যেভাবে শিক্ষকের হাতে নির্যাতনের শিকার ঢাবি ছাত্রী

স্প্রাইট, কোকাকোলা খেতে রাজি না হলে তিনি একটি বাদামের টিন দেন এবং হঠাৎ আমার মুখে তুলে খাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এরপর তিনি আমাকে হাত ধরে টেনে সোফা থেকে বিছানায় নেয়ার চেষ্টা করেন। আমি বাধা দিয়ে বলতে থাকি বাসায় যাবো। ২-৩ মিনিট চেষ্টা করে এক পর্যায়ে উনি আমাকে পরীক্ষার খাতাটা দেখিয়ে বলেন, তাহলে আমি এখানে কি নম্বর দেব? কত দেব আপনাকে, আপনিই বলেন। তখন আমি স্যারকে বলি ওনার যা ইচ্ছা তাই যেন দিয়ে দেন- এই কথা বলে কাঁদতে শুরু করলে উনি দরজা খুলে দেন।’ শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে ঢাবি ভিসির কাছে এভাবে লিখিত অভিযোগ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের ছাত্রী। পরীক্ষার খাতা সংশোধন করার কথা বলে বাসায় ডেকে নিয়ে এই ছাত্রীকে এভাবে যৌন হয়রানি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিভাগের চেয়ারম্যান। ড. সাইফুল ইসলাম নামের ওই শিক্ষক বিভাগের ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের এক ছাত্রীকে বাসায় ডেকে নিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। পুরো ঘটনার একটি রেকর্ড মানবজমিনের হাতে এসেছে। রেকর্ডে ওই ছাত্রী ও শিক্ষকের মধ্যে কথোপকথন বিস্তারিত শোনা যায়। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ভিসি বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। গতকাল বিষয়টি বিভাগে ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীরা দিনব্যাপী ওই শিক্ষককে প্রথমে ক্লাসরুমে পরে তার কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখে। পদত্যাগ চেয়ে স্লোগান দিতে থাকে। এরপর বেলা দেড়টার দিকে ওই শিক্ষক চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। এছাড়া, ক্যাম্পাসে বিভিন্ন বাম সংগঠন অভিযুক্ত শিক্ষকের আজীবন বহিষ্কার এবং শাস্তি চেয়ে মিছিল করে। ভিসি বরাবর লিখিত আবেদন করে ওই ছাত্রী জানান, ২৮শে আগস্ট ৩৫২ নং কোর্সের মিডটার্ম পরীক্ষা হয়। ৮ই সেপ্টেম্বর বিভাগ থেকে ফোন করে জানানো হয়, বিভাগের চেয়ারম্যান স্যারের সঙ্গে দেখা করতে অথবা ফোন করার জন্য। কিছুক্ষণ পর ফোন দিলে স্যার জানান, আমি ব্যস্ত আছি তিনি পরে কথা বলবেন। ১০ই সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় ওই শিক্ষক আমাকে ফোন দিয়ে জানান আমার খাতার প্রশ্নের নম্বর কেটে দেয়া আছে। তিনি এও বলেন, আমি তোমার খাতায় শূন্য দিতে চাই না। তোমাকে একটা সুযোগ দিতে চাই। তিনি আমাকে রোববার রাতে ফোন করতে বলেন এবং বিষয়টি নিয়ে আমি যেন কাউকে কোন কিছু না বলি, বললে আমার অসুবিধা হবে। পুরো বিষয়টি আমি বিভাগের শিক্ষক ওয়াহিদা মল্লিক জলিকে জানাই। এরপর ১৪ই সেপ্টেম্বর শনিবার দুপুর ৩টা ৫৩ মিনিটে ওই স্যার আমাকে ফোন করে বলেন, আমি যেন এক্ষুণি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি। রেকর্ডের ওই শিক্ষক-ছাত্রীর কথোপকথনে শোনা যায়, সে বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা পর্যন্ত তিন বার ফোন বিনিময় হয় তাদের। ক্যাম্পাসে এসে ওই শিক্ষককে কল দিলে তিনি ফোনটি কেটে দেন। পরে কলব্যাক করে কোথায় আছি জানতে চান। ছাত্রী জানায়, সে কার্জন হলের সামনে আছে। ওই শিক্ষককে বলেন, আপনি ইন্টারন্যাশনাল হল চিনেন? ছাত্রী চেনে উত্তর দেয়। এরপর চারুকলার কাছ ঘেঁষে একটা বিল্ডিং রয়েছে চেনেন কিনা জানতে চাইলে ছাত্রী জানায়, সে চিনতে পারছে না। তখন বিকাল ৫টা ৪২ মিনিটে আমার অবস্থান জানিয়ে জলি ম্যামকে একটা এসএমএম করে রাখি। কিছুক্ষণ পর ইন্টারন্যাশনাল হলের সামনে এসে ওই ছাত্রী ফোন দিলে শিক্ষক