বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এর মধ্যে কুলাউড়া-শাহবাজপুর শাখা ট্রেনটি এক যুগ ধরে বন্ধ রয়েছে। স্থানীয়দের কাছে লাতুর ট্রেন নামে পরিচিত ট্রেনটি কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনে ব্রিটিশ আমল থেকেই চলছিল। ব্রিটিশ আমলে আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের অধীনে কুলাউড়া-শাহবাজপুর হয়ে ভারতের শিলচর পর্যন্ত যাতায়াত করতো। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর থেকে কুলাউড়া-শাহবাজপুর সেকশনে মধ্যবর্তী ৪২ কিলোমিটারের মধ্যে ট্রেনটির চলাচল সীমিত হয়। ট্রেনটির যাত্রায় সরগরম ছিল জুড়ী, দক্ষিণ ভাগ, কাঁঠালতলী, বড়লেখা, মুড়াউল ও শাহবাজপুর স্টেশন। ঘন ঘন দুর্ঘটনার পাশাপাশি সংস্কারের অভাবে কাঠের স্লিপার, সেতুসহ রেলপথের অন্যান্য যন্ত্রাংশ নষ্ট হওয়ার উপক্রম হলে ২০০২ সালের ৭ই জুলাই ট্রেনটি বন্ধ করে দেয় রেল কর্তৃপক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় স্লিপার, পাথর, ক্লিপসহ রেল লাইনের যন্ত্রপাতি চুরি হয়ে গেছে। দখল হয়ে গেছে রেলওয়ের জমিও।
জনবল সঙ্কটের কারণে ঢাকা-সিলেট বা ঢাকা চট্টগ্রাম রুটেও বেশ কিছু স্টেশন বন্ধ রয়েছে। এ রুটের ভাটেরা বাজার, টিলাগাঁও, ইটাখোলা লস্করপুর স্টেশনে এখন আর থামে না কোন ট্রেন। সিলেট লাইনে রেলে তুলনামূলক সুযোগ সুবিধারও কমতি রয়েছে। ঢাকা-সিলেট রুটে সুরমা মেইলে এক সময় ফার্স্ট ক্লাস, এসি (শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেবা) ও খাবার গাড়ি থাকলেও এখন এর কিছুই নেই। পারবত ও উপবন থেকে বাদ পড়েছে স্নিগ্ধা নামের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেবা। আর যে সব ট্রেনে এ সব সুবিধা রয়েছে তা-ও একেবারে সীমিত পর্যায়ে। রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের সিলেট লাইনে চাইলে পুরো একটি এসি ট্রেন চালানো সম্ভব। যাত্রীর সঙ্কট হবে না। রেল সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র মতে, অনেক অসুবিধা সত্ত্বেও রেলের প্রতি এখনও সাধারণের আস্থা রয়েছে। যাত্রী পরিবহনে আয়ও বাড়ছে, তবে পণ্য পরিবহন হ্রাস পাওয়ায় আয়ে সামঞ্জস্য রক্ষা হচ্ছে না। আলাদা মন্ত্রণালয় হিসেবে যাত্রা শুরুর পর রেলের অনেক উন্নতি হয়েছে উল্লেখ করে সিলেট রেলওয়ে স্টেশনের বিভিন্ন কর্মকর্তা জানান, ডিসেম্বরে নতুন ইঞ্জিন আসার কথা রয়েছে, এলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে।

No comments

Powered by Blogger.