জাপা’র ভেল্কিবাজি by লুৎফর রহমান


কথা ও কাজে রীতিমতো ভেল্কি দেখাচ্ছে জাতীয় পার্টি। সেনাশাসকের হাত ধরে গড়া দলটি এখন পরিণত হয়েছে সার্কাস পার্টিতে। চেয়ারম্যান  হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দিনে-রাতে অবস্থান পরিবর্তন ও চটকদার বক্তব্যে বিভ্রান্ত, ব্যতিব্যস্ত খোদ পার্টির নেতাকর্মীরাই। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে শুরু হওয়া দলীয় মেরুকরণে বিপর্যস্ত জাপায় এখন শেষ কথা বলতে কিছু নেই। দলীয় সিদ্ধান্তের বিষয়ে খোদ কেন্দ্রীয় নেতারাই একেক সময় একেক কথা বলছেন। ৫ই জানুয়ারির আলোচিত নির্বাচন ঘিরে দলটির চেয়ারম্যান নিজেই নানা হাস্যরসাত্মক বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন। জীবন থাকতে নির্বাচনে অংশ নেবেন না- এমন কথা বলে, গ্রেপ্তার করতে এলে আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে তখন তিনি ছিলেন মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে। গণমাধ্যমের চোখে থাকা এরশাদ যখন নাটকীয়তায় সরকারি সংস্থার গাড়িতে হাসপাতালে যান তখনও তাকে ঘিরেই ছিল আলোচনা। হাসপাতাল থেকে ফিরে বঙ্গভবনে যখন মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেন তখনও ক্যামেরার চোখ তার দিকে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়ে বাসায় ফেরা এরশাদ সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার অবস্থান বদলাচ্ছেন। কখনও সরকারের আবার কখনও রাজপথের বিরোধী দলের সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন তিনি। রাতারাতি অবস্থান পরিবর্তন করে নিজ দলেই নিজের অবস্থান হারিয়েছেন সাবেক এ সেনাশাসক। তাকে নিয়ে ঘরে-বাইরে চলা সমালোচনায় নিজেই রসদ যোগান বারবার। এক সময়ে জাতীয় পার্টির দুর্গ বলে খ্যাত রংপুর অঞ্চলেই এখন দুর্দিন চলছে দলটির। শুধু কি রংপুর, সারা দেশেই বেহাল ৯ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটি। নির্বাচনের পর দলের শীর্ষ নেতৃত্বে যে বিভক্তি দেখা দিয়েছিল তা ক্রমে প্রকট হচ্ছে। বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে ক্ষমতাকেন্দ্রিক বিরোধ এখন অনেকটাই প্রকাশ্য। বিরোধী দলের উপনেতা নিয়োগ নিয়ে দুই নেতার টানাপড়েনের কারণে বিষয়টি মীমাংসাই করা যাচ্ছে না। সরকারে থেকে সরকারের সমালোচনা করায় এখন সরকারি দলেরও নেতারা ক্ষুব্ধ এরশাদের প্রতি। সমালোচকরা বলছেন, এরশাদ বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব জায়েজ করতেই একেক সময় একেক রকম কথা বলছেন। একই সঙ্গে তিনি দলের অবস্থান অস্পষ্ট রেখে রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছেন। এরশাদের দ্বৈত ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে রোববার আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তিনি (এরশাদ) সরকারে থেকে সরকারের সমালোচনা করতে পারেন না। কোন দল চাইলে জোট থেকে বের হয়ে যেতে পারে। সেটি তাদের বিষয়। তবে সরকারে থেকে সমালোচনা ঠিক নয়।