বলেন, তুমি ফোন না কেটে চারুকলার দিকে যে রাস্তা গিয়েছে সেটি ধরে আগাতে থাকো। একটু সামনে এগুনোর পর শিক্ষক বলে উপরে তাকাও দেখ আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। ওনাকে দেখার পর শিক্ষক বলেন, একটি সাদা গাড়ি দাঁড়ানো আছে এর পাশে যে গেইট আছে সেটা দিয়ে পাঁচ তলায় চলে আসো দরজা খোলা আছে। এরপর ওই ছাত্রী ফোন কেটে তার ফোনের রেকর্ড ওপেন করে। যেখানে সে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার ঠক ঠক শব্দ শোনা যায়। কথোপকথনে শোনা যায়, ওই শিক্ষক ছাত্রীকে বলছেন, ‘আপনি আমাকে বলেছিলেন আপনার কি কি যেন প্রবলেম হয়, ছাত্রীর জবাব স্যার আমি এগুলো অনেকটাই ওভারকাম করেছি। আমার যেটা ছিলো ফ্রাস্টেশন। কিছু ডিপ্রেশন ছিলো। অনেকটা ওভারকাম করেছি। পরীক্ষার খাতা স্যার কি হয়েছে? উত্তরে স্যার বলেন, কি জানি বলছিলাম ডিপার্টমেন্টে বন্ধু কে? ভালো বন্ধু স্যার পলাশ, উজ্জ্বল ওদের সাথেই ভালো সম্পর্ক। শিক্ষকদের মধ্যে কার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক? কারো সঙ্গে ওই রকম বিশেষ ভালো সম্পর্ক নাই। ইয়াম স্যারের সঙ্গে কিছু বিষয় বা ৫ম সেমিস্টারে মইশান স্যার যখন ক্লাস নিয়েছিলেন তখন আমার কিছু প্রবলেম ছিলো তাই ওনার সঙ্গে কিছু শেয়ারিং হয়েছে এতটুকুই... এমনিতে কোন দলীয় ব্যাপার আছে। পলিটিক্স। না স্যার।  আপনার কোন কিছু ঘটলে বা জীবনের সব কথা কাকে বলেন? স্যার আমি জীবনের সব কথা কারো সাথে শেয়ার করি না। এটা যদি করতে পারেন তাহলে হলো... গোপনীয়তার সঙ্গে অনেক কিছু করে জীবনকে উপভোগ করা যায়। জীবনকে আনন্দে রাখা যায়। কি খাবেন বলেন। তাড়া নেই তো যাবার। স্যার একটু তাড়া আছে। মা’র সাথে মামার বাসায় যাবো তো। আপনি বলতেন আপনার অন্য কোনো জায়গায় দাওয়াত আছে। স্যার আমার তো সন্ধ্যার পরে দাওয়াত সেজন্য আমি কিছু বলি নাই। আধা ঘণ্টা থাকতে পারবেন না। জি স্যার। খাতা কি করবো। আমি তো স্যার খাতা কাটি নাই। আমি সে জন্যই এগুলোর কথা জিজ্ঞেস করছি যে ক্লাসে বন্ধু কারা অন্য কোন সমস্যা আছে কিনা। তখন করণীয় জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গ অন্য দিকে নিয়ে গেলে আমি কি খাবো জানতে চান। স্প্রাইট, সেভেন আপ, কোক ইত্যাদি খাওয়ার জন্য বলতে থাকে। হাতে পাওয়া রেকর্ডের আরও দেড় মিনিট রুমের ভিতরে ঠক ঠক শব্দ  শোনা যায়। ঢাবি ভিসিকে ছাত্রীর লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়, আমি খেতে রাজি না হলে তিনি একটি বাদামের টিন দেন এবং হঠাৎ আমার মুখে তুলে খাইয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। এরপর আমাকে গায়ে ধরার চেষ্টা করলে আমার রেকর্ডটি পড়ে গিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তিনি আমাকে হাত ধরে টেনে সোফা থেকে বিছানায় নেয়ার চেষ্টা করেন। আমি বাধা দিয়ে বলতে থাকি আমি বাসায় যাবো। ২-৩ মিনিট চেষ্টা করে এক পর্যায়ে উনি আমাকে পরীক্ষার খাতাটা দেখিয়ে বলেন, তাহলে আমি এখানে কি নম্বর দেব? কত দেব আপনাকে, আপনিই বলেন। তখন আমি স্যারকে বলি ওনার যা ইচ্ছা তাই যেন দিয়ে দেন এই কথা বলে কাঁদতে শুরু করলে উনি দরজা খুলে দেন। লিখিত অভিযোগে ছাত্রী বলছে, একজন শিক্ষক পরীক্ষার খাতা প্রসঙ্গে ডাকলে তখন আর আর কী করণীয় ছিল ঠিক বোধগম্য হচ্ছিল না। আর বিভাগ থেকে দাপ্তরিকভাবে জানানো হয়েছিল আমি ভাবতে পারেনি স্যার এই ধরনের আচরণ করতে পারেন। এই ঘটনায় অসহায় বোধের কথাও লিখিতভাবে ভিসিকে জানান।
এদিকে অভিযুক্ত শিক্ষক সাইফুল ইসলাম দাবি করেন তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। তদন্তের স্বার্থে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।

No comments

Powered by Blogger.