এদিকে রোববার জাতীয় সংসদে উত্থাপিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিলের বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই বিলটি উত্থাপন হলে তারা এর বিরোধিতা করবেন। কারণ এ বিল পাস হলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে। যদিও রোববার আইনমন্ত্রী যখন বিলটি উত্থাপন করেন তখন জাতীয় পার্টির সদস্যরা টেবিল চাপড়ে বিলে সম্মতি প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে পরে দলটির পক্ষ থেকে অবস্থান পরিষ্কার করে আর কিছু জানানো হয়নি।
একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। সে বিতর্কে উতরে যেতে বেশ কিছু দিন ধরে আলোচনা হচ্ছে মন্ত্রিসভা থেকে জাপার সদস্যদের পদত্যাগের বিষয়টি। দলটির সংসদীয় দলের সর্বশেষ বৈঠকেও এ নিয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠকের বরাতে এমপিরা জানিয়েছিলেন, মন্ত্রিসভা থেকে দলের সদস্যদের পদত্যাগের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে দলের চেয়ারম্যান এরশাদ ও বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ একমত হয়েছেন। রোববার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক অনুষ্ঠানে জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ বলেন, মন্ত্রিসভা থেকে দলের সদস্যদের পদত্যাগের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এরশাদ দুপুরে এ কথা বললেও বিকালে তার নেতৃত্বাধীন দলের সমর্থন নিয়ে জাতীয় সংসদে উত্থাপন হয় বহুল আলোচিত সংবিধান সংশোধন বিল। এ বিলের মাধ্যমে বিচারপতি অভিশংসনের ক্ষমতা ফিরে পাবে জাতীয় সংসদ। রাজপথের বিরোধী দলসহ সুশীল সমাজ ও বিভিন্ন মহল এর বিরোধিতা করছে। সূত্র জানায়, এরশাদ যখন মন্ত্রীদের পদত্যাগের কথা বলছেন তখন তিনি নিজেও সরকারি সুযোগ সুবিধা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্বে আছেন। দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগের আগে তাকে প্রথম এ পদ ছাড়তে হবে। তবে তিনি সহসা এ পদটি ছাড়ছেন না। তারপরও মন্ত্রীদের পদত্যাগের কথা বলাটা নিছক স্টান্টবাজি বলেই মনে করছেন অনেকে। বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি যখন সমালোচনার কেন্দ্রে তখন নানা সময়ে দলটির নেতারা তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে এ সমালোচনাকে উস্কে দিচ্ছেন। বিদেশীদের চোখেও বিরোধী দল হিসেবে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না দলটি। তাই প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকায় যেতে কসরত করার কথাও বলা হচ্ছে। কিন্তু ফল দৃশ্যত দেখা যাচ্ছে উল্টো। দলের ভেতরে দলাদলি আর সরকারে প্রতি কুঁজো হয়ে থাকা জাপার ভাবমূর্তি ফেরানোটা যে কঠিন তা স্বীকার করছেন দলটির নেতাকর্মীরাই। জাতীয় পার্টি কার্যত ক্রান্তিকাল অতিক্রম করলেও এরশাদ এখন উপহাস করছেন দেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপিকে নিয়ে। তিনি প্রায়ই বিএনপির নেতাকর্মীদের তার দলে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। বাস্তবতা উল্টো স্রোতে ভেসে এরশাদ নিজ দলের কর্মীদের স্বপ্ন দেখান ক্ষমতায় যাওয়ার। তিনি দাবি করছেন, এখন দেশে একমাত্র জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তি হলো জাতীয় পার্টি। গত মাসে ফেনীতে এক অনুষ্ঠানে এরশাদ বিএনপির উদ্দেশে টিপ্পনি কেটে বলেন, একটি দল প্রতিনিয়ত আন্দোলনের হুমকি দিচ্ছে। তাদের ঘরে-বাইরে কোথাও আন্দোলন করতে দেখি না। তাদের আন্দোলন করার শক্তি নেই, মাজায় জোর নেই। হাওয়া ভবন করে টাকা আদায় করে তারা বিদেশ পাঠিয়েছে। যারা হাওয়া ভবন করেছে তাদের খাওয়া নেই। বিএনপির উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা জামায়াত ছাড়েন, আমাদের দলে আসেন। আমরাই প্রকৃত জাতীয়তাবাদী দল। রোববার হবিগঞ্জের এক অনুষ্ঠানে এরশাদ বিএনপিকে নিয়ে কথা বলেন, দলটির অবস্থান নড়বড়ে। ভবিষ্যতে দলটি ঠিকে থাকবে কিনা- এ নিয়ে সন্দেহ আছে।
সম্প্রতি দলীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন এরশাদ। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এখন দেশে কিসের গণতন্ত্র চলছে? গণতন্ত্র  কোথাও দেখি না। গণতন্ত্র মানে সুশাসন। দেশে কি সুশাসন আছে? আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে ফিরে আসতে পারে না। এ কেমন গণতন্ত্র? অন্য একটি অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টি ক্ষমতায় যাবে- এমন আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, দুই দলের ধারাবাহিক ব্যর্থতায়  দেশবাসী আবার জাতীয় পার্টিকেই ক্ষমতায় দেখতে চায়। সামনে আমাদের সুদিন অপেক্ষা করছে। আমাদের একটাই লক্ষ্য, আগামী নির্বাচনে যে কোন মূল্যে ১৫১ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন। এরশাদ নিজের দল নিয়ে এমন কথা বলে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে চাইলেও তিনিই আবার তার দলের অবস্থান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। বলছেন, মানুষ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল হিসেবে বিশ্বাস করে না। এ নিয়ে হাসাহাসি করে। পত্রিকায় তাকে নিয়ে কার্টুনও ছাপা হয়। এসব দলের জন্য লজ্জার।

No comments

Powered by Blogger